বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড–১৯) নিয়ে আলোচনা এখন মানুষের মুখে মুখে। বিশ্বের বেশির ভাগ অঞ্চলজুড়ে তা মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ায় লোকজনের মধ্যে ভাইরাসটি নিয়ে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। ভাইরাসটির বিস্তৃতি রোধে অনেক দেশ শহর অবরুদ্ধ করেছে। বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলা অবরুদ্ধ করার মতো বড় পদক্ষেপ নিয়েছে। ভাইরাসটির বিস্তার রোধে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নানা সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেওয়ার ওপর জোর দিয়েছে।
বয়স্কদের জন্য ঝুঁকি বেশি থাকলেও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত থেকে রেহাই পাচ্ছে না শিশুরাও। এ অবস্থায় সন্তানদের সুরক্ষায় মা–বাবার জন্য কিছু প্রশ্নের জবাব ও করণীয় ঠিক করেছে জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফ। এর মধ্যে শুরুতে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে নভেল করোনাভাইরাস আসলে কী।
‘নভেল’ করোনাভাইরাস কী?
নভেল করোনাভাইরাস হচ্ছে করোনাভাইরাস গোত্রের একটি নতুন সদস্য। চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে এটি প্রথম শনাক্ত হয়। পরে এই ভাইরাসে আক্রান্তের ফলে সৃষ্ট রোগের নামকরণ হয় কোভিড–১৯। ‘কো’ শব্দটি এসেছে করোনা থেকে, ‘ভি’ ভাইরাস থেকে, ‘ডি’ হচ্ছে ডিজিজ এর প্রথম অক্ষর, আর ২০১৯ সালে ভাইরাসটি সম্পর্কে প্রথম জানা যায় বলে কোভিড শব্দের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘১৯’। গত ১১ মার্চ কোভিড–১৯ কে প্যানডেমিক বা বৈশ্বিক মহামারি ঘোষণা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। তবে প্যানডেমিক ঘোষণা করে ভাইরাসটি কতটা ভয়াবহ তা বোঝানো হয়নি, বোঝানো হয়েছে বিশ্বের ব্যাপক অঞ্চলজুড়ে তা ছড়িয়ে পড়া পরিস্থিতিকে।
অনলাইনে অনেক তথ্য, কী করা উচিত?
অনলাইনে করোনাভাইরাস সম্পর্কে অনেক মিথ ও ভুল তথ্য ছড়িয়ে পড়েছে। কোভিড-১৯ কীভাবে ছড়ায়, কীভাবে নিরাপদ থাকতে হয়, ভাইরাসটির সঙ্গে সংস্পর্শ ঘটার দুশ্চিন্তা থাকলে কী করা উচিত সে সম্পর্কে ভুলভাল তথ্যের অভাব নেই। আর এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে সতর্ক থাকতে হবে আপনি কোথা থেকে তথ্য ও পরামর্শ নিচ্ছেন। ইউনিসেফও কোভিড-১৯ সম্পর্কে তথ্য ও নির্দেশনা–সম্পর্কিত একটি পোর্টাল খুলেছে। এ ছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওয়েবসাইটেও এ নিয়ে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত প্রশ্নের জবাব দেওয়ার জন্য একটি কার্যকরী বিভাগ রয়েছে। আপনার দেশের এবং এলাকার কর্তৃপক্ষের সরবরাহ করা করোনাভাইরাসের সময়ে ভ্রমণ, শিক্ষা এবং অন্যান্য নির্দেশনার সবশেষ সুপারিশ ও সংবাদ আপনি পেতে পারেন সেখানে।
কোভিড-১৯ কীভাবে ছড়ায়?
ভাইরাসটি আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি–কাশির ফোঁটা থেকে, ভাইরাসটি দিয়ে দূষিত যেকোনো বস্তুর উপরিভাগ থেকে ছড়ায়। যেকোনো বস্তুর ওপর ভাইরাসটি কয়েক ঘণ্টা টিকে থাকতে পারে। তবে সাধারণ জীবাণুনাশকও ভাইরাসটিকে মারতে পারে।
করোনাভাইরাসের লক্ষণ কী?
জ্বর, কাশি, ঘন ঘন নিশ্বাস নেওয়া। পরিস্থিতি গুরুতর হলে সংক্রমণের কারণে নিউমোনিয়া ও প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট হয়। ভাইরাসটি খুব কম ক্ষেত্রেই ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে। অসুস্থতার লক্ষণগুলো ইনফ্লুয়েঞ্জা বা ফ্লু ও ঠান্ডা লাগার মতো। এ কারণে কোভিড-১৯ হয়েছে কি না, তা পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হবে। সুরক্ষার বিষয়গুলো একই, এটা মনে রাখা খুব জরুরি। ঘন ঘন হাত ধুতে হবে, হাঁচি-কাশির সময় নাক–মুখ কুনুই দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে বা টিস্যু ব্যবহার করতে হবে। টিস্যুটি পরে ঢাকনাসহ বিনে ফেলতে হবে। ফ্লুর টিকা রয়েছে। তাই নিজের এবং শিশুদের টিকা দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করুন।
সংক্রমণ ঝুঁকি এড়ানোর উপায় কী?
সংক্রমণ থেকে বাঁচতে আপনি নিজের জন্য এবং আপনার পরিবারের জন্য চারটি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে পারেন। সাবান ও পানি বা অ্যালকোহলযুক্ত হ্যান্ড রাব দিয়ে ঘন ঘন হাত ধোন। হাঁচি-কাশির সময় হাতের ভাঁজ করা কুনুই বা টিস্যু দিয়ে নাক-মুখ ঢেকে রাখুন। সঙ্গে সঙ্গে টিস্যু ময়লার বিনে ফেলে দিন। জ্বর বা ঠান্ডা লেগেছে ব্যক্তির কাছাকাছি যাবেন না। আপনি বা আপনার শিশুর জ্বর, কাশি বা শ্বাসকষ্ট হলে দ্রুত চিকিৎসা সেবা নিন।
মেডিকেল মাস্ক কি পরা উচিত?
আপনার হাঁচি-কাশি হলে অন্যদের সংক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য আপনাকে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। যদি কোনো লক্ষণ না থাকে, তাহলে মাস্ক পরার দরকার নেই। মাস্ক ছিঁড়ে গেলে বুঝতে হবে ব্যবহৃত হয়েছিল। ভাইরাস ছড়ানোর ঝুঁকি এড়াতে সেগুলো যথাযথভাবে ফেলে দিন। শুধু মাস্ক ব্যবহার সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য যথেষ্ট নয়। এর সঙ্গে অবশ্যই ঘন ঘন হাত ধুতে হবে। হাঁচি-কাশি দেওয়ার সময় নাক-মুখ ঢাকতে হবে। ঠান্ডা-জ্বর রয়েছে ব্যক্তির কাছ থেকে দূরে থাকতে হবে।
শিশুদের কি কোভিড-১৯ হয়?
এটা নতুন ধরনের ভাইরাস। তাই এটি সম্পর্কে এখনো অনেক কিছু জানা বাকি। শিশু বা অন্তঃসত্ত্বা নারীদের কীভাবে ক্ষতি করে, সে সম্পর্কে আরও জানতে হবে। এখন পর্যন্ত জানা গেছে, ভাইরাসটিতে যেকোনো বয়সের মানুষ আক্রান্ত হতে পারে। তবে এখন পর্যন্ত শিশুদের আক্রান্তের খবর কম পাওয়া গেছে। কিছু ক্ষেত্রে ভাইরাসটি ভয়াবহ, বিশেষ করে বয়স্ক এবং আগে থেকে অসুস্থ ব্যক্তিদের জন্য।
আমার সন্তান কোভিড-১৯ আক্রান্ত হলে কী করব?
অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে, এখন ফ্লুর মৌসুম। ফলে পরিচ্ছন্ন থাকার নিয়ম-কানুন ভালোভাবে মেনে চলতে হবে।
আমার সন্তানকে কি স্কুলের বাইরে রাখা উচিত?
যদি আপনার সন্তানের মধ্যে কোভিড-১৯ লক্ষণ দেখা যায়, তবে তাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান এবং যথাযথ নিয়ম মেনে চলুন। লক্ষণ দেখা দিলে আপনার সন্তানকে বাড়িতেই রাখুন। অন্যদের মধ্যে সংক্রমণ ছড়ানো রোধে জনসমাগমস্থল থেকে দূরে রাখুন। সুস্থ থাকলে স্কুলেই রাখুন। তবে এ ক্ষেত্রে জাতীয় ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা মেনে চলতে হবে। যদি কর্তৃপক্ষ স্কুল বন্ধ করে, তাহলে স্কুল কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশনা মেনে আপনার সন্তানের পড়াশোনা নিশ্চিত করুন। স্কুলের বাইরে থাকা শিশুদের তদারকি নিশ্চিত করাও জরুরি, যাতে তারা কোভিড-১৯ থেকে সুরক্ষিত থাকে। কারণ, নজরদারি না রাখলে অন্যান্য সম্ভাব্য ঝুঁকিরও মুখোমুখি হওয়া লাগতে পারে।
আমার পরিবারের ভ্রমণের সময় কি সতর্কতা নেওয়া উচিত?
যে দেশে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে, সেখানে যাওয়ার আগে সেই দেশের ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা, প্রবেশের পর কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা এবং অন্যান্য বিষয় দেখে নেওয়া জরুরি।
অন্তঃসত্ত্বা নারীর মাধ্যমে গর্ভের সন্তানের কি করোনাভাইরাস হতে পারে?
এ ব্যাপারে এখনো যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি যে অন্তঃসত্ত্বা মায়ের মাধ্যমে গর্ভের সন্তান করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে কি না বা সম্ভাব্য কী ক্ষতি হতে পারে সন্তানের। বিষয়টি নিয়ে গবেষণা চলছে। তবে অন্তঃসত্ত্বা নারীদেরও অন্যদের মতো সতর্ক ব্যবস্থা নিতে হবে।
করোনাভাইরাস আক্রান্ত মা কি সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াতে পারেন?
যেসব মা আক্রান্ত এবং ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় রয়েছেন এবং জ্বর, কাশি ও শ্বাসকষ্টের লক্ষণ রয়েছে, তাঁদের দ্রুত চিকিৎসাসেবা নিতে হবে এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের পরামর্শ মেনে চলতে হবে। মায়ের বুকের দুধের উপকারিতার বিষয়টি বিবেচনা করে এবং শ্বাসকষ্টজনিত অন্য ভাইরাস ছড়ানোর ক্ষেত্রে মায়ের দুধের তেমন কোনো ভূমিকা না থাকায় মা সন্তানকে দুধ খাওয়ানো অব্যাহত রাখতে পারেন। তবে এর আগে অবশ্যই তাঁকে সব সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। লক্ষণ রয়েছে মায়েরাও দুধ খাওয়াতে পারবেন। তবে মাস্ক পরে, হাত ধুয়ে এবং সব ধরনের বস্তুর উপরিভাগ জীবাণুনাশক করার মতো সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।