‘আমাদের পরিচয় ছিল শুধু একটি নম্বর’

কানাডার এই পরিত্যক্ত স্কুলে সন্ধান পাওয়া গেছে শিশুদের গণকবর।
ফাইল ছবি: রয়টার্স

জিমি পাপাতির বয়স তখন পাঁচ বছর। সময়টা ১৯৬৯ সাল। পরিবারের সঙ্গে কানাডার একটি গ্রামীণ এলাকায় বসবাস করতেন অ্যালগোনকুইন জাতিগোষ্ঠীর জিমি। হঠাৎ একদিন বাড়ির সামনে একটি বাস আসে। তাতে জিমির শৈশব আমূল বদলে যায়। পরিবারের অমতে সরকারের লোকজন জোর করে বাসে উঠিয়ে তাঁকে মন্ট্রিল থেকে ৬০০ কিলোমিটার দূরের সেন্ট-মার্ক-দে-ফিগুইরি বোর্ডিং স্কুলে নিয়ে ভর্তি করেন। এর চার বছর পর স্কুলটি বন্ধ হয়ে যায়। তখন পর্যন্ত জিমি সেখানেই ছিলেন।

এখন জিমির বয়স ৫৭ বছর। আগের সেই বোর্ডিং স্কুলের জায়গায় দাঁড়িয়ে বার্তা সংস্থা এএফপিকে নিজের জীবনের সেই তিক্ত অভিজ্ঞতার গল্প শোনালেন জিমি। তিনি বলেন, ‘মুহূর্তের মধ্যে আমাকে আমার মূল থেকে উপড়ে ফেলা হয়েছিল।’

জিমি একা নন, ওই সময় কানাডায় তাঁর মতো আরও প্রায় দেড় লাখ শিশুকে একই পরিণতি ভোগ করতে হয়েছিল। পরিবার, জন্মস্থান ও নিজস্ব সংস্কৃতি থেকে জোরপূর্বক ধরে এনে ১৩৯টি আবাসিক বিদ্যালয়ে তাঁদের ‘কানাডার সংস্কৃতি’ শিখতে বাধ্য করা হয়েছিল। এর ফলাফল ছিল ভয়াবহ। রোগ-শোক-অপুষ্টিতে হাজারো শিশু প্রাণ হারায়।

অনেকে শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। কানাডায় এমন শিশুদের ১ হাজার ২০০-এর বেশি গণকবরের সন্ধান পাওয়া গেছে। পুরো একটি প্রজন্মের কাছে এসব ঘটনার মানসিক ভীতি এখনো রয়ে গেছে। ২০১৫ সালে কানাডা সরকারের একটি সত্যানুসন্ধান কমিটি এসব ঘটনাকে ‘সাংস্কৃতিক গণহত্যা’ হিসেবে চিহ্নিত করে। চলছে আলোচনা-সমালোচনা।

জিমি বলেন, কয়েক দশক আগে ঘটলেও এসব ঘটনা নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলার সময় এসেছে। স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে জিমি বলেন, ‘ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিশুদের চুল বড় থাকে। স্কুলে পৌঁছেই আমাদের চুল ছেঁটে ফেলা হয়। ঐতিহ্যবাহী পোশাক ছেড়ে ইউনিফর্ম পরতে বাধ্য করা হয়। শিক্ষক ও কর্মকর্তারা ফরাসিতে কথা বলতেন। আমরা ফরাসি জানতাম না। নিজস্ব ভাষায় কথা বলা নিষিদ্ধ ছিল। প্রতিনিয়ত গালিগালাজ করা হতো। আমাদের পরিবারের দেওয়া নাম বাতিল করা হয়। আমাদের পরিচয় ছিল শুধু একটি নম্বর।’

ভুক্তভোগী শিশুদের সঙ্গে ঘটা প্রতিটি ঘটনা, আমাদের প্রত্যেককেই লজ্জা দেয়।
জাস্টিন ট্রুডো, কানাডার প্রধানমন্ত্রী

ওই সময়ের ভুক্তভোগী ফ্রেড কিসতাবিশের বয়স এখন ৭৭ বছর। তিনি বলেন, ‘আমি তখন ফ্রেড ছিলাম না। ছিলাম ৭০ নম্বর শিশু।’ কানাডার মোট জনসংখ্যার মাত্র ৫ শতাংশ এখন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর। অথচ এসব জাতিগোষ্ঠীর শিশুদের ‘মূলধারায়’ আনতে বিংশ শতকের মাঝামাঝি দেশটিতে সরকার ও ক্যাথলিক গির্জার উদ্যোগে এসব বোর্ডিং স্কুল গড়ে ওঠে। চলেছে আশির দশক পর্যন্ত। এসব স্কুলের মূল লক্ষ্য ছিল: তাঁদের শিক্ষিত করা, রূপান্তর করা এবং আত্তীকরণ করা। ফ্রেড বলেন, ‘তারা আমাকে বদলে ফেলতে চেয়েছিল। কিন্তু পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।’

ফ্রেড একটি মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার গল্প শোনান। তিনি বলেন, ‘স্কুলে আমার বোনদের ধরে আনা হয়। কিন্তু আমরা একে অপরের সঙ্গে দেখা করতে, কথা বলতে পারতাম না। একদিন হঠাৎ ক্যাফেটেরিয়ায় আমার বোনদের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। এ সময় আমরা কেঁদে ফেলি। আমাদের জীবন খুব কঠিন ও নিঃসঙ্গ ছিল। তারা আমার শৈশব কেড়ে নিয়েছে।’

৬ থেকে ১৩ বছর বয়স পর্যন্ত একটি বোর্ডিং স্কুলে কাটান অ্যালিস মোয়াট। পরে তিনি একটি নোটবুকে ওই সময়ের অভিজ্ঞতা লিখে রাখেন। ৭৩ বছর বয়সী এই নারী লিখেছেন, ‘বোনদের সঙ্গে আমাকেও বোর্ডিং স্কুলে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে গিয়ে বয়সের ভিত্তিতে আমাদের আলাদা করা হয়। আমি একা হয়ে যাই। তখন আমার বয়স ৬। আমি ফরাসি জানতাম না। আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন মুহূর্ত ছিল সেটা।’ তিনি জানান, বোর্ডিং স্কুলে গিয়ে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর অনেকেই নিজেদের ভাষা ভুলে গেছে।’

টরন্টোর দক্ষিণাঞ্চলীয় ব্র্যান্টফোর্ডের একটি বোর্ডিং স্কুলে পড়তেন ডাউন হিল। তাঁর বয়স এখন ৭২ বছর। ওই সময়ের স্মৃতি সম্পর্কে অবসরপ্রাপ্ত এই শিক্ষক বলেন, ‘এসব ভাবলে এখনো আমার চোখ ভিজে যায়। আমাদের জীবনটা কুকুর-বেড়ালের মতো ছিল। যখন আপনার চারপাশে সারাক্ষণ ভয়ের উপাদান থাকবে, তখন আপনি চাইলেও নিরাপদ বোধ করতে পারবেন না।’

প্রকৃত সত্য খুঁজে পেতে ২০০৮ সালে একটি কমিটি গঠন করে কানাডা সরকার। কানাডার মতো ‘আধুনিক ও সভ্য’ একটি দেশে হাজারো মৃত্যু ও নির্যাতনের ঘটনা হতবাক করে দেয় বিশ্ববাসীকে। সাত বছরের অনুসন্ধান ও হাজারো মানুষের সাক্ষাৎকার নেওয়ার পর ২০১৫ সালে কমিটি জানায়, এসব ঘটনা ‘সাংস্কৃতিক গণহত্যা’।

ব্র্যান্টফোর্ডে শিশুদের গণকবরের সন্ধান মিলেছে। আরও গণকবরের সন্ধানে আরও কয়েকটি জায়গায় অনুসন্ধান কার্যক্রম চলছে। কানাডা সরকারের মতে, ওই সময় চার থেকে ছয় হাজার শিশুর মৃত্যু হয়ে থাকতে পারে। এসব মৃত্যু নথিভুক্ত নয়। প্রকৃত সত্য খুঁজে পেতে ২০০৮ সালে একটি কমিটি গঠন করে কানাডা সরকার। এরপর কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসে। কানাডার মতো ‘আধুনিক ও সভ্য’ একটি দেশে হাজারো মৃত্যু ও নির্যাতনের ঘটনা হতবাক করে দেয় বিশ্ববাসীকে। সাত বছরের অনুসন্ধান ও হাজারো মানুষের সাক্ষাৎকার নেওয়ার পর ২০১৫ সালে কমিটি জানায়, এসব ঘটনা ‘সাংস্কৃতিক গণহত্যা’।

দশক পুরোনো এসব ঘটনায় কানাডা সরকার ২০০৮ সালে প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চায়। তখন দেশটির প্রধানমন্ত্রী ছিলেন জাস্টিন হারপার। সরকারি কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশের পর বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোও জাতির কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। সম্প্রতি কানাডার ক্যাথলিক চার্চ বোর্ডিং স্কুলে শিশুদের ওপর পরিচালিত নির্যাতন-হত্যার ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছে। আগামী বছর কানাডার একটি প্রতিনিধিদল ভ্যাটিকান সফর করবে। ভুক্তভোগী ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত এই প্রতিনিধিদল প্রথমবারের মতো বিষয়টি নিয়ে পোপ ফ্রান্সিসের সঙ্গে কথা বলবে। ভুক্তভোগী অস্কার কিসতাবিস বলেন, ‘আমি চাই পোপ আমাদের কাছে ক্ষমা চান।’

এই বিষয়ে মন্ট্রিয়েল ইউনিভার্সিটির নৃতত্ত্ববিদ মেরি-পিয়েরি বোসকুয়েত জানান, সরকারি কমিটির কাছে ৩৮ হাজারের বেশি ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের অভিযোগ জমা পড়েছিল। আদালতের রায় এসেছে ৫০টির কম ঘটনায়। তিনি বলেন, ‘এসব বোর্ডিং স্কুল ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের জীবনে ট্রমার কারণ হয়েছে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই দুর্বিষহ স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছে। আমাদের শিশুদের ওপর ঘটা এসব অপরাধ নিয়ে কথা বলার সময় এসেছে।’

শুধু কানাডা নয়, আরও অনেক দেশে ঐক্যবদ্ধ ও একক সংস্কৃতি গড়ার নামে ‘গণহত্যার’ ঘটনা ঘটেছে। নরওয়ে, সুইডেন এবং ফিনল্যান্ড ইতিমধ্যে এসব ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন করেছে। তবে কানাডার স্কুলে গণকবরের সন্ধান এতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে বলে মনে করেন ইতিহাসবিদ ও গবেষকেরা। তাঁদের মতে, নিজেদের মানুষের ওপর গণহত্যা চালিয়ে কোনো দেশ আধুনিক ও সভ্য হতে পারে না।

গত সেপ্টেম্বরে জাস্টিন ট্রুডো বলেছেন, ‘ভুক্তভোগী শিশুদের সঙ্গে ঘটা প্রতিটি ঘটনা, আমাদের প্রত্যেককেই লজ্জা দেয়।’ তবে সরকারি অবস্থানে সন্তুষ্ট নন জিমি পাপাতি। তিনি বলেন, সরকার ও ক্যাথলিক গির্জা মনে করে, ক্ষমা চাইলেই সব চুকে গেল। কিন্তু ক্ষমা চাওয়াই সবকিছু নয়।’