হাতের কাছে একটা রোবট থাকলে কেমন হয়? ধরা যাক, তার নাম বাহাদুর। মানুষের মতো পুরোপুরি স্বাধীন চিন্তার অধিকারী না হলেও আদেশ পালন করার মতো কিছু যোগ্যতা তার আছে। সব কাজের কাজি হওয়ার তো আর দরকার নেই। জরুরি কয়েকটা কাজ করতে পারলেই হলো। বলা হলো, ‘বাহাদুর, যাও, দোকান থেকে কিছু সদাইপাতি নিয়ে এসো।’
ফর্দ নিয়ে দোকান থেকে ঠিকমতো সব নিয়ে এলো সে। ঘরের বাইরে এমন দরকারি কাজের জন্য একটা রোবট বা যন্ত্রমানব এ সময় পেলে কিন্তু মন্দ হয় না। অন্তত প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ঝুঁকি থেকে অনেকটাই রক্ষা পাওয়া যাবে।
এখন হয়তো কথাটা গল্পের মতো শোনাচ্ছে। তবে এমন রোবটের দেখা পেতে খুব বেশি অপেক্ষা করতে হবে না। জুলভার্নের কল্পকাহিনিতে চন্দ্রপৃষ্ঠে অভিযান একসময় অবাস্তব মনে হলেও এখন কিন্তু আর তা নয়।
কল্পবিজ্ঞানের লেখকেরা বহু আগেই সায়েন্স ফিকশনে যে ভিজিফোনের কথা লিখেছেন, আজকের স্মার্টফোন তো তার চেয়েও এগিয়ে। ভিজিফোনে শুধু আলাপরত ব্যক্তির ছবি ওঠে, স্মার্টফোনে শুধু ছবিই ওঠে না, লাইভ দেখা যায়। বরং এই ফোনে আছে রাজ্যের অ্যাপস, যা দিয়েছে ডিজিটাল ভুবনে স্বচ্ছন্দে বিচরণের সুযোগ।
আইজাক আসিমভের কল্পবিজ্ঞানে রোবটের ছড়াছড়ি। ১৯৪২ সালে তিনি তাঁর একটি গল্পে রোবট নিয়ে তিনটি সূত্রের কথা উল্লেখ করেন। প্রথম সূত্রটি হলো রোবট কখনোই মানুষের ক্ষতি করবে না এবং মানুষকে তার ক্ষতি করতে বাধা দেবে না। পরের দুটি সূত্রও মানুষের অনুকূলে। আসিমভের রোবটরা মানুষের কেবল উপকারই করে গেছে, অপকার নয়।
পরবর্তী সময়ে অবশ্য এই ধারা ঠিক থাকেনি। অনেক লেখক খলচরিত্রে নিয়ে এসেছেন রোবটকে। রোবট যে কত ভয়ংকর হতে পারে, তা দেখা গেছে গত বছর মুক্তি পাওয়া টিম মিলার পরিচালিত ‘টারমিনেটর: ডার্ক ফেইট’ ছবিতে।
তবে রোবট নিয়ে প্রযুক্তিবিদদের আসল ভাবনা কিন্তু মানুষের কল্যাণেই। এর সূত্র ধরে রোবটিক যন্ত্রেরও অনেক উন্নতি ঘটেছে। বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করার মতো যন্ত্রের আবির্ভাব ডিজিটাল জগতে বড় ধরনের পদক্ষেপ বলতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলাইনার স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ অ্যানিটা মনটেস বলেন, কথা শুনে ও বুঝে কাজ করার অ্যাপ সুকি তাঁকে রক্ষা করেছে। এর মাধ্যমে তাঁর ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় বাঁচে। আর এ সময়টা বাঁচায় সে নোট লিখে। কোন রোগীর কী সমস্যা, কী আরজি, সব টুকে রাখে সুকি। তাঁর এ নোট রোগীর সুচিকিৎসায় ভালো কাজ দেয়।
অ্যানিটা মনটেস আরও বলেন, তিনি হয়তো ১২ ঘণ্টার মতো রোগী দেখতে পারেন, কিন্তু কোন রোগীর কী ওষুধ, কী পথ্য, এগুলো লিখতে আরও কয়েক ঘণ্টার ব্যাপার, যা করে দেয় সুকি।
বৈচিত্র–অন্বেষী আর স্বাচ্ছন্দ্যপিয়াসী মানুষ ঠেকে ঠেকে শিখে আজ এত দূর এগিয়েছে। করোনা এসেও আমাদের অনেক কিছু শেখাচ্ছে। বহু রকমের শিক্ষা দিচ্ছে।
ধরা যাবে না, ছোঁয়া যাবে না, থাকতে হবে দূরে—এমন এক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে এই করোনাকালে। বিভিন্ন দেশে চলছে লকডাউন। ভাইরাসটির মরণছোবল ঠেকানোর যেহেতু কোনো ভ্যাকসিন বা ওষুধ নেই, তাই আত্মরক্ষার সবচেয়ে বড় উপায় সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা। সে ক্ষেত্রে ঘরে থাকাটাই শ্রেয়।
কিন্তু ঘরে থাকলেই তো জীবন থেমে থাকবে না। চারপাশে কত কাজ, যার বেশির ভাগই বাইরে। যেতে হয় মানুষের কাছে। সেখানে কতক্ষণই–বা সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা যায়?
মানুষ যখন সামাজিক জীব, কোনো না কোনোভাবে একজনকে আরেকজনের সান্নিধ্যে আসতেই হবে। এমন ভাবনা মাথায় রেখেই গত ফেব্রুয়ারিতে ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক কোম্পানি ক্লাউডমাইন্ডস কিছু রোবট তৈরি করে। চীনের উহানে তখন করোনার মৃত্যুলীলা চরমে। এক্সআর-১ বলে পরিচিত শ খানেক রোবট চীনে পাঠায় তারা। সেখানে এই রোবটগুলোর বেশির ভাগই হাসপাতালে কাজ করেছে।
বিবিসি অনলাইনের প্রতিবেদনে জানানো হয়, কৃত্রিম বুদ্ধমত্তার অধিকারী এসব রোবট রোগীর কাছে দরকারি তথ্য সরবরাহ করেছে। হাসপাতালে দর্শনার্থী এলে সঠিক দিকনির্দেশনা দিয়েছে। এরা বেশ চটপটে। সর্বাধুনিক যোগাযোগপ্রযুক্তি ফাইভ–জি নেটওয়ার্কে যুক্ত থেকে এসব যন্ত্র নিজেদের মতো কাজ করেছে।
ক্লাউডমাইন্ডসের প্রেসিডেন্ট কার্ল ঝাউ বলেন, মানুষের কাছে ব্যাপকভাবে পৌঁছানোর ক্ষমতাসম্পন্ন ফাইভ-জি নেটওয়ার্ক এক্সআর-১ রোবটগুলোর কাজের ক্ষমতা ও পরিধি বাড়িয়ে দেয়। লোকজনের সঙ্গে প্রয়োজন বুঝে কথা বলা, আকার-ইঙ্গিতে বোঝানো—এসব সঠিকভাবে করেছে তারা; এমনকি নেচেছেও। শারীরিকভাবে দিকনির্দেশনা দিয়েছে।
উহান উচাং ফিল্ড হাসপাতালের ডিন ওয়ান জুন বলেন, এসব রোবট আসলে খুবই সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। করোনার প্রাদুর্ভাবের কঠিন সময়ে রোবটগুলো নির্ভরতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে গেছে।
এক্সআর ১ রোবট একদিকে যেমন কর্মীসংকটে সহায়তা করেছে, তেমনি স্বাস্থ্যকর্মীদের সংক্রমণের ঝুঁকি কমিয়েছে।
এএফপির টাটকা খবর হচ্ছে, জাপানের রাজধানী টোকিওর একটি হোটেলকে করোনার হালকা উপসর্গ থাকা রোগীদের কোয়ারেন্টিনে রাখার চিকিৎসাকেন্দ্রে রূপান্তর করা হয়েছে। সেখানে অভ্যর্থনার মতো জনসংযোগে লাগানো হয়েছে ‘পেপার’ নামের একটি হিউম্যানয়েড রোবটকে। সে লোকজনকে অভ্যর্থনা জানায়। বার্তা দেয়, ‘খালি পেটে থাকলে করোনার সঙ্গে লড়তে পারবে না। কাজেই পেট ভরে খেয়ে শক্তি জোগাও।’
মাত্র কয়েক ডজন রোবটের এই সাফল্য করোনার মতো দুঃসময়ে খুব বড় কিছু যে করেছে, তা বলা যাবে না। তবে এটা সুস্পষ্ট ইঙ্গিত যে অদূর ভবিষ্যতে আমাদের স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনের জন্য কোন ধরনের প্রযুক্তি ও যন্ত্র আসছে।
সংবাদমাধ্যমের হালের খবর, আমেরিকায় করোনাভাইরাস ধ্বংসে একদল রোবট নিয়োগ করেছে সেনাবাহিনী। ১৫০টির বেশি ঘাঁটিতে তিন হাজারের বেশি সেনাসদস্য এই ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছে। এখন এসব ঘাঁটি ভাইরাসমুক্ত করতে কাজে লাগানো হচ্ছে রোবট। এসব রোবট চার চাকার ওপর গড়গড়িয়ে চলে। সঙ্গে আছে অতিবেগুনি রশ্মি। যে কাজে একদল মানুষের কয়েক দিন লাগার কথা, সে কাজ মাত্র কয়েক ঘণ্টায় করে দিচ্ছে এসব রোবট।
গত এপ্রিলের শুরুতে বিবিসিসহ সংবাদমাধ্যমে খবর বেরোল, তিউনিসিয়ার রাজধানী তিউনিসে লকডাউন টহলে রোবট নামানো হয়েছে। ফাঁকা রাস্তায় কাউকে দেখলেই রোবট এগিয়ে যাচ্ছে তার কাছে। পরিচয়পত্র দেখতে চাইছে, লকডাউনের সময় বের হওয়ার কারণ জানতে চাইছে। সেটা আবার দূর থেকে মনিটরে দেখছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। সন্তোষজনক কাগজ দেখাতে না পারলে বা সদুত্তর দিতে না পারলেই আইনের প্যাঁচে আটকা। এ ব্যবস্থায় অনেক পুলিশ সদস্য করোনায় সরাসরি সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি থেকে রক্ষা পেয়েছেন।