করোনাভাইরাস বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। এখনো এমন কোনো ওষুধ বা ভ্যাকসিন নেই, যা ভাইরাস মেরে ফেলতে পারে বা এর বিরুদ্ধে সুরক্ষা দিতে পারে। প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে আমরা এই জীবন রক্ষাকারী ওষুধ থেকে কত দূরে? গবেষকেরা এ প্রশ্নের জবাবে বলছেন, অসম্ভব দ্রুততার সঙ্গে গবেষণাকাজ এগিয়ে চলেছে। বর্তমানে ২০টির বেশি ভ্যাকসিন বা টিকার উন্নয়নে কাজ চলছে।
জানা গেছে, একাধিক ধাপ পেরিয়ে মানুষের ওপর তিনটি টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু হয়েছে। এই পরীক্ষা চলছে যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলে, যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ডে এবং চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে। এসব ট্রায়ালের সঙ্গে ৬৫০ জন মানুষ যুক্ত হয়েছেন। অন্যদিকে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, চারটি ওষুধ ও কয়েকটি ওষুধের সমন্বিত প্রয়োগ নিয়ে কাজ চলছে।
গত মাসে সিয়াটলে এ পরীক্ষা শুরু হয়। তারা ভ্যাকসিনের সুরক্ষা বা কার্যকারিতা পরীক্ষা করতে কোনো প্রাণীর ওপর গবেষণা এড়িয়ে যাওয়ার অস্বাভাবিক পদক্ষেপ নিয়েছে। করোনা মহামারি ঠেকানোর বৈশ্বিক দৌড়ে শামিল হয়েছে অস্ট্রেলিয়া। দেশটির জাতীয় বিজ্ঞান সংস্থার পক্ষ থেকে গত বৃহস্পতিবার বলা হয়েছে, এটি কোভিড-১৯-এর সম্ভাব্য ভ্যাকসিন পরীক্ষার প্রথম পর্যায়ে কাজ শুরু করেছে। দুটি সম্ভাব্য ভ্যাকসিন নিয়ে মেলবোর্নের কাছে একটি পরীক্ষাগারে কমনওয়েলথ সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ অর্গানাইজেশনের (সিএসআইআরও) প্রাক্-ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা শুরু হবে। প্রাথমিক পর্যায়ের এ পরীক্ষা সম্পন্ন হতে তিন মাস সময় লাগবে বলে জানান সিএসআইআরওর স্বাস্থ্য পরিচালক রব গ্রেনফেল।
বিবিসি অনলাইনের প্রতিবেদনে বলা হয়, এ–জাতীয় পরীক্ষাগুলো সাধারণ পরীক্ষা চেয়ে দ্রুত ঘটছে এবং কেউ কেউ ভ্যাকসিনগুলোর জন্য নতুন পদ্ধতি ব্যবহার করছে। তবে এ পরীক্ষার সবকিছু যে ঠিকঠাকমতো হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই জেনেই সবাই কাজ করছে।
যদি এসব পরীক্ষা বা অন্য কোনো পরীক্ষা সফল বলে প্রমাণ করা যায়, এরপরও আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়ের আগে ভ্যাকসিন বা টিকা উৎপাদনের আশা করতে পারছে না উৎপাদকেরা। মনে রাখতে হবে, এখন পর্যন্ত মানুষের ওপর চারটি করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঘটেছে। এগুলোয় সাধারণ ঠান্ডা লাগার কারণ হয়। তবে কোনোটির জন্যই এখন পর্যন্ত ভ্যাকসিন নেই।
বর্তমানে চিকিৎসকেরা ভাইরাসপ্রতিরোধী বিভিন্ন ওষুধ নিয়ে করোনাভাইরাস ঠেকানো যায় কি না, তা পরীক্ষা করে দেখছেন। এ ধরনের গবেষণার গতি বাড়ার কারণ তা মানুষের জন্য নিরাপদ বলে প্রমাণিত। ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডে অল্পসংখ্যক রোগীর ওপর রেমডিসিভার নামে ভাইরাসবিরোধী ওষুধ পরীক্ষা করে দেখেছেন গবেষকেরা। এটি ইবোলার ওষুধ হিসেবে তৈরি করা হলেও অন্য ভাইরাসের ক্ষেত্রেও এটি কার্যকর হিসেবে প্রমাণিত হয়। একই রকম পরীক্ষা যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের করা হয়েছে। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এর ফলাফল পাওয়া যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
করেনাভাইরাস মোকাবিলায় এইচআইভির একজোড়া ওষুধ কার্যকর হতে পারে বলে আশা করা হলেও এর পরীক্ষালব্ধ তথ্য হতাশাজনক। এ পদ্ধতিতে রোগী সেরে ওঠা বা মৃত্যুহার কমাতে পারেনি। তবে অত্যন্ত অসুস্থ রোগীর ক্ষেত্রে এটি প্রয়োগ করা হয়েছিল বলে ওষুধ ঠিকমতো কার্যকর হয়নি বলে মনে করা হচ্ছে।
ম্যালেরিয়াপ্রতিরোধী ওষুধ ক্লোরোকুইন নিয়েও গবেষণা চলছে। গবেষণাগারের পরীক্ষায় দেখা গেছে, এটি ভাইরাসকে মারতে পারে। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, এ ওষুধের কার্যকারিতার কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণ নেই।
যদি করোনাভাইরাসের কোনো ভ্যাকসিন তৈরি করা যায়, তবে তা সব বয়সের মানুষকে রক্ষা করতে পারবে কি না, সে প্রশ্ন উঠছে। গবেষকেরা এ ব্যাপারে আশাবাদী। তাঁরা বলছেন, টিকা তৈরি করা গেলে সব মানুষের ওপর তা কার্যকর হবে। তবে বয়স্ক মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় বলে তাঁদের ক্ষেত্রে সফলতার হার কম হতে পারে। কিন্তু এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়। সব ওষুধ, এমনকি সামান্য ব্যথানাশকেরও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে। করোনাভাইরাস ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শেষ না হওয়া পর্যন্ত এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে বলা যাবে না। করোনার পরীক্ষামূলক ভ্যাকসিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার বিষয়টিতে নিয়ন্ত্রকেরা কড়া নজর রাখবেন।
ভ্যাকসিন যদি তৈরি করা সম্ভব হয়, তবে শুরুতে তার সরবরাহ হবে অল্প। প্রাথমিক পর্যায়ে ভ্যাকসিনের স্বল্পতার কারণে কারা গুরুত্ব পাবে, সে বিষয়টি নির্ধারণ জরুরি হয়ে পড়বে। করোনাভাইরাস সংক্রমিত রোগীর সংস্পর্শে আসা স্বাস্থ্যকর্মীরা সবার আগে তালিকার শীর্ষে থাকবেন। সাধারণত, এ রোগকে বয়স্কদের জন্য বেশি মারাত্মক বলে তারাও ভ্যাকসিন পাওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্ব পাবেন। এ ছাড়া যাঁরা বয়স্কদের দেখভাল করেন, তাঁদের বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।
যতক্ষণ পর্যন্ত ভ্যাকসিন হাতের নাগালে না আসছে, ততক্ষণ পর্যন্ত ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
আপনি যদি করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হন, তবে বেশির ভাগ মানুষের ক্ষেত্রে এটি হালকা হবে এবং বাড়িতে বিছানায় বিশ্রাম নিলেই সেরে যাবে। এর বাইরে প্যারাসিটামল এবং প্রচুর পরিমাণে তরল খাবার দিয়ে বাড়িতে চিকিৎসা করা যেতে পারে। কিছু রোগীর অবস্থা গুরুতর হতে পারে এবং তাদের হাসপাতালের চিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে।
দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভ্যাকসিনকে আক্রমণকারী হিসেবে শনাক্ত করে এবং কীভাবে তাদের লড়াই করবে, তা শিখে নেয়। যখন শরীর সত্যিকারের ভাইরাসের মুখো পড়ে, তখন আগে থেকেই জানতে পারে, কীভাবে এর বিরুদ্ধে লড়তে হবে। কয়েক দশক ধরে ভ্যাকসিন প্রয়োগের মূল পদ্ধতিটি হলো আসল ভাইরাসটি ব্যবহার করা। হাম, মাম্পস এবং রুবেলা (এমএমআর) ভ্যাকসিনগুলো সেই ভাইরাসের দুর্বল সংস্করণ ব্যবহার করে তৈরি করা হয়, যা কোনো পূর্ণ সংক্রমণ ঘটায় না। মৌসুমি ফ্লুর ক্ষেত্রেও ভাইরাসের মূল স্ট্রেইন ব্যবহার করে তা পরিপূর্ণ অকেজো করে দেওয়া হয়।
তবে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরির ক্ষেত্রে নতুন ও কম পরীক্ষিত পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে। একে বলা হচ্ছে ‘প্লাগ অ্যান্ড প্লে’ ভ্যাকসিন। কারণ গবেষকেরা ইতিমধ্যে সার্স-কোভ-২ নামের ভাইরাসের জেনেটিক কোড বের করে ফেলেছেন। একে ভাইরাসটির সম্পূর্ণ ব্লুপ্রিন্ট তাঁরা হাতে পেয়েছেন। কিছু ভ্যাকসিনবিজ্ঞানী করোনাভাইরাসের জেনেটিক কোডের কিছু অংশ সরিয়ে অন্যটিতে বসাচ্ছেন, যাতে সম্পূর্ণ নিরীহ ভাইরাস তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে। এখন ওই ভাইরাস দিয়ে কাউকে সংক্রমিত করা হলে তা তত্ত্ব অনুযায়ী, সংক্রমণের বিরুদ্ধে কিছুটা প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে। আরেক দল গবেষক আবার মূল ভাইরাসের জেনেটিক কোডের (ডিএনএ বা আরএনএ) টুকরা ব্যবহার করছেন। এটি শরীরে ইনজেকশন হিসেবে দিলে তা শরীরে ভাইরাল প্রোটিন উৎপাদন শুরু করে, যাতে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করা শিখে নিতে পারে।
চীনের উহানে গত ৩১ ডিসেম্বর অজ্ঞাত কারণে মানুষের নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি শনাক্ত করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। গত ৯ জানুয়ারি নতুন ভাইরাসটির জিনোম সিকোয়েন্স করে চীনের বিজ্ঞানীরা জানান, এটি সার্স রোগ ছড়ানো সার্স-করোনাভাইরাসের গোত্রের। এর দুই দিনের মাথায় নতুন করোনাভাইরাসের সংক্রমণে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এরপর দ্রুতই ভাইরাসটি বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। ১১ মার্চ একে বৈশ্বিক মহামারি ঘোষণা করে সংস্থাটি।
যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয় করোনার সংক্রমণের সার্বক্ষণিক তথ্য প্রকাশ করছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর সিস্টেমস সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের তথ্যমতে, বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ১০ লাখ ৯৯ হাজার ৩৮৯। বিশ্বজুড়ে মৃত মানুষের সংখ্যা ৫৮ হাজার ৯০১, আর সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ইতালিতে, ১৪ হাজার ৬৮১। বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সুস্থ ২ লাখ ২৬ হাজার ৬০৩ জন।
বারবার সাবান দিয়ে ভালোভাবে হাত ধোয়া এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ঘরে থাকা এখন পর্যন্ত এই ভাইরাসের বিস্তার রোধে সবচেয়ে কার্যকর বলে বলা হচ্ছে।