অদ্ভুত এক বছর দেখল বিশ্ববাসী। যেন সব খারাপের বছর। ২০২০ সালকে অনেকেই বলছেন বিষময় বিশ। করোনাভাইরাসের সঙ্গে মানুষের লড়াই চলেছে বছরজুড়ে।
দুঃখের হলেও সত্যি সে লড়াইয়ে বেশি শক্তি দেখিয়েছে করোনাই। বছরজুড়ে করোনাভাইরাসের তাণ্ডবই ছিল মূল আলোচ্য বিষয়। বিশ্বনেতা, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ, গবেষক, বিজ্ঞানী, তারকা—সবার কপালেই করোনা ফেলেছে চিন্তার ভাঁজ। আর সে চিন্তা থেকেই করোনা মহামারি কেন্দ্র করে নানা সময়ে নানা কথা এসেছে। চলেছে বিতর্কও।
বছরের শেষ দিকে এসে টিকা মানুষকে আশার আলো দেখিয়েছে। সে টিকা নিয়েও আশা-নিরাশার নানা আলোচনা চলেছে। ফিরে দেখা যাক বছরজুড়ে চলা এসব আলোচনার দিকে।
করোনাভাইরাস নিয়ে বছরজুড়ে নাটকীয় সব কাণ্ড করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রে যখন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ তুঙ্গে, তখন ট্রাম্প এটিকে হালকা বিষয় বলে উড়িয়ে দিতে চেয়েছেন বারবার। করোনাভাইরাসকে তিনি ‘চায়না ভাইরাস’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। করোনাকে তুলনা করেন সাধারণ ফ্লুর সঙ্গে। যুক্তরাষ্ট্র করোনা সংক্রমণে শীর্ষে থাকায় সমালোচনার মুখে ট্রাম্প বলতে থাকেন পরীক্ষা বেশি হয় বলেই সেখানে সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা বেশি। কোভিড–১৯–এর চিকিৎসা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গেও প্রায়ই মতবিরোধ হয় ট্রাম্পের। হাইড্রোক্লোরোকুইন ব্যবহারের পক্ষে ছিলেন ট্রাম্প।
একপর্যায়ে তিনি বলে বসেন, করোনা প্রতিরোধে তিনি নিয়মিত হাইড্রোক্লোরোকুইন সেবন করেন। তবে ট্রাম্পের এই দাবি ধোপে টেকেনি। মার্কিন নির্বাচনের কিছুদিন আগে করোনায় সংক্রমিত হন ট্রাম্প। তিন দিন তাঁকে হাসপাতালে থাকতে হয়। এরপর ট্রাম্প যা বলেন, তা আরও উদ্ভট। ৭ অক্টোবর হোয়াইট হাউস থেকে এক ভিডিও বার্তায় ট্রাম্প বলেন, তিনি মনে করেন, তাঁর করোনায় সংক্রমিত হওয়াটা ঈশ্বরের আশীর্বাদ।
ট্রাম্পের মতোই আরেক অদ্ভুত ব্যক্তি ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারো।
করোনার মহামারি শুরু থেকেই লকডাউনের বিরুদ্ধে কথা বলছেন তিনি। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সামলাতে অনেক দেশ নতুন করে লকডাউন দিচ্ছে। এটিকে পাগলামি বলছেন বলসোনারো। জুলাই মাসে নিজেও করোনায় সংক্রমিত হন বলসোনারো।
করোনায় সংক্রমিত হওয়ার পরেও তিনি মাঝেমধ্যে তাঁর বাসভবনের বাইরে আসতেন। এমনকি একসময় এক র্যালিতে তিনি মাস্কও খুলে ফেলেন। ট্রাম্পের মতো বলসোনারোও করোনা প্রতিরোধে ম্যালেরিয়ার ওষুধ হাইড্রোক্লোরোকুইন ব্যবহারের পক্ষপাতী।
শুধু করোনাকে হেলাফেলা নয়, করোনাভাইরাসের টিকা নিয়েও নানা সময় সন্দেহ প্রকাশ করেছেন বলসোনারো। সাফ জানিয়েছেন, তিনি টিকা নেবেন না। ব্যঙ্গ করে বলেছেন, টিকা কেবল তাঁর পোষা কুকুরের জন্য। করোনার ব্যাপক সংক্রমণের পরও মাস্ক পরার তেমন কোনো কার্যকারিতা আছে বলে মনে করেন না বলসোনারো। ট্রাম্পের মতোই করোনার টিকা নিতেও নারাজ বলসোনারো। ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে এসে তিনি বলেন, ‘বোকাদের আমি বলতে চাই, আমি করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে গেছি। আমার শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে গেছে। তাহলে আমি আর কেন টিকা নেব?’
করোভাইরাসের টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ চলে ব্রাজিলে। টিকা নিয়ে সবাই যখন করোনা থেকে মুক্তির স্বপ্ন দেখছেন, তখন বলসোনোরো উদ্ভট মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকা নিলে মানুষ কুমিরে রূপান্তরিত হতে পারে বা নারীর দাঁড়ি গজাতে পারে। পুরুষকণ্ঠ পরিণত হতে পারে নারীকণ্ঠেও।’
ডিসেম্বরের শেষ দিকে এসে করোনার টিকা নিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ৭৮ বছর বয়সী বাইডেন ডেলাওয়ার অঙ্গরাজ্যের একটি হাসপাতালে টিকা নেন।
বাইডেন বলেন, টিকা গ্রহণ যে নিরাপদ, আমেরিকানদের তা বোঝাতেই তিনি টিকা নিচ্ছেন। টিকা নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যেখানে টিকা নিতেই চান না, সেখানে জনগণকে টিকার কার্যকারিতা বোঝাতে বাইডেনের এমন উক্তি যথেষ্ট প্রশংসিত হয়েছে।
করোনা পজিটিভ হয়ে বার্সেলোনার বিপক্ষে খেলতে না পেরে খেপে যান ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। খেলার ২৪ ঘণ্টা আগে কোভিড–১৯ পরীক্ষায় পজিটিভ হন পর্তুগিজ তারকা। ইনস্টাগ্রামে রোনালদো লেখেন তিনি সুস্থ ও ভালোবোধ করছেন। পিসিআর পরীক্ষা ভুয়া বলেও মন্তব্য করেন।
এর ১৫ দিন আগে দেশের হয়ে নেশনস কাপের দায়িত্ব পালনের সময় প্রথমবার করোনা পজিটিভ হন রোনালদো। করোনা শনাক্তের জন্য পিসিআর টেস্ট (পলিমেরাস চেইন রি-অ্যাকশন) করা হয়। রোনালদো এ পরীক্ষার ফল কতটা নির্ভুল, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। ইনস্টাগ্রামে রোনালদোর অনুসারী ২৪ কোটি ১০ লাখ। প্রায় দেড় ঘণ্টা পর পিসিআর পরীক্ষা নিয়ে করা মন্তব্যটি মুছে ফেলেছিলেন রোনালদো।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ে বলিউডের জনপ্রিয় অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন লিখেছেন কবিতা। সংক্রমণের শুরুর দিকে মার্চ মাসে তিনি সেটি টুইট করেন। কবিতাটি অমিতাভ লেখেন অওধি ভাষায়। অমিতাভের লেখা এই কবিতার কয়েকটি লাইনের বাংলায় অনুবাদ ছিল এমন—
‘সাবান দিয়ে হাত না ধুয়ে ভাই, কাউকে ছুঁয়ো না
আমি বলি, ঠিক আছে, করব যেমন বলছ সব
আসুক করোনাভাইরাস, দেখাব বুড়ো আঙুল-বৈভব’
(অনুবাদ: জাভেদ হুসেন)
নিজের লেখা কবিতা আবৃত্তিও করেন অমিতাভ। ইনস্টাগ্রামে মাত্র ২৪ ঘণ্টায় তাঁর এই আবৃত্তির ভিডিও দেখা হয়েছে ১৪ লাখ ৭৮ হাজারবার। আর মন্তব্য জড়ো হয়েছে ১২ হাজারের বেশি। সেরা না বলে উপায় কী।
জুলাই মাসে অমিতাভ করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হন। হাসপাতালে ভর্তিও হন তিনি। অমিতাভপুত্র অভিষেক বচ্চন, পুত্রবধূ ঐশ্বরিয়া রাই বচ্চন ও নাতনি আরাধ্যরও করোনা পজিটিভ আসে। হাসপাতালে থাকা অবস্থায় অমিতাভ নিয়মিত ভক্তদের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যোগাযোগ রেখেছেন। কবিতার মতোই বুড়ো আঙুল-বৈভব দেখিয়ে সপরিবারে সুস্থ হয়ে ওঠেন তিনি।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণের শুরু থেকে এর গতিবিধি নিয়ে কথা বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ অ্যান্থনি স্টিফেন ফাউসি। যুক্তরাষ্ট্রে করোনার সংক্রমণ নিয়ে নানা তথ্য দেওয়ায় ট্রাম্প প্রশাসনের সমালোচনার মুখেও পড়েন ফাউসি।
সংক্রমণের শুরুর দিকে এপ্রিল মাসে ফাউসি বলেছিলেন, পৃথিবী থেকে এ বছর করোনা সম্পূর্ণ নির্মূল হওয়ার সম্ভাবনা নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরের ফ্লু মৌসুমে এই ভাইরাসের সংক্রমণ আবার দেখতে পাবে। তিনি এমনও বলেন, এটি মৌসুমি ফ্লু হয়ে থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বছরের শেষে এসে ফাউসির সে বক্তব্যই সত্যি বলে প্রমাণিত হয়েছে। মাঝে সংক্রমণের হার কিছুটা কমলেও করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আবার বেড়েছে শীত মৌসুমে। যুক্তরাজ্যে করোনার নতুন ধরন প্রথম শনাক্ত হয়েছে।
নতুন এই ধরন ছড়িয়ে পড়েছে ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা ও যুক্তরাষ্ট্রেও।
বছরের শেষে এসে আরও খারাপ খবর জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)।
করোনা নিয়ে ডব্লিউএইচও বছরের শেষ মিডিয়া ব্রিফিংয়ে ২৯ ডিসেম্বর বলেছে, চলমান করোনাই বড় মহামারি নয়। সামনে আরও ভয়াবহ মহামারি আসতে পারে। বিশ্বকে সে জন্য প্রস্তুতি নিতে আহ্বান জানিয়েছে ডব্লিউএইচও। সেই সঙ্গে করোনার সঙ্গে বিশ্বকে বাঁচতে শেখারও আহ্বান জানিয়েছে। করোনা ইস্যুতে ডব্লিউএইচওর জরুরি কর্মসূচির প্রধান মাইকেল রায়ান সতর্ক করে বলেছেন, করোনার চেয়েও আরও বড় ও মারাত্মক মহামারি ভবিষ্যতে আসতে পারে। তবে এর মধ্যেও কিছুটা আশার কথা বলেছেন, ডব্লিউএইচওর প্রধান তেদরোস আধানোম গেব্রেয়াসুস।
তিনি বলেছেন, করোনা মহামারির অভিজ্ঞতার কারণে ভবিষ্যতে আরও খারাপ পরিস্থিতি সামলানো সহজ হবে বিশ্ববাসীর জন্য। যাঁরা নতুন বছরে দুঃসময় কেটে যাবে বলে আশা করছেন, তাঁদের জন্য এটি খারাপ খবরই বটে।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণে বিশ্ববাসীর জীবন যখন জেরবার, তখনই সুখবর শোনায় বিশ্বখ্যাত ওষুধ কোম্পানি ফাইজার ও জার্মানভিত্তিক বায়োএনটেক কোম্পানি। তাদের কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন আবিষ্কারের পুরো দায়িত্বে ছিলেন বায়োএনটেক কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা তুরস্ক বংশোদ্ভূত জার্মান দম্পতি উগার শাহিন ও ওজলেম তুরেসি। তাঁরা মূলত ক্যানসার সেল নিয়ে গবেষণার জন্য বায়োএনটেক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। করোনা মহামারির সময় টিকা নিয়ে তাঁদের গবেষণা শুরু হয়। টিকার ঘোষণা দেওয়ার সময় উগার শাহিন বলেছিলেন, ‘মানবতার জন্য এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় সুখবর হচ্ছে কোভিড-১৯ সংক্রমণ রোধে আমরা একটি ভ্যাকসিনের খোঁজ পেয়েছি।
’ টিকা আবিষ্কারের ফলে থমকে যাওয়া পৃথিবী আবার সচল হবে, স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ফিরে আসবে। চরম বিপর্যয়ে থাকা বিশ্ববাসীর কাছে সে সময়ে এর চেয়ে সেরা উক্তি আর কী হতে পারে।
খারাপ খবরের পর এবার শোনা যাক আনন্দের কথা। ট্রায়ালের বাইরে বিশ্বে প্রথম যিনি টিকা নেন, তিনি নর্দান আয়ারল্যান্ডের বাসিন্দা মার্গারেট কেনান। তাঁর বয়স ৯০ বছর।
ফাইজার ও বায়োএনটেকের যৌথ উদ্যোগে তৈরি করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) টিকা তাঁকে দেওয়া হয়। টিকা নিতে পেরে দারুণ খুশি হন মার্গারেট। ডিসেম্বরের শুরুর দিকে টিকা নেন তিনি। পরের সপ্তাহে ছিল মার্গারেটের জন্মদিন।
টিকাকে জন্মদিনের সেরা আগাম উপহার বলে উল্লেখ করেন মার্গারেট। পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে নতুন বছর ভালোভাবে কাটানোর আশা করেন তিনি।
করোনা পরিস্থিতিতে ২০২০ সালের প্রবৃদ্ধি নিয়ে খারাপ খবর দিয়েছিল আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ। করোনা মহামারির কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে যে ক্ষতি হবে, এর আর্থিক জের ১২ ট্রিলিয়ন ডলারে গিয়ে দাঁড়াবে বলে আভাস দিয়েছে আইএমএফ।
এক ট্রিলিয়ন সমান এক লাখ কোটি। বিশ্বের কোনো বৃহৎ অর্থনীতিই মহামারির থেকে রক্ষা পাবে না বলে জানিয়েছে আইএমএফ। তবে বছরের শেষ দিকে এসে আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চের (সিইবিআর) প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদনে জানানো হয় করোনা পরিস্থিতি ভালোভাবে সামাল দিতে পারায় বিশ্বের সবচেয়ে অর্থনৈতিক শক্তিধর দেশ হবে চীন। বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ২০২৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রকে টপকে যাবে চীন।