যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আর অল্প কিছু দিন বাকি। দু মাসেরও কম সময়ের দূরত্বে দাঁড়িয়ে ডেমোক্র্যাট শিবির আশা দেখতেই পারে। কারণ, সম্প্রতি প্রকাশিত অধিকাংশ জনমত জরিপেই সুস্পষ্ট ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছেন ডেমোক্রেটিক দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জো বাইডেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে তিনি এতটাই এগিয়ে রয়েছেন যে, এই মুহূর্তে যদি ভোট হয়, তবে নিশ্চিতভাবেই বাইডেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বিপুল ব্যবধানে পরাজিত করবেন।
যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী পরিমণ্ডলে বরাবরই ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান অঙ্গরাজ্য হিসেবে কিছু অঙ্গরাজ্যকে অভিধা দেওয়া হয়। এই অভিধার কারণ ইতিহাস। যেসব অঙ্গরাজ্যে ডেমোক্রেটিক দলের প্রভাব বেশি এবং বিভিন্ন নির্বাচনে ভোটারেরা দলটির পক্ষেই অবস্থান নেয়, সেগুলোকে ডেমোক্রেটিক দলের স্থায়ী শিবির হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ঠিক একই কথা সত্য রিপাবলিকান অঙ্গরাজ্যগুলোর ক্ষেত্রেও। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে একজন প্রার্থীর মূল লক্ষ্য থাকে এসব অঙ্গরাজ্যে নিজেদের প্রভাব অক্ষুণ্ন রেখে অন্য অঙ্গরাজ্যগুলোতে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করা। আর এই প্রভাব বিস্তারের জন্য উভয় পক্ষের নজর থাকে নিরপেক্ষ অঙ্গরাজ্যগুলোর দিকে, যেগুলো ‘সুইং স্টেট’ নামে বেশি পরিচিত। নাম থেকেই বোঝা যায়, এগুলোর ভোটারদের সমর্থনের পাল্লা একেকবার একেকদিকে হেলে পড়ে। নির্বাচনের ফল নির্ধারণে এই অঙ্গরাজ্যগুলোই মুখ্য ভূমিকা পালন করে। সাম্প্রতিক জনমত জরিপগুলোয় এ ধরনের অঙ্গরাজ্যগুলোতেই বাইডেনের শক্ত অবস্থানের তথ্য উঠে এসেছে।
সাম্প্রতিক বিভিন্ন জনমত জরিপের ফলাফল বিশ্লেষণ করে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এসব অঙ্গরাজ্যের বেশ কয়েকটিতে বাইডেন ট্রাম্প থেকে অনেকটাই এগিয়ে। এ ক্ষেত্রে উইসকনসিনের কথা বলা যায়। গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প খুবই কম ব্যবধানে এখানে জয়ী হয়েছিলেন। কিন্তু এবার সম্ভবত অঙ্গরাজ্যটিকে আর রিপাবলিকান অভিধায় আটকে রাখতে পারবেন না তিনি। কারণ, এরই মধ্যে এ অঙ্গরাজ্যের ভোটারদের মধ্য পরিচালিত জনমত জরিপে বাইডেন ট্রাম্প থেকে ৬ শতাংশ এগিয়ে রয়েছেন বলে তথ্য উঠে এসেছে। ফ্লোরিডায় এগিয়ে রয়েছেন ৪ শতাংশ ব্যবধানে।
বাইডেন এগিয়ে রয়েছেন অ্যারিজোনাতেও। গত ৭০ বছরে ডেমোক্রেটিক দলের একজন মাত্র প্রেসিডেন্ট প্রার্থী এই অঙ্গরাজ্যে জয়ী হয়েছেন। সে হিসেবে যত ক্ষুদ্র ব্যবধানেই হোক, অ্যারিজোনায় বাইডেনের এগিয়ে থাকাটা বিশেষ কিছু। সঙ্গে যখন নর্থ ক্যারোলাইনার নাম যুক্ত হয়, তখন নড়েচড়ে বসতেই হয়। গত ১০টি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের নয়টিতেই এই অঙ্গরাজ্যে জয় পেয়েছেন রিপাবলিকান প্রার্থীরা। সবচেয়ে অবাক করা তথ্য জানাচ্ছে টেক্সাসের জনমত জরিপ। রিপাবলিকান এই ঘাঁটিতে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বাইডেন থেকে মাত্র ৫ শতাংশ পয়েন্টে এগিয়ে রয়েছেন, যা নভেম্বরে একটি হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের বার্তা দেয়।
জো বাইডেনের জন্য সবচেয়ে আশার বার্তা হয়ে এসেছে, শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে তাঁর সমর্থন বৃদ্ধি পাওয়াটা। ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প এই শ্বেতাঙ্গ ভোটের ওপর ভর করেই প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। এবার এই পরীক্ষিত ভোটারদের মধ্যেই তাঁর গ্রহণযোগ্যতা কমছে। বড় কারণ হয়ে সামনে এসেছে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় তাঁর ব্যর্থতা।
বিভিন্ন জনমত জরিপকে বিবেচনায় নিয়ে এর ফলগুলোকে বিশ্লেষণ করেছে ফিন্যান্সিয়াল টাইমস। তারা প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের ভোটারদের মধ্যে হওয়া একাধিক জনমত জরিপের ফলাফলকে গড় করেছে। পরে এই গড় মানের ভিত্তিতে তারা বিচার করেছে যে, সংশ্লিষ্ট অঙ্গরাজ্যটি কোন দলের বৃত্তে রয়েছে। এ ক্ষেত্রে তারা তিনটি ভাগ করেছে— ‘ঘোর সমর্থক’, ‘সংশ্লিষ্ট দলপন্থী’ ও ‘নিরপেক্ষ’। শেষোক্ত শ্রেণি বলার অপেক্ষা রাখে না যে, রিপাবলিকান বা ডেমোক্র্যাট যেকোনো দিকে হেলে পড়তে পারে। প্রথমটি ক্যাটাগরিতে থাকা অঙ্গরাজ্যগুলোয় দলগুলোর সমর্থন এমন মানের যে, তার ফল আগে থেকেই বলে দেওয়া সম্ভব। আর দ্বিতীয় ক্যাটাগরিতে থাকা অঙ্গরাজ্যগুলোয় কোনো এক দলের প্রভাব বেশি হলেও, তারা শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হবে।
এই বিভাজনের ক্ষেত্রে দুই প্রার্থীর প্রতি ভোটার সমর্থনের ব্যবধানকে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। দুই প্রার্থীর প্রতি ভোটার সমর্থনের ব্যবধান ১০ শতাংশের বেশি হলে সেগুলোকে এগিয়ে থাকা প্রার্থীর ‘ঘোর সমর্থক’ অঙ্গরাজ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। আর এই ব্যবধান ৫ শতাংশের নিচে হলে সংশ্লিষ্ট অঙ্গরাজ্যগুলোকে ‘নিরপেক্ষ’ হিসেবে ধরা হয়েছে। ‘সংশ্লিষ্ট দলপন্থী’ ক্যাটাগরিতে তাদেরই ফেলা হয়েছে, যেগুলোয় খুব বেশি জনমত জরিপ হয়নি। এ ক্ষেত্রে ফেডারেল নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী এই অঙ্গরাজ্যগুলোর অতীত প্রবণতাকে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ইলেকটোরাল কলেজ ভোট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অধিকাংশ অঙ্গরাজ্যই এ ক্ষেত্রে ‘উইনারস টেকস ইট অল’ নীতি অনুসরণ করে। এ ক্ষেত্রে মেইন ও নেব্রাস্কা অঙ্গরাজ্য আনুপাতিক হারে ইলেকটোরাল কলেজ ভোট বণ্টনের নীতি অনুসরণ করে। এ কারণে মোটাদাগে নির্বাচন-পূর্ব বিভিন্ন জনমত জরিপের ফলাফল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদিও গত নির্বাচনে সব জনমত জরিপের ফলাফলকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়ের কারণে এর ওপর এখন মানুষের আস্থা অনেক কমেছে। এখন কথা উঠেছে, জনমত জরিপগুলোয় সবাই অংশ নিতে চায় না। ফলে অনেকের মনোভঙ্গি সম্পর্কেই এর মাধ্যমে জানা সম্ভব হয় না। বিশেষত প্রান্তিক অঞ্চলের ভোটারদের মধ্যে জনমত জরিপে অংশ নেওয়ার প্রবণতা কম। আর এই ভোটারদের মধ্যেই ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রিপাবলিকান দলের সমর্থন বেশি।
নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে কমপক্ষে ২৭০টি ইলেকটোরাল ভোট প্রয়োজন। সাম্প্রতিক বিভিন্ন জনমত জরিপের ফলগুলোকে বিবেচনায় নিলে বাইডেন অনেক এগিয়ে রয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প থেকে। ফিন্যান্সিয়াল টাইমস বলছে, এখনই ভোট হলে নিরপেক্ষ অঙ্গরাজ্যগুলোর সহায়তা ছাড়াই বাইডেন জয়ী হতে পারবেন। ক্যালিফোর্নিয়া, নিউইয়র্ক, ইলিনয়, নিউজার্সি, ভার্জিনিয়া, ওয়াশিংটন, ম্যাসাচুসেটস, মেরিল্যান্ডের মতো অঙ্গরাজ্যগুলোয় তাঁর অবস্থান শক্ত। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে এবং বর্তমান প্রবণতা জারি থাকলে পেনসিলভানিয়া, মিশিগান, মিনেসোটা, উইসকনসিনের মতো অঙ্গরাজ্যগুলোর ভোটারেরাও তাঁর পক্ষেই অবস্থান নেবে বলে মনে করা হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে বাইডেনের ২৭০টি ইলোকটোরাল ভোট নিজের দিকে টানার কথা। বিপরীতে টেনেসি, আলাস্কা, কেনটাকি, ওকলাহোমা, আরাকানসাস, আইডাহো, ইন্ডিয়ানা, মিজৌরি প্রভৃতি অঙ্গরাজ্যে ট্রাম্প ভালো অবস্থানে রয়েছেন। কিন্তু এসব অঙ্গরাজ্যে ইলেকটোরাল ভোটের সংখ্যা কম।
ফলে পুনর্নির্বাচনের জন্য বড় অঙ্গরাজ্যগুলোয় নিজের অবস্থান শক্ত করায় মনোযোগ দিতে হবে ট্রাম্পের। এ ক্ষেত্রে ট্রাম্পকে বিশেষত টেক্সাস, সাউথ ক্যারোলাইনা, জর্জিয়ার মতো বড় অঙ্গরাজ্যগুলোর ভোটারদের নিজের দিকে টানতে কোমর বেঁধে নামতে হবে তাঁকে। কারণ রিপাবলিকান বলে স্বীকৃত এই অঙ্গরাজ্যগুলোয় ট্রাম্প বর্তমানে বাইডেন থেকে ৫ শতাংশের কম ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছেন। ঠিক একইভাবে বাইডেনকেও নিজের অবস্থান ধরে রাখতে হলে নর্থ ক্যারোলাইনা, ফ্লোরিডা, ওহাইও, অ্যারিজোনা, পেনসিলভানিয়া, মিশিগানের মতো অঙ্গরাজ্যে জোর দিতে হবে। কারণ এগুলোয় তিনি ট্রাম্প থেকে ৫ শতাংশ পয়েন্টের কম ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছেন।