চীনের দুই সাংবাদিকের কাছ থেকে ভিডিও ফুটেজ পেয়েছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা, পেয়েছে তাদের ডায়েরিও। তাতে করোনার শুরুর দিনগুলোতে উহানের বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে। এক বছরেরও বেশি সময় আগে উহানেই করোনাভাইরাস সংক্রমণের বিষয়টি প্রথমবার শনাক্ত হয়
করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) মহামারিতে পর্যুদস্ত পুরো বিশ্ব। আশার কথা হলো, ইতিমধ্যে কয়েকটি দেশ এই ভাইরাস প্রতিরোধে টিকা তৈরি করেছে। এসব টিকার প্রয়োগও শুরু হয়েছে। চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহানে প্রথম এই রোগে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করা হয়। শুরু থেকেই অভিযোগ উঠেছে, চীনের গাফিলতির কারণে বিশ্বে করোনাভাইরাস ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়েছে।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা গতকাল সোমবার এক প্রতিবেদনে বলেছে, তাদের কাছে এমন ভিডিও ফুটেজ এসেছে, যেখানে উহানে করোনা ছড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে চীন সরকারের গাফিলতি বোঝা যায়। চীনের দুজন সাংবাদিকের কাছ থেকে ওই ভিডিও পেয়েছে আল-জাজিরা। নিরাপত্তার স্বার্থে তাঁদের নাম প্রকাশ করা হয়নি।
ভিডিও ফুটেজ এবং ওই দুই সাংবাদিকের ডায়েরি থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আল–জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনোর শুরুর দিনগুলোতে খুব দ্রুতই উহানের হাসপাতালগুলো রোগীতে ভরে যায়। ‘রহস্যময় রোগে’ মৃত্যুতে মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। গত বছরের ১৯ থেকে ২২ জানুয়ারি পর্যন্ত করা ওই ভিডিও ফুটেজে উহানের হাসপাতালের বাস্তব চিত্র ফুটে ওঠে।
নিরাপত্তার স্বার্থে নাম প্রকাশ না করা ওই সাংবাদিকেরা উহানে লকডাউন ঘোষণার এক দিন আগে সেখানে পৌঁছান। তখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে এক শর মতো রোগী শনাক্তের ঘোষণা দিয়েছিল চীন। ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর তথ্য প্রকাশে কড়াকড়ি আরোপ করেছিল চীনা কর্তৃপক্ষ।
উহানের রোগী ভর্তি হাসপাতাল এবং স্থানীয় হুয়ানান বাজারের ভিডিও ধারণের সময় ওই দুই সাংবাদিক বারবার বাধার মুখে পড়েন। তাঁরা যখন উহানে পৌঁছান, তখনো ভাইরাসের ভয়াবহতার বিষয়ে এবং মানুষের মাধ্যমে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার বিষয়ে নিশ্চিত কোনো তথ্য কর্তৃপক্ষ দিতে পারেনি। আর এ কারণে সেখানকার মানুষ এর ভয়াবহতা আঁচ করতে পারেনি। তারা এটিকে স্বাভাবিক জ্বরের চেয়ে একটু খারাপ মনে করছিল। কিন্তু সার্সের মতো ভয়াবহ কিছু হবে, এটা তারা ভাবেনি।
এক সাংবাদিক তাঁর ডায়েরিতে লিখেছেন, ‘আমি যখন সেখানে পৌঁছাই, মানুষের মধ্যে কোনো ভয় বা উদ্বেগ দেখিনি। অনেকে তো এই রোগের কথাই শোনেনি। এক দোকানি আমাকে মুখের মাস্ক খুলে ফেলতে বলেছিলেন। তিনি আমাকে বলেন, তুমি বেশি ভয় পাচ্ছ। এখানে সব ঠিকঠাক আছে।’
তত দিনে সেখানকার বাজার হুয়ানান বন্ধ করে দিয়েছিল কর্তৃপক্ষ। তখন চীনা কর্তৃপক্ষ ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল খুঁজতে তদন্ত শুরু করে। কিন্তু উহান বা বেইজিং থেকে ভবিষ্যতের ভয়াবহ পরিস্থিতির বিষয়ে কোনো তথ্যই প্রকাশ করছিল না। ফলে সেখানকার নাগরিকেরা ভাইরাসের ব্যাপারে অন্ধকারেই থেকে যায়। তখন পর্যন্ত চীন ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মানুষের মাধ্যমে এই রোগ ছড়ানোর বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারেনি।
সে সময় লাখ লাখ পর্যটক চীনের নববর্ষ উদ্যাপনের জন্য সে দেশ ভ্রমণ করছিলেন। তখন হঠাৎ করে চীন লকডাউনের ঘোষণা দেয়। এরপর চীনা কর্তৃপক্ষের আচরণ মানুষের মধ্যে রাতারাতি আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়। তত দিনে অবশ্য অনেক দেরি হয়ে যায়। কারণ, এর মধ্যেই লাখ লাখ মানুষ দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত ভ্রমণ করে ফেলেছে।
শুরুর দিকে চীন সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব ব্যাপকভাবে দেখা গিয়েছিল। করোনাভাইরাস দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার পেছনে যা অন্যতম কারণ। এক সাংবাদিক তাঁর ডায়েরিতে লেখেন, ‘উহানে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও জনবলের অভাবে অনেক রোগীই চিকিৎসা পাননি। হাসপাতালগুলো সত্য লুকাচ্ছিল। এটি সত্যি হাস্যকর।’
আল–জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, চীনা কর্তৃপক্ষ সাংবাদিকদের কাজে বাধা দিচ্ছিল। রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিকেরাও সংবাদ সংগ্রহের কাজে বাধার সম্মুখীন হন। একজন তাঁর ডায়েরিতে লেখেন, ‘আমি স্বাধীনভাবে প্রতিবেদন করতে পারছিলাম না। আমাকে অনুসরণ করছিল কেউ, এমনকি আমার পেছনে গোয়েন্দাও লাগিয়ে দেওয়া হয়।’
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর থেকে এ পর্যন্ত ৯ জন চীনা সাংবাদিক গ্রেপ্তার বা গায়েব হয়ে গেছেন।
আল–জাজিরার হাতে আসা সাংবাদিকের ডায়েরিতে লেখা, ‘এখানকার মানুষ এখন আর ভাইরাসের বিষয়ে কথা বলতে চায় না। তারা এটিকে ইতিহাস হিসেবে ধরে নিয়েছে। যেটি অনেক আগেই গত হয়েছে। এখানকার মানুষ নিজেদের অনেক ভাগ্যবান ও গর্বিত মনে করে; কারণ, তাদের দেশ ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়েছে।’
ওয়ার্ল্ডোমিটারসের তথ্য অনুযায়ী বিশ্বে এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৯ কোটি ৬১ লাখ ১০ হাজার ২২৫। এখন পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ২০ লাখ ৫২ হাজার ৭৬ জনের। সুস্থ হয়ে উঠেছেন ৬ কোটি ৮৭ লাখ ৭৩ হাজার ৪২ জন।