আমাদের বিশ্ব আগের চেয়ে আরও বেশি সংযুক্ত

বিদায় নিচ্ছে ২০২১। করোনা মহামারিসহ নানা কারণে ঘটনাবহুল ছিল বছরটি। তবে কঠিন সংকটের মধ্যেও এ বছর গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু বিষয়ে অগ্রগতি হয়েছে। এ বিষয়ে নিজের ব্লগ ‘গেটসনোট’-এ গত মঙ্গলবার পর্যালোচনা তুলে ধরেছেন মাইক্রোসফটের সহপ্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস। পাশাপাশি ২০২২ সাল নিয়ে আশার কথা শুনিয়েছেন তিনি। আজ প্রথম পর্ব

  • বৈশ্বিক বড় সমস্যাগুলো মোকাবিলা করার জন্য নানা দেশ ও খাতের মানুষকে একসঙ্গে কাজ করতে হয়—বিষয়টি আগে কখনোই এতটা স্পষ্ট ছিল না।

  • অবিশ্বাস্য কঠিন এক বছর ছিল ২০২১ সাল, আমিসহ অনেকের উপলব্ধিই এমন। কিন্তু আমি আশাবাদী, ২০২২ সাল অপেক্ষাকৃত ভালো হবে।

  • এ বছর অন্যতম ভালো খবর হলো, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রথমবারের মতো ম্যালেরিয়ার টিকার অনুমোদন দিয়েছে।

বিল গেটস

পল অ্যালেন ও আমি যখন মাইক্রোসফট শুরু করছিলাম, তখন আমাদের একটি স্বপ্ন ছিল। সেটা হলো, ব্যক্তিগত কম্পিউটার একদিন মানুষের জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। কিন্তু আমি মনে করি না যে আমরা কেউই এমন একটি ভবিষ্যতের পূর্বাভাস দিয়েছি, যেখানে সেটাই হবে বিশ্বের সঙ্গে আপনার একমাত্র সংযোগমাধ্যম। অনেক মানুষের মতো এ বছর এমন সব দিন গেছে, যেখানে আমার সব ধরনের যোগাযোগ হয়েছে একটি স্ক্রিনের মাধ্যমে।

ফলে এটা আমার জীবনের সবচেয়ে অস্বাভাবিক ও কঠিন বছর হয়ে ওঠে। (ধারণা করছি, এই লেখা পড়ে অনেকেই একই কথা বলতে পারেন)। কোভিড-১৯ সবকিছুকে ওলটপালট করে দেওয়ার আগে ২০২০ সালে অপেক্ষাকৃত স্বাভাবিকতার একটি সংক্ষিপ্ত সময় ছিল। ২০২১ সালের প্রথম দিন থেকেই মহামারি আমাদের জীবনে আধিপত্য বিস্তার করেছে। আমাদের সবাইকে একটি ‘নতুন স্বাভাবিকের’ সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হয়েছে। যদিও তা দেখতে কেমন, সেটি প্রত্যেক ব্যক্তির ক্ষেত্রে আলাদা। আমার ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে, বছরটির বেশির ভাগই অনলাইনে কাটিয়েছি।

আমি মানুষের সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ ছাড়াই বিরামহীনভাবে সময় পার করেছি। আমি যদি মিটিংয়ের মধ্যে বিরতি পেতাম, তাহলে ভিন্ন কিছু দেখার জন্য আমার বাড়ির ফাঁকা জায়গায় ঘুরে বেড়াতাম। কাজের পরে আমি অনলাইনে বন্ধুদের সঙ্গে ব্রিজ খেলতাম বা ভিডিও চ্যাটের মাধ্যমে তাঁদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম। টিকা নেওয়ার পর আমি কিছু ছোটখাটো মিলনমেলায় সশরীর যাওয়া শুরু করি। কিন্তু আমার সামাজিক জীবন এখনো আগের চেয়ে অনেক বেশি ডিজিটাল।

এটা একটা অদ্ভুত ও বিভ্রান্তিকর অভিজ্ঞতা। গত ১২ মাসে আমার ব্যক্তিগত জগৎ যতটা ছোট মনে হয়েছে, তা আগে কখনো মনে হয়নি।

২০২২ সালে যে চারটি বিষয় আমার মনে গুরুত্বের শীর্ষে থাকবে, সেগুলো সম্পর্কে লিখতে চেয়েছিলাম: কোভিড-১৯ মহামারি অবসানের ক্ষেত্রে সর্বশেষ অগ্রগতি; কেন প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থা হ্রাস আমাদের চলার পথে সবচেয়ে বড় বাধা হতে পারে; জলবায়ু আলোচনা আমাদের অগ্রগতি সম্পর্কে কী শিক্ষা দিতে পারে; এবং মহামারির দ্বারা হওয়া দ্রুত ডিজিটাইজেশন কীভাবে আমাদের ভবিষ্যৎ গঠন করবে।

একই সময়ে এই বছর এ কথাও মনে করিয়ে দিয়েছে যে আমাদের পৃথিবী আগের চেয়ে আরও বেশি সংযুক্ত। চরম আবহাওয়া, মহামারির চলমান প্রভাব, আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে যাওয়াসহ নানা বৈশ্বিক ঘাত–প্রতিঘাতের ঘটনায় পরিপূর্ণ ছিল ২০২১ সাল। প্রতিবার আপনি যখন খবরের দিকে তাকিয়েছেন, আপনাকে মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে যে বিশ্বের অন্য প্রান্তে ঘটে চলা তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাগুলো কীভাবে আপনার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে (শুধু দেখুন, কীভাবে একটি কনটেইনারবাহী জাহাজ এক সপ্তাহ ধরে সুয়েজ খালে আটকে থাকার কারণে সারা বিশ্বে শিপিং বিলম্বিত হয়েছে)। বিষয়টি কখনোই এতটা স্পষ্ট ছিল না যে বড় সমস্যাগুলো মোকাবিলা করার জন্য নানা দেশ ও খাতের মানুষকে একসঙ্গে কাজ করতে হয়।

শিশুদের করোনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। চীনের পূর্ব ঝেজিয়াং প্রদেশের নিংবোতে

এ বছর আমার কাজের ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত প্রতিপাদ্য হয় সহযোগিতা। আমার বেশির ভাগ সময় ফাউন্ডেশনের পেছনে ব্যয় করে চলছি। ২০২১ সালে আমাদের দল ও অংশীদারদের অর্জন করা আশ্চর্যজনক অগ্রগতি দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি। যাঁরা আমাদের কোভিড সাড়া নিয়ে কাজ করছেন, তাঁদের প্রত্যেকের সঙ্গে বেশির ভাগ সপ্তাহে আমাদের ভার্চ্যুয়াল মিলনমেলা হয়। প্রতিটি মিটিংয়ে একটি ভিন্ন বিষয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। যেমন: রোগের মডেলিং বা টিকা বিতরণ। বিভিন্ন গ্রুপ কীভাবে সমাধান খুঁজে পেতে একত্রে কাজ করছে, তা শোনাটা অনুপ্রেরণাদায়ক।

যদিও কোভিড-১৯ একটা বড় গুরুত্ব পেয়েছে, তা সত্ত্বেও ফাউন্ডেশন অন্যান্য ক্ষেত্রে তার অগ্রগতি অব্যাহত রেখেছে। আমাদের মার্কিন কর্মসূচি মহামারি যুগের শিক্ষার অদ্ভুত নতুন বিশ্বে কার্যক্রম পরিচালনায় ছাত্র ও শিক্ষকদের সাহায্য করার জন্য অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করছে। আর আমার যে সহকর্মীরা লিঙ্গসমতা নিয়ে কাজ করছেন, তাঁরা আরও ন্যায়সংগত বিশ্ব পুনর্গঠনের জন্য লড়াই করছেন।

বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ও উন্নয়ন দলগুলো পোলিও, টিবি, এইচআইভির মতো রোগের ক্ষেত্রে অর্জিত অগ্রগতি রক্ষা এবং শিশুমৃত্যুর হার কমানোর অগ্রগতি অব্যাহত রাখার জন্য সৃজনশীল সব উপায় খুঁজে পেয়েছে। (আশঙ্কা অনুযায়ী মহামারি কীভাবে অতটা বাজেভাবে আমাদের ক্ষতি করতে পারেনি, তা এ বছরের গোলকিপার্স রিপোর্টে উঠে এসেছে) সবচেয়ে উদ্দীপনার যে বিষয়গুলো ঘটেছে, তার মধ্যে একটি হলো, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) প্রথম ম্যালেরিয়ার টিকার অনুমোদন দিয়েছে। ম্যালেরিয়ায় প্রতিবছর প্রায় ৬ লাখ ৫০ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। যাদের অর্ধেকের বেশি পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু। ম্যালেরিয়া এখনো নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে রয়ে গেছে। আমরা ২০০১ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে টিকার শেষ পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল উন্নয়নের জন্য অর্থায়ন করেছি। কীভাবে এটির কার্যকারিতা বাড়ানো যায়, সে বিষয়ের গবেষণাকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছি। কীভাবে দ্বিতীয় প্রজন্মের টিকা তৈরি করা যায়, কীভাবে প্রতিরোধমূলক সরঞ্জাম তৈরি করা যায়, যা সব বয়সীদের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে, যা আরও বেশি কার্যকর, যা রোগ নির্মূলের লক্ষ্যে পৌঁছাতে আমাদের সাহায্য করতে পারে, সে সম্পর্কে এই নতুন টিকা আমাদের অন্তর্দৃষ্টি জোগাচ্ছে।

এ বছর আমার জলবায়ু-সংক্রান্ত কাজের একটি নতুন অধ্যায়েরও সূচনা হয়েছে। আমি আমার কীভাবে জলবায়ু বিপর্যয় এড়ানো যায়’ শীর্ষক বই প্রকাশ করেছি। নতুন ক্লিন-এনার্জি প্রযুক্তিতে অর্থায়ন, উৎপাদন, কেনাকাটায় সহায়তার জন্য ব্রেকথ্রু এনার্জি ক্যাটালিস্ট ও ফেলো প্রোগ্রাম চালু করেছি। আমাদের প্রচেষ্টাকে উল্লেখযোগ্যভাবে সম্প্রসারিত করার জন্য আমার যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী বোধ করার কারণ হলো, ব্রেকথ্রু এনার্জি ভেঞ্চারস থেকে আমি অবিশ্বাস্য অগ্রগতি দেখেছি, যেখানে আমরা এখন ৭০টির বেশি বিস্ময়কর কোম্পানিকে সমর্থন দিচ্ছি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) প্রথম ম্যালেরিয়ার টিকার অনুমোদন দিয়েছে। ম্যালেরিয়ায় প্রতিবছর প্রায় ৬ লাখ ৫০ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। যাদের অর্ধেকের বেশি পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু।

আমি দীর্ঘদিন ধরে জলবায়ু ও এনার্জি ইস্যু নিয়ে কাজ করছি। কিন্তু গত ১২ মাসে এই ক্ষেত্র আমার গুরুত্বের একটি বড় অংশ হয়ে উঠেছে। আমি কিছু নন-ফাউন্ডেশন এবং জলবায়ুর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়—এমন ক্ষেত্রে কাজ করার জন্যও সময় পেয়েছি। যেমন আলঝেইমার গবেষণা ও শিক্ষকদের জন্য বিনা মূল্যে শিক্ষাসংক্রান্ত সম্পদের প্রসার।

যদিও আমি মনে করি, যে বিষয়গুলো নিয়ে আমি কাজ করছি, তা আমার বছরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক। তবে আমি জানি, অনেক লোক আমার বিবাহবিচ্ছেদের বিষয় সম্পর্কে কৌতূহলী। মেলিন্ডা ও আমি একসঙ্গে আমাদের ফাউন্ডেশন চালিয়ে যাচ্ছি। একটি ভালো নতুন কাজের ছন্দ পেয়েছি। তবে আমি অস্বীকার করতে পারি না যে এটি আমার জন্য একটি বড় ব্যক্তিগত বেদনার বছর। পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া কখনোই সহজ নয়, তা যা-ই হোক না কেন। এই চ্যালেঞ্জিং সময়ে আমার প্রিয়জনেরা, বিশেষ করে আমার সন্তানেরা কতটা পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারছে, তা দেখে আমি ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত হয়েছি।

আপনি সম্ভবত খবরে যা দেখেছেন, তার বাইরে আমার পরিবারও অনেক পরিবর্তনের মুখোমুখি হয়েছে। আমার বড় মেয়ে জেনিফার এই শরতে বিয়ে করেছে। তার বিয়ে আমার জন্য বছরের উজ্জ্বলতম বিষয় ছিল। আমাদের সবচেয়ে ছোট মেয়ে ফোবি হাইস্কুল শেষ করে কলেজে গেছে। যেহেতু আমার ছেলে ররিও দূরে, তার মানে আমি আনুষ্ঠানিকভাবে একা। সারাক্ষণ একদল কিশোর-কিশোরীর উপস্থিতি ছাড়া বাড়িটি অনেকটা নিরিবিলি। আজকাল বই পড়া বা কাজ করায় মন দেওয়া সহজ হলেও আমি বাড়িতে তাদের অনুপস্থিতি অনুভব করি।

এ বছর আমার জলবায়ু-সংক্রান্ত কাজের একটি নতুন অধ্যায়েরও সূচনা হয়েছে।আমাদের প্রচেষ্টাকে উল্লেখযোগ্যভাবে সম্প্রসারিত করার জন্য আমার যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী বোধ করার কারণ হলো, ব্রেকথ্রু এনার্জি ভেঞ্চারস থেকে আমি অবিশ্বাস্য অগ্রগতি দেখেছি, যেখানে আমরা এখন ৭০টির বেশি বিস্ময়কর কোম্পানিকে সমর্থন দিচ্ছি।

২০২১ সাল আমার জন্য একটি বড় পরিবর্তনের বছর। কিন্তু আমি যে কাজটি করি, তা কেন ভালোবাসি, সেটার পরিবর্তন হয়নি। বছর শেষ হয়ে আসায় আমি বসতে চেয়েছিলাম। ২০২২ সালে যে চারটি বিষয় আমার মনে গুরুত্বের শীর্ষে থাকবে, সেগুলো সম্পর্কে লিখতে চেয়েছিলাম: কোভিড-১৯ মহামারি অবসানের ক্ষেত্রে সর্বশেষ অগ্রগতি; কেন প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থা হ্রাস আমাদের চলার পথে সবচেয়ে বড় বাধা হতে পারে; জলবায়ু আলোচনা আমাদের অগ্রগতি সম্পর্কে কী শিক্ষা দিতে পারে; এবং মহামারির দ্বারা হওয়া দ্রুত ডিজিটাইজেশন কীভাবে আমাদের ভবিষ্যৎ গঠন করবে।

(চলবে)

  • ভাষান্তর: সাইফুল সামিন