করোনাকালে প্রকৃতির পৌষ মাস

করোনাভাইরাসের তাণ্ডবের যুগে পুরো পৃথিবীতে বায়ুদূষণ কমে গেছে উল্লেখযোগ্য হারে। কমেছে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাসের তাণ্ডবের যুগে পুরো পৃথিবীতে বায়ুদূষণ কমে গেছে উল্লেখযোগ্য হারে। কমেছে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ। ছবি: রয়টার্স

সারা বিশ্বে এখন আতঙ্ক একটাই—নতুন করোনাভাইরাস। লাখ লাখ মানুষ এখন নতুন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। মারা যাচ্ছে হাজারে হাজার। ঠিক এমন পরিস্থিতিতেই প্রকৃতি যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছে। মানুষ ভুগলেও প্রকৃতি সতেজ রূপে আবির্ভূত হয়েছে।

করোনাভাইরাসের তাণ্ডবের যুগে পুরো পৃথিবীতে বায়ুদূষণ কমে গেছে উল্লেখযোগ্য হারে। কমেছে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ। মাত্রাতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণকেই বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য দায়ী করা হয়। নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইডের উপস্থিতি কমে গেছে ব্যাপক হারে। সম্প্রতি পরীক্ষা করে দেখা গেছে, ভেনিসের খালগুলোর পানি অন্যান্য সময়ের তুলনায় অনেক স্বচ্ছ হয়ে গেছে। চীন, যুক্তরাষ্ট্রের বাতাস আগের চেয়ে তুলনামূলক বেশি বিশুদ্ধ। ইতালি ও দক্ষিণ কোরিয়ার বাতাসেও কমে গেছে দূষিত পদার্থের উপস্থিতি।

এসবের মূল কারণ নতুন করোনাভাইরাস। এশিয়া-ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতে এখন জীবনযাত্রা স্থবির হয়ে আছে। থমকে আছে সব ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। লকডাউন জীবনে মানুষ এখন ঘরবন্দী। এমন অবস্থায় প্রকৃতি আবার ছন্দে ফিরছে। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, গত জানুয়ারি থেকেই চীনের বড় শহরগুলোতে নাইট্রোজেন অক্সাইডের উপস্থিতি কমে গেছে। নাইট্রোজেন অক্সাইড মূলত বিভিন্ন ইঞ্জিন চলার কারণে সৃষ্টি হয়ে থাকে।

প্রতীকী ছবি

কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক বলছেন, চীনে কার্বন ডাই–অক্সাইডের পরিমাণ গত ফেব্রুয়ারিতে ছিল, ২০১৯ সালের একই সময়ের তুলনায় ২৫ শতাংশ কম। পরিমাণগত হিসাবে এটি প্রায় ২০০ মিলিয়ন টন। আবার যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে কার্বন মনোক্সাইডের পরিমাণ কমে গেছে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় অর্ধেক। কারণ, সবাই কোয়ারেন্টিনে চলে যাওয়ায় যান চলাচল গেছে কমে।

টমটম নামের একটি জিপিএস নেভিগেশন প্রতিষ্ঠান দেখিয়েছে, নিউইয়র্কে পিক-আওয়ারে যানজট কমেছে সাড়ে ১৩ থেকে ২৬ শতাংশ পর্যন্ত। একই অবস্থা দেখা গেছে ইতালি ও দক্ষিণ কোরিয়ায়। ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, ইতালির পো ভ্যালি শহরে নাইট্রোজেন-অক্সাইডের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে। ইতালিতে এই শহরটিতেই প্রথম নাগরিকদের বাড়িতে থাকার বাধ্যবাধকতা চালু হয়েছিল।

ইউনিভার্সিটি অব লিচেস্টারের বায়ুদূষণ বিভাগের অধ্যাপক পল মংকস সংবাদমাধ্যম ওয়্যারডকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বায়ুদূষণ কমে যাওয়ায় অ্যাজমা এবং এ ধরনের অন্যান্য রোগে ভোগা মানুষ কিছুটা স্বস্তি পেতে পারে। এতে রোগের বিস্তারও কমে আসবে। কৃষি খাতও এদিক থেকে বেশ উপকৃত হবে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান ব্লুমবার্গএনইএফের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে সৌরবিদ্যুতের প্রতি রাষ্ট্রগুলোর আগ্রহ বেড়ে যেতে পারে। কারণ, জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো করোনাভাইরাসের কারণে পূর্ণ গতিতে চালানো কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে সৌরবিদ্যুতের প্রতি আগ্রহ কিছুটা বাড়তে পারে।

নরওয়ের সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল ক্লাইমেট রিসার্চ অনুমান করছে, যদি চলতি বছর বিশ্বের সার্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ শতাংশ হয়, তবে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ কমবে প্রায় ১ দশমিক ২ শতাংশ। কারণ, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কমে যাওয়ার অর্থ হলো কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ কমে যাওয়া।

এটি ঠিক যে নতুন করোনাভাইরাসের কারণে বেশ বিপদে পড়বে বৈশ্বিক অর্থনীতি। প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার পাশাপাশি মন্দার মুখোমুখি হবে তেল, গ্যাস, এয়ারলাইনসহ বিভিন্ন খাত। এসব কারণে আবার কার্বন নিঃসরণ কম হবে। তবে তা সামগ্রিকভাবে খুব একটা ভালো ফল বয়ে আনবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে।

আমাজন ও অস্ট্রেলিয়ার বনাঞ্চলে যে অগ্নিকাণ্ড কিছুদিন আগে হলো, তার পেছনেও দায়ী জলবায়ু পরিবর্তন। ছবি: রয়টার্স

ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, জলবায়ুর ওপর কোভিড-১৯-এর প্রভাব দুটি অজানা বিষয়ের ওপর নির্ভর করছে। প্রথমত, করোনাভাইরাস মহামারি ঠিক কত দিন চলবে? এই প্রশ্নের উত্তরেই বোঝা যাবে কোয়ারেন্টিন ও লকডাউন আসলে কত দিন চলবে। কিন্তু মহামারি আসলেই কত দিন চলবে, এর কোনো সুনির্দিষ্ট সময়সীমা এখনো অনুমান করা সম্ভব হয়নি। দ্বিতীয়ত, আক্রান্ত দেশগুলোর অর্থনীতি যে মন্দার কবলে পড়ছে, তা থেকে বের হওয়ার জন্য সরকারগুলো কতটা মরিয়া পদক্ষেপ নেবে। এ দুটি বিষয়ই রাজনৈতিক নেতাদের সিদ্ধান্তের ওপর কিছুটা নির্ভরশীল।

অবশ্য অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে ওঠার প্রক্রিয়াটিও পরিবেশের জন্য অনুকূল নয়। ২০০৮ সালে সর্বশেষ অর্থনৈতিক মন্দা দেখেছিল বিশ্ব। ২০০৯ সালে জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো ও সিমেন্টের উৎপাদন থেকে কার্বন ডাই–অক্সাইডের নিঃসরণ কমে গিয়েছিল ১ দশমিক ৪ শতাংশ। কিন্তু এর এক বছর পরই তা প্রায় ৫ দশমিক ৯ শতাংশ বেড়ে যায়। ২০০৩ সালের পর সেটিই ছিল সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণের ঘটনা। ২০১০ সালে এই হার সর্বকালের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এই বিপুল পরিমাণ কার্বন নিঃসরণের দায় বেশির ভাগটাই গেছে চীন, ভারতের মতো উদীয়মান বড় অর্থনীতির দেশগুলোর কাঁধে।

নতুন করোনাভাইরাস স্পষ্টভাবেই মানুষের জন্য একটি ট্র্যাজেডি হয়ে আবির্ভূত হয়েছে। এটি এমন একটি বৈশ্বিক সংকট, যা আরও কিছু সংকটকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। ঠিক যেমনটা জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন। তিনি সম্প্রতি বলেছেন, করোনাভাইরাস একটি অস্থায়ী সংকট। কিন্তু এ নিয়ে ভাবতে গিয়ে যেন তাপদাহ, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসের মতো বছরের পর বছর ধরে চলে আসা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যাগুলো ভুলে না যাই।

অর্থনৈতিক মন্দার কারণে যদি তেলের দাম কমতে থাকে, তবে মানুষ সস্তা জ্বালানি ব্যবহারের সুযোগ পেয়ে তার অপব্যবহার করতে পারে। ফলে জ্বালানির দক্ষ ও সঞ্চয়ী ব্যবহার বাধাগ্রস্ত হবে। ছবিটি সৌদি আরবের একটি তেলখনির। ছবি: এএফপি

নিউইয়র্ক টাইমস বলছে, করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাপী মানুষের ব্যক্তিগত অভ্যাসে পরিবর্তন আনছে। দীর্ঘ দূরত্বে ভ্রমণ, পর্যটন প্রভৃতিতে ভাটা পড়ার আশঙ্কা আছে। এতে বৈশ্বিক জলবায়ুতে কিছুটা ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। কিন্তু ব্যক্তিগত অভ্যাসের পরিবর্তনে কার্বন নিঃসরণ খুব বেশি কমবে না। তবে যদি ভোগের অভ্যাসগত পরিবর্তন ব্যক্তিগত সীমা পার হয়ে বড় বড় ক্ষেত্রেও আসতে শুরু করে, তখন কার্বন নিঃসরণে বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে।

নতুন করোনাভাইরাসের কারণে দেশে দেশে নানা ধরনের অর্থনৈতিক প্রণোদনামূলক ঘোষণা দেওয়া শুরু হয়েছে। কিন্তু সেগুলোতে জলবায়ু নিয়ে ভাবনা খুবই কম। সৌর, বায়ুকল বা অন্যান্য নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রতি কোনো সরকারই তেমন কোনো বরাদ্দ দেয়নি। অর্থাৎ নতুন করোনাভাইরাসের চোখরাঙানি সত্ত্বেও পরিবেশ বাঁচানোর প্রয়োজনীয়তা এখনো রাজনৈতিক নেতারা খুব একটা অনুভব করছেন না।

আবার করোনাভাইরাসের কারণে আপাত সতেজ হয়ে ওঠা প্রকৃতিও ফের বিবর্ণ হতে পারে। ধরুন, অর্থনৈতিক মন্দার কারণে যদি তেলের দাম কমতে থাকে, তবে মানুষ সস্তা জ্বালানি ব্যবহারের সুযোগ পেয়ে তার অপব্যবহার করতে পারে। ফলে জ্বালানির দক্ষ ও সঞ্চয়ী ব্যবহার বাধাগ্রস্ত হবে। জ্বালানির পরিমিত ব্যবহারে তখন মানুষ উৎসাহিত হবে না। আর জ্বালানির অতিরিক্ত ব্যবহার মানেই অধিক কার্বন নিঃসরণ। অন্যদিকে করোনাভাইরাসের কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক নানা গবেষণা। এর অর্থায়নও কিছু কিছু ক্ষেত্রে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। কারণ, অর্থনৈতিক মন্দার কুপ্রভাব সবখানেই প্রতিফলিত হবে। আর করোনাভাইরাসের কারণে জনজমায়েত বন্ধ থাকায় পরিবেশবিষয়ক বিভিন্ন সম্মেলনও থমকে থাকছে। এতে জলবায়ুজনিত গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সিদ্ধান্তও নেওয়া সম্ভব হবে না।

সারা বিশ্বে এখন আতঙ্ক একটাই—নতুন করোনাভাইরাস। লাখ লাখ মানুষ এখন নতুন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। মারা যাচ্ছে হাজারে হাজার। ছবি: রয়টার্স

নতুন করোনাভাইরাসের প্রকোপের দিনগুলোয় কেউ কেউ বলছেন, মানুষই এই পৃথিবীর ব্যাধি। যখনই মানুষ পিছিয়েছে, তখনই প্রকৃতি প্রস্ফুটিত হয়েছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের বক্তব্য শুনতে সাহসী শোনালেও তা সঠিক নয়। কারণ, মানুষও এই প্রকৃতিরই অংশ। মানুষের যেসব কার্যক্রম প্রকৃতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, সেগুলো মানবসভ্যতাকেও ছেড়ে কথা বলে না। সুতরাং, নতুন করোনাভাইরাস প্রকৃতির জন্য ‘ভালো’ কি ‘মন্দ’, সেই ভাবনা ভেবে লাভ নেই। বরং এমন একটি অনন্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রণয়নের কথা চিন্তা করতে হবে, যা পৃথিবীর সব প্রাণকে রক্ষা করবে এবং প্রকৃতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে না। তাতেই প্রাণ-প্রকৃতি উপকৃত হবে। সেই সঙ্গে মানুষও।