>
- ভারত-পাকিস্তান সংকট
- ভারতীয় পাইলট মুক্তি পাচ্ছেন আজ
- স্বাগত জানিয়েছে ভারতের সশস্ত্র বাহিনী
- স্বস্তি ফিরেছে দুই দেশের শান্তিপ্রিয় মানুষের মনে
শান্তি স্থাপনে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ‘শুভবুদ্ধি উদয়ের’ ওপর জোর দিয়েছিলেন। তারই রেশ টেনে ভারতীয় বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমান মিগ-২১-এর যুদ্ধবন্দী উইং কমান্ডার অভিনন্দন বর্তমানকে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল পাকিস্তান। দেশটির প্রধানমন্ত্রী নিজেই গতকাল বৃহস্পতিবার বলেছেন, আজ শুক্রবার অভিনন্দনকে মুক্তি দেওয়া হবে। তাঁর এই ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে ভারতের সশস্ত্র বাহিনী।
যুদ্ধ পরিস্থিতিতে গতকাল দেশের সংসদে ভাষণ দেন ইমরান খান। সেখানেই তিনি বলেন, ‘বুধবার আমি ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করার চেষ্টা করেছিলাম। ফোন করতে চাইছিলাম এ কথা বলতে যে আমরা পরিস্থিতি জটিল করে তুলতে চাই না। শান্তি চাই। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে আমরা ভীত।’ এরপরেই ইমরান বলেন, ‘আমাদের হাতে একজন ভারতীয় পাইলট বন্দী রয়েছেন। আমরা যে শান্তি চাই, সেই নিদর্শন হিসেবে কাল (শুক্রবার) আমরা তাঁকে মুক্তি দেব।’
পরপর দুদিনের অঘোষিত আকাশযুদ্ধের পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে গতকাল সীমান্ত উত্তেজনা ছিল যথেষ্ট কম। নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর পরিস্থিতি থমথমে থাকলেও সামান্য কিছু সময় বাদ দিলে বড়সড় কোনো আগ্রাসী মনোভাব দেখায়নি কোনো পক্ষ। এরই মধ্যে বিকেলে অভিনন্দনকে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত দুই দেশের শান্তিপ্রিয় মানুষের মনে স্বস্তি এনে দেয়। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর এই সিদ্ধান্ত স্বস্তিদায়ক আন্তর্জাতিক মহলের কাছেও, যারা ক্রমাগত এই দুই দেশকে সংযত হওয়ার পরামর্শ দিয়ে আসছে।
যেমন যুক্তরাষ্ট্র। কাশ্মীরের পুলওয়ামায় ভারতের আধা সামরিক বাহিনী সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্সের (সিআরপিএফ) গাড়িবহরে জঙ্গি হামলার পর এবং পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে জঙ্গি আস্তানায় ভারতের যুদ্ধবিমানের অভিযানের আগে যুক্তরাষ্ট্র বলেছিল, আত্মরক্ষার্থে ভারতের প্রত্যাঘাতের অধিকার আছে। এরপর ভারত প্রত্যাঘাত করে। তবে তার আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্র দুই দেশকে সংযত হওয়ার কথা বলেছিল। একই কথা বলেছে পাকিস্তানের বন্ধুদেশ চীনও। ভারতের বিরুদ্ধে চীন নিন্দাসূচক কোনো মন্তব্যও করেনি। যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, ফ্রান্স, কানাডাও শান্তি রক্ষার কথা বলেছে। সেই দিক থেকে বন্দী মুক্তি দিয়ে ইমরানের এই শান্তির বার্তা তাৎপর্যপূর্ণ। এরপর ভারতের জন্য আবারও প্রত্যাঘাত করা কঠিন।
শান্তির পথে পা বাড়াতে এমন কিছু একটা যে হতে চলেছে, তার ইঙ্গিত গতকাল ভোরেই চলে আসে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভিয়েতনামের হ্যানয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিদ্যমান উত্তেজনা কমবে। ভালো কিছু খবর আসতে চলেছে। দুই দেশ উত্তেজনা বাড়িয়ে যাচ্ছিল আর আমরা ওদের সংযত হতে বলছিলাম।’
আচরণ যে সংযত হতে চলেছে, তার ইঙ্গিত গতকাল সকাল থেকেই পাওয়া যায়। কোনো দেশের নেতাই উত্তেজক কোনো বিবৃতি দেননি। সামান্য সময়ের জন্য গুলিবিনিময় চলে ভোরে, কাশ্মীরের পুঞ্চ জেলার কৃষ্ণাঘাঁটি এলাকায়। নিয়ন্ত্রণরেখার দুধার থেকে দুই পক্ষে গুলিবিনিময় হলেও ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তা থেমে যায়। দুই দেশের কেউই হতাহত বা ক্ষয়ক্ষতির কোনো অভিযোগ বা দাবি করেনি।
দুই দেশের সর্বশেষ সংকটের শুরু গত ১৪ ফেব্রুয়ারি। ওই দিন ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পুলওয়ামায় দেশটির আধা সামরিক সিআরপিএফের গাড়িবহরে আত্মঘাতী হামলায় ৪০ জওয়ান নিহত হন। পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন জইশ-ই-মুহাম্মদ এ হামলার দায় স্বীকার করে। ওই ঘটনার ১২ দিন পর গত মঙ্গলবার ভোরে পাকিস্তাননিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের বালাকোটে বিমান হামলা চালায় ভারত। পরদিন দুই দেশের সেনাদের মধ্যে কাশ্মীর সীমান্তে গোলা ও গুলিবিনিময় হয়। বুধবার সকালে বালাকোটে হামলার বদলা নেয় পাকিস্তান। এরপর আকাশযুদ্ধে ভারত হারায় দুটি যুদ্ধবিমান। পাকিস্তান বাহিনীর হাতে বন্দী হন দেশটির এক পাইলট। আর পাকিস্তান হারায় একটি যুদ্ধবিমান।
এই অবস্থায় সব ছাপিয়ে বুধবার দুপুর থেকে হঠাৎই বড় হয়ে উঠেছিল পাইলট অভিনন্দন বর্তমানের বন্দী হওয়ার বিষয়টি। মারমুখী স্থানীয় লোকজনের হাত থেকে রক্তাক্ত অভিনন্দনকে উদ্ধার করে পাকিস্তান বাহিনী তাঁকে আটক করে। এই খবর চাউর হতেই গোটা ভারতে তাঁর মুক্তির দাবিতে জনমত তীব্র হতে থাকে। অন্য সবকিছু ছাপিয়ে অভিনন্দনের দ্রুত প্রত্যাবর্তনই হয়ে দাঁড়ায় মূল বিষয়। পাকিস্তানের উপহাইকমিশনারকে ডেকে পাঠিয়ে ভারত জানিয়ে দেয়, যথাশিগগির সম্ভব সুস্থ অবস্থায় অভিনন্দনকে ফেরত পাঠানো হোক। একই সঙ্গে পাকিস্তানকে জেনেভা চুক্তির কথাও ভারত মনে করিয়ে দেয়, যেখানে যুদ্ধবন্দীদের মর্যাদা, মানবাধিকার রক্ষা ও দ্রুত প্রত্যাবর্তন সম্পর্কিত রূপরেখা নির্দিষ্ট করা আছে। যুদ্ধ যুদ্ধ আবহে বড় হয়ে ওঠে অভিনন্দনের মুক্তি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র বলেছে, অভিনন্দনের মুক্তির জন্য পাকিস্তানের সঙ্গে কোনোভাবেই কোনো বোঝাপড়ায় ভারত যাবে না। অবিলম্বে তাঁকে নিঃশর্তে ও নিরাপদে মুক্তি দিতে হবে। ভারতের পক্ষে স্বস্তির বিষয়, সেই মুক্তি আসন্ন প্রায়।
ইমরান খান বুধবারই আলোচনায় বসার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, এখনই সক্রিয় না হলে পরিস্থিতি তাঁর অথবা নরেন্দ্র মোদি—কারও হাতে থাকবে না। সেই প্রস্তাবের রেশ ধরে পাকিস্তানের জিয়ো টিভিতে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কুরেশি বলেন, সংঘাত বাড়ানোর অভিপ্রায় নেই বলেই ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় বসার আগ্রহ দেখিয়েছেন ইমরান খান। কিন্তু সেই আহ্বানে সাড়া দেওয়ার মতো কোনো ইঙ্গিত গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ভারত দেয়নি। অভিনন্দনকে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েও কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
তবে গতকাল সন্ধ্যায় নয়াদিল্লিতে যৌথ সংবাদ ব্রিফিংয়ের আয়োজন করে ভারতের সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী। এ সময় পাইলটকে মুক্তি দেওয়ার ব্যাপারে পাকিস্তানের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানান এয়ার ভাইস মার্শাল আর জি কে কাপুর। তিনি বলেন, ‘ভারতীয় বিমানবাহিনী খুশি এবং তাঁর প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় রয়েছে।’
তবে ভারতীয় সেনাবাহিনীর মুখপাত্র মেজর জেনারেল সুরিন্দর মহল বলেন, ‘পাকিস্তান আমাদের সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে। তারা পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে। তারা যদি উসকানি দেয়, তাহলে আমরাও পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুত রয়েছি।’
এদিকে, ভারতে আগামী মে মাসে অনুষ্ঠেয় লোকসভা নির্বাচন নিয়ে গতকাল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁর দল বিজেপির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্স করেন। ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা এবং পাকিস্তান বাহিনীর হাতে পাইলট বন্দী হওয়ার এই পরিস্থিতির মধ্যে মোদি ওই ভিডিও কনফারেন্স করায় তাঁর সমালোচনা করছেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী আম আদমি পার্টির নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল, বহুজন সমাজ পার্টির নেতা ও উত্তর প্রদেশের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মায়াবতীসহ বিরোধী রাজনীতিকেরা।
এদিকে গতকাল মধ্যরাত পর্যন্ত দেশটির আকাশসীমা বন্ধ থাকার কথা জানিয়েছে পাকিস্তানের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (সিএএ)। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চলাচলকারী সমঝোতা এক্সপ্রেস ট্রেনের যাতায়াত পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছে ইসলামাবাদ।