যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জনপ্রিয় রাজনৈতিক সব কর্মসূচিতেই প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পিছিয়ে আছেন। দেশের অর্থনীতি, অভিবাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, কর আইন, নাগরিক অধিকার এবং আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণ এবারের নির্বাচনে প্রধান রাজনৈতিক ইস্যু। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সুচতুরভাবে এসব রাজনৈতিক বিতর্ককে আড়াল করে নিজেকে সংবাদ শিরোনামে রাখছেন ভিন্ন সব ইস্যু নিয়ে। এভাবে রক্ষণশীলতাকে উসকে দিয়ে আধুনিক পশ্চিমা বিশ্বের রক্ষণশীল রাষ্ট্রনায়ক হতে চান ডোনাল্ড ট্রাম্প।
কোভিড-১৯ পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ব্যর্থ হয়েছেন। এ নিয়ে তাঁর নিজের দাবি যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ লোকজনই বিশ্বাস করে না। প্রায় দুই লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে এর মধ্যে। ডিসেম্বরের মধ্যে এ মৃত্যুর সংখ্যা তিন লাখের বেশি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কোভিড-১৯ মহামারির কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে ধস নেমেছে।
গত মার্চে শুরু হওয়া লকডাউনের পর যুক্তরাষ্ট্র অপ্রত্যাশিত এক অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে পড়ে। ফেব্রুয়ারিতে নগর বন্দরে কর্মখালির বিজ্ঞাপন ঝুলছিল। কর্মী সংকট নিয়ে উদ্বেগে ছিল মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলো। মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে পরিস্থিতি এখন সম্পূর্ণ ভিন্ন। দেশে এখন প্রায় তিন কোটি লোক বেকার। এসব কর্মহীন লোকের জীবন জীবিকার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক চাঞ্চল্য জড়িত। সব এখন থমকে আছে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সঠিক সময়ে সিদ্ধান্ত নিলে মৃত্যু কিছুটা কম হতো। তবে বিপর্যয় কি ঠেকানো সম্ভব হতো? আগাম লকডাউন হলে অর্থনীতিতে আরও বেশি চাপ আসত। হয়তো কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর সংখ্যা যোগ করে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এ বিপর্যয়কে মোকাবিলা করতে চেয়েছেন। মাঠ পর্যায়ের রিপাবলিকান দলের লোকজন এমনটাই মনে করেন। যদিও জনমত জরিপে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ লোকজন মনে করেন ট্রাম্প করোনাভাইরাস মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়েছেন। দুই লাখ মানুষের মৃত্যুর দায় ডোনাল্ড ট্রাম্প না নিলেও, কোভিড-১৯ এ বহু মৃত্যুর প্রশ্নের জবাব দিয়েই তাঁকে আবার হোয়াইট হাউসে যেতে হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
বহু জাতিগোষ্ঠীর দেশ যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে অভিবাসন ইস্যু একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে প্রার্থীরা এ ইস্যুটিকে সামনে নিয়ে না আসলেও অভিবাসন ইস্যু জনমতের নেপথ্যে একটা বিরাট ভূমিকা পালন করে।
জনমত জরিপে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ লোকজন মনে করেন ট্রাম্প করোনাভাইরাস মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়েছেন। দুই লাখ মানুষের মৃত্যুর দায় ডোনাল্ড ট্রাম্প না নিলেও, কোভিড-১৯ এ বহু মৃত্যুর প্রশ্নের জবাব দিয়েই তাঁকে আবার হোয়াইট হাউসে যেতে হবে বলে মনে করা হচ্ছে
যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন ইস্যু এখন এক নাজুক বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অভিবাসনবিরোধী হিসেবে দেখা হচ্ছে। তিনি মুসলিম প্রধান দেশ থেকে অভিবাসীদের আগমন নিষিদ্ধ করেছেন। নথিপত্রহীন অভিবাসীদের নিয়ে আগ্রাসী পদক্ষেপ নিয়েছেন। তাঁর এসব পদক্ষেপ পশ্চিমা বিশ্বে এখন অভিবাসনবিরোধী যে মনোভাব বিরাজ করছে, তারই প্রতিফলন। আগামী তিন দশকে যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশ আর শ্বেতাঙ্গদের একচ্ছত্র দখলে থাকবে না। ব্যাপক অভিবাসনের ফলে দেশটিতে মিশ্র গাত্রবর্ণের লোকজন বেশি হয়ে উঠবে।
সহজাত বর্ণ ভীতিতে ভোগা লোকজনের সমর্থন পাওয়ার জন্য ট্রাম্প এমন করছেন। অভিবাসীদের বন্ধু হিসেবে পরিচিত ডেমোক্রেটিক দল কার্যত যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসীদের জন্য সাম্প্রতিক ইতিহাসে তেমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সময়ের চেয়ে সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সময়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে কাগজপত্রহীন অভিবাসীদের বেশি করে বিতাড়ন করা হয়েছে। এবারের নির্বাচনে এখন পর্যন্ত ডেমোক্রেটিক দলের প্রার্থী জো বাইডেন বা কমলা হ্যারিস অভিবাসন নিয়ে তাঁদের পরিকল্পনা স্পষ্ট করেননি বা এ দাবিকে সামনে নিয়ে আসেননি। এরপরও ডেমোক্র্যাটরা আশা করছেন, অভিবাসী গ্রুপগুলোর ভোট তাঁরাই বেশি পাবেন। জনমত জরিপেও দেখা গেছে অভিবাসী গ্রুপগুলোর মধ্যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রতি অপছন্দের হার বেশি।
আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে ক্লাইমেট ইস্যু যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রধান রাজনৈতিক ইস্যু। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক অবস্থানের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অবস্থানের ফারাক ব্যাপক। এটাকে ট্রাম্প কোনো জরুরি বিষয় হিসেবেই মনে করেন না
আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে ক্লাইমেট ইস্যু যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রধান রাজনৈতিক ইস্যু। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক অবস্থানের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অবস্থানের ফারাক ব্যাপক। এটাকে ট্রাম্প কোনো জরুরি বিষয় হিসেবেই মনে করেন না। ডেমোক্রেটিক দলের উদারনৈতিক পক্ষ জলবায়ু ইস্যু নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অবস্থানের কাছাকাছি। পরিবেশ ও জলবায়ু সংরক্ষণের জন্য প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কোনো রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি নেই। নিজেদের উৎপাদন ব্যবস্থাকে ব্যাহত করে, পরিবেশ রক্ষার নামে নানা বাধ্যবাধকতা আরোপের পক্ষে নেই তিনি।
চলমান সময়ে শিল্পোন্নত দেশ হিসেবে এ বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে সামনের কাতারে চলে আসার অপেক্ষা করছিলেন পরিবেশবিদরা। যদিও এখন পর্যন্ত নির্বাচনী বিতর্কে পরিবেশ ও জলবায়ু ইস্যু প্রার্থীদের মূল বাহাসে স্থান পায়নি।
জনস্বাস্থ্য নিয়ে ডেমোক্র্যাটদের মূল ইস্যু ওবামা কেয়ার নামে সর্বজনীন স্বাস্থ্যবিমা চালু রাখা। সবার জন্য স্বাস্থ্যবিমা বাধ্যতামূলক করতে গিয়ে সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। যাদের নিম্ন আয়, তাঁদের ভর্তুকি দিয়ে স্বাস্থ্য বিমা গ্রহণ করতে হবে। যাদের আয় বেশি তাঁদের বিমা গ্রহণের জন্য অধিক অর্থ ব্যয় করতে হবে।
ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের দেশ যুক্তরাষ্ট্রে ওবামা কেয়ার নামের সর্বজনীন স্বাস্থ্যবিমা অনগ্রসরদের জন্য কল্যাণকর হলেও এ বিরোধিতায় রিপাবলিকানরা উচ্চকণ্ঠ। স্বাস্থ্যবিমা গ্রহণে কোনো নাগরিককে বাধ্য করার বিপক্ষে তাঁরা। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আরেক দফা নির্বাচিত হলে ওবামা কেয়ার সম্পূর্ণ বাতিল না করলেও এতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনার কথা বলছেন।
ওবামা কেয়ারের ফলে কর্মহীন এবং একদম নিম্ন আয়ের লোকজন ব্যাপক উপকৃত হয়েছেন। মধ্য আয় থেকে শুরু করে অধিকাংশ কর্মজীবীরা বাধ্যতামূলক এ স্বাস্থ্যবিমা নিয়ে এখনো সংশয়ে। নির্বাচনে একটি নেপথ্য ইস্যু হিসেবে কাজ করছে স্বাস্থ্যবিমা ও জনস্বাস্থ্য ইস্যু। লোকজনের স্বাস্থ্য সমস্যা প্রতিটি নির্বাচনেই একটি আলোচিত বিষয় হয়ে ওঠে।
আমেরিকার কর ব্যবস্থার আমূল সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক আলাপ দীর্ঘ দিনের। ডেমোক্রেটিক দলের উদারনৈতিক বহু কর্মসূচি পরিচালনার জন্য অর্থ সংস্থান করতে হবে অতিরিক্ত কর আদায়ের মধ্য দিয়ে। ফলে উচ্চ আয়ের লোকজনের ওপর কর বৃদ্ধি করা হবে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর করনীতি নিয়ে আলোচনায় বলছেন, ডেমোক্রেটিক দলের জো বাইডেন ও কমলা হ্যারিস জুটি হোয়াইট হাউসে গেলে যুক্তরাষ্ট্রের লোকজনের কর বৃদ্ধি পাবে। নিম্ন আয়ের লোকজনের কর দেওয়ার বালাই নেই। মধ্য আয় আর উচ্চ আয়ের লোকজনের ওপর ডেমোক্রেটিক দল কর বৃদ্ধি করবে বলে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলছেন।
নাগরিক অধিকার নিয়ে এবারের নির্বাচনে বিতর্ক বেশ আগেই শুরু হয়েছে। দেশে ঘাপটি মেরে থাকা বর্ণবাদ ও বিদ্বেষের বিরুদ্ধে জনগণের আন্দোলনকে নৈরাজ্য বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, নাগরিক আন্দোলনের ধারাবাহিক ইতিহাস নিয়ে উদাস বহু অভিবাসীও কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি তাঁদের প্রকাশ্য বিদ্বেষ প্রকাশ করতে দেখা যায়। নাগরিক আন্দোলনের সঙ্গে সহিংসতাকে এক করে ডোনাল্ড ট্রাম্প পুরো বিষয়কে নৈরাজ্যবাদীদের কাজ বলে কিছুটা হলেও রাজনৈতিক সুবিধা পাচ্ছেন বলে মনে করা হচ্ছে। যদিও ডেমোক্রেটিক প্রার্থী জো বাইডেন প্রকাশ্যেই নাগরিক আন্দোলনের নামে সহিংসতার সমালোচনা করে নিজের অবস্থানকে পরিষ্কার করার প্রয়াস নিচ্ছেন।
ডেমোক্রেটিক দলের জো বাইডেন ও কমলা হ্যারিস জুটি হোয়াইট হাউসে গেলে যুক্তরাষ্ট্রের লোকজনের কর বৃদ্ধি পাবেমার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প
আগ্নেয়াস্ত্র আইন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের লোকজনের অবস্থান বেশ মিশ্র। সংবিধানে নাগরিকদের আগ্নেয়াস্ত্র রাখার অধিকার দেওয়া হয়েছে। নানা বিধিনিষেধ আরোপ করে এ অধিকার নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছে বিভিন্ন রাজ্য। ঐতিহ্যগতভাবে যুক্তরাষ্ট্রের লোকজন আগ্নেয়াস্ত্র রাখাকে তাদের স্বাধীনতা হিসেবেই মনে করে। আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে সহিংসতার জের ধরে উদারনৈতিক মহলে সাংবিধানিক এ অধিকার নিয়ে বেশ কিছু পক্ষ সৃষ্টি হয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের অবস্থান এ ক্ষেত্রে একদম পরিষ্কার। তিনি বলছেন, ডেমোক্র্যাটরা নির্বাচিত হলে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের আগ্নেয়াস্ত্র রাখার সাংবিধানিক অধিকারটি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এতে করে মানুষ তাদের স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলবে।
একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক পার হওয়ার সময়েও রাজনীতিতে চরম রক্ষণশীল ধারণা নিয়ে মাঠে আছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। রক্ষণশীল লোকজনের কাছে এসব পুরোনো ধারণা এখনো ধরে রাখার ব্যাকুলতা থাকলেও পরিস্থিতি ভিন্ন। যুক্তরাষ্ট্রের যুব তরুণেরাও আজকের দিনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের একজন হিসেবে নিজেদের ভাবেন। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে উদারনৈতিক চিন্তাভাবনার প্রাধান্য। শিক্ষিত গোষ্ঠীর কাছে শতাব্দী পুরোনো ধারণার রাজনৈতিক ইস্যুগুলো জনপ্রিয় নয়। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সচেতনভাবেই, অগ্রসর জনগোষ্ঠীকে এড়িয়ে তাঁর নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছেন। রক্ষণশীলতাকে উসকে দিয়ে আধুনিক পশ্চিমা বিশ্বের রক্ষণশীল রাষ্ট্রনায়ক হতে চান ডোনাল্ড ট্রাম্প।