রাশিয়ার সরকারব্যবস্থার শীর্ষ পদে ভ্লাদিমির পুতিন আছেন প্রায় ২০ বছর ধরে। বর্তমান সাংবিধানিক নিয়ম অনুযায়ী ২০২৪ সালের পর আর প্রেসিডেন্ট পদে থাকতে পারবেন না সাবেক এই কেজিবি কর্মকর্তা। আর তাই সংবিধান নামের সেই মূল ভিতই বদলে ফেলতে চাচ্ছেন পুতিন। তাঁর এই পদক্ষেপকে অভিহিত করা হচ্ছে ‘সাংবিধানিক ক্যু’ হিসেবে। বলা হচ্ছে, এর মধ্য দিয়ে ভ্লাদিমির পুতিন বাকি জীবনটাও ক্ষমতার শীর্ষে থাকার পরিকল্পনা করছেন।
রাশিয়ার সংবিধানে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এসেছিল সোভিয়েত–পরবর্তী যুগে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর একটি উদার ও পশ্চিমা গণতন্ত্রের মডেলে রাশিয়ার সংবিধান ঢেলে সাজানো হয়েছিল। সেখানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ছিল। সংবিধান ছিল সেক্যুলার, তাতে ধর্মের আনাগোনা ছিল না। প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রীর ওপরে খবরদারিমূলক কোনো সাংবিধানিক কাঠামো ছিল না। বিচারব্যবস্থাকে অন্তত সংবিধানের দৃষ্টিকোণ থেকে সর্বোচ্চ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছিল।
এবার সংবিধানের এসব বৈশিষ্ট্য বদলে ফেলতে চাইছেন ভ্লাদিমির পুতিন। সম্প্রতি এক রাষ্ট্রীয় ভাষণে তিনি রুশ সংবিধান পরিবর্তনের প্রস্তাব তুলেছেন। তবে সরকারের তরফে এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানানো হচ্ছে না। চলতি মাসে রুশ পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে এই প্রস্তাব পাস হয়। এরপর তা জনসমক্ষে আসে এবং রাশিয়ার সরকারনিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম তা নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে। অবশ্য তাতেও পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব জানানো হয়নি। যতটুকু প্রকাশিত হয়েছে, তাতেই অন্য কিছুর গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।
পুতিনের প্রস্তাবে বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। ‘স্টেট কাউন্সিল’ নামের নতুন একটি সংস্থা তৈরির উদ্যোগের কথা জানানো হয়েছে। পুতিন বলছেন, নতুন সংবিধানে সমকামীদের বিয়ের বৈধতা দেওয়া হবে না। একদা কমিউনিস্ট রাষ্ট্রটি সংবিধান পরিবর্তনের মাধ্যমে রুশ চার্চকে বেশি গুরুত্ব দিতে চায়। সেক্যুলার সংবিধানে ঈশ্বরের প্রতি আস্থা প্রকাশ করতে চায়। আবার এর সঙ্গে সঙ্গে পেনশনসহ কিছু সামাজিক নিরাপত্তামূলক পদক্ষেপ নিতেও সংবিধানের পরিবর্তন করতে চান পুতিন।
রুশ সরকার বলছে, সংবিধান পরিবর্তনের এই প্রস্তাব পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষে উত্থাপিত হবে। এরপর তার ওপর গণভোট হবে। আগামী ২২ এপ্রিল এই গণভোটের দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। ওই দিন হ্যাঁ-না ভোটে নির্ধারিত হবে সংবিধানের পরিবর্তন প্রয়োজন কি না।
সম্প্রতি লেভাদা পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, ৪৭ শতাংশ রুশ নাগরিক বিশ্বাস করেন যে নিজে ক্ষমতায় থাকতে এবং এর পরিধি বাড়াতেই পুতিন সংবিধান পরিবর্তনের এই প্রস্তাব এনেছেন। অবশ্য এরপরও ৭২ শতাংশ রুশ পক্ষে আছেন পুতিনের।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ভ্লাদিমির পুতিন আসলে ২০২৪ সাল–পরবর্তী সময় নিয়ে ভাবছেন। বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী ২০২৪ সালের পর আর রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকতে পারবেন না তিনি। এ কারণেই ক্ষমতার উত্তরাধিকার নিয়ে ভাবনা শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে মিখাইল মিশুইস্তিন নামের এক অখ্যাত আমলাকে নিজের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন পুতিন। ধারণা করা হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী পদে থেকে অথবা না থেকেও ক্ষমতার কেন্দ্র পরিচালনা করার বিষয়টি ভাবনায় থাকতে পারে। এ কারণেই নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের পরপরই সংবিধান পরিবর্তনের দিকে যেতে চাইছেন পুতিন।
পুতিনের প্রস্তাবে আরও চমক আছে। নতুন প্রস্তাব অনুযায়ী, রাশিয়া থেকে পালিয়ে অন্য দেশে চলে যাওয়া রুশরা পরিবর্তিত সংবিধান অনুযায়ী আর প্রেসিডেন্ট বা পার্লামেন্ট সদস্য পদে নির্বাচিত হতে পারবে না। নতুন সংবিধান অনুযায়ী, রুশ আইনের ওপর আন্তর্জাতিক আইনের খবরদারি চলবে না। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক আইন মানতে বাধ্য থাকবেন না রুশ আইন-আদালত। আবার আদালত স্বাধীন না থাকলে, বিচারক অদল-বদলে চূড়ান্ত ক্ষমতা হাতে নিতে পারবেন সরকারপ্রধানেরা।
নিন্দুকেরা বলছেন, মূলত পুতিনের বিরোধিতা করায় রাশিয়া ছাড়তে বাধ্য হওয়া ভিন্নমতাবলম্বীদের রুশ রাজনীতিতে ফেরার পথ বন্ধ করে দিতে চাইছে নতুন সংবিধান। আবার দেশে প্রতিকার না পেয়ে যেসব রুশ নাগরিক ইউরোপীয় আদালতে অভিযোগ দায়ের করতেন, তাঁদের সেই চেষ্টাও বিফলে যাবে। কারণ, আন্তর্জাতিক আদালতের কোনো আদেশ আর মানতে বাধ্য থাকবে না রাশিয়া।
গবেষণাপ্রতিষ্ঠান কারনেগি মস্কো সেন্টারের বিশ্লেষক আন্দ্রেই কোলেসনিকভ মনে করেন, পুতিনের সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাবে নানা ধরনের পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে। একদিকে যেমন ক্ষমতা সুসংহত করার বিষয়গুলো রাখা হয়েছে, অন্যদিকে কিছু জনপ্রিয় বিষয় সামনে আনা হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তামূলক যেসব পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে, সেগুলো আসলে জনগণের কাছে জনপ্রিয় হওয়ার জন্যই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যাতে সবারই কিছু না কিছু থাকে। এর মধ্য দিয়ে গণভোটের বিষয়ে আকর্ষণ বাড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এতে করে সংবিধান পরিবর্তনের ক্ষেত্রে আইনি বৈধতা পোক্ত হবে।
পুতিনের দেওয়া ‘স্টেট কাউন্সিল’ ধারণা নিয়ে এরই মধ্যে আলোড়ন শুরু হয়ে গেছে। রাশিয়ার পুতিনবিরোধীরা বলছেন, ২০২৪ সালের পরও যাতে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী থাকা যায়, সেই ব্যবস্থাই করার চেষ্টা করছেন ভ্লাদিমির পুতিন। ধীরে ধীরে প্রধানমন্ত্রী-প্রেসিডেন্টের দপ্তর থেকে নানাবিধ ক্ষমতা স্টেট কাউন্সিলে পাচার করা হতে পারে। যেহেতু পার্লামেন্ট পুরোপুরি পুতিনের নিয়ন্ত্রণে, তাই এ ক্ষেত্রে আইনি বাধা খুব একটা পাওয়া যাবে না। এভাবেই ২০২৪ সালের পর রাশিয়ার ‘সুপ্রিম লিডার’ হিসেবে আবির্ভূত হতে পারেন পুতিন।
রুশ রাজনৈতিক বিশ্লেষক কনস্টানটিন কালাচেভ বলছেন, কমিউনিজমের দেশে এবার ধর্মকে ব্যবহার করে ফায়দা লুটতে চাইছেন পুতিন। তবে বেশির ভাগ রুশ নাগরিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে পুতিনের মতো বলেই মনে করেন তিনি।
সমালোচকেরা বলছেন, পুতিন মূলত স্বরাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা, ন্যাশনাল গার্ড ও গোয়েন্দা দপ্তরের সমন্বয়ে ক্ষমতার একটি কেন্দ্রস্থল তৈরি করেছেন। এরাই পুতিনের হয়ে ক্ষমতা সুসংহত রাখে। সব মিলিয়ে ক্ষমতাকেন্দ্রিক একটি বিশাল চক্র সৃষ্টি হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সব জায়গায় নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখাও কষ্টকর। পুতিনের টিকে থাকা এসব সামাল দেওয়ার ওপরও অনেকটা নির্ভরশীল।
২০২৪ সালের পর ভ্লাদিমির পুতিন সরে যাবেন, নাকি রয়েই যাবেন আরও ক্ষমতাধর হয়ে? এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে তাই অপেক্ষা ছাড়া গত্যন্তর নেই।
তথ্যসূত্র: ফরেন অ্যাফেয়ার্স, ওয়াশিংটন পোস্ট, এএফপি, বিবিসি ও নিউইয়র্ক টাইমস