জাহাজী অ্যাপ
জাহাজী অ্যাপ

দুই তরুণের উদ্যোগ

যে অ্যাপে জাহাজের সব খবর

নদীমাতৃক বাংলাদেশে ছোট–বড় নদীর সংখ্যা প্রায় চার শতাধিক। সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব হলেও নৌপথে পণ্য পরিবহনের সময় ব্যবসায়ীদের অনেকেই জাহাজের অবস্থান সুনির্দিষ্টভাবে জানতে পারেন না। ফলে এই খাতের ব্যবসায়ী, জাহাজমালিক, আমদানিকারকদের আর্থিক ক্ষতি তো হয়ই, ভবিষ্যৎ ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত নিতেও সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। আর এই সমস্যা সমাধানে এগিয়ে এসেছেন দুই তরুণ-কাজল আবদুল্লাহ ও অভিনন্দন জোতদার। তৈরি করেছেন ‘জাহাজী অ্যাপ’। ২০১৯ সালে যাত্রা শুরু করা অ্যাপটি কাজে লাগিয়ে নদীতে চলা যেকোনো ইঞ্জিনচালিত নৌযানের অবস্থান শনাক্ত করা যায়। শুধু তা–ই নয়, অনলাইনে বাল্কহেড ভাড়া নেওয়ারও সুযোগ মিলে থাকে।

শুরুর কথা

সময়টা ২০১৬। জাহাজীর সহপ্রতিষ্ঠাতা অভিনন্দন জোতদার ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে খুলনায় এজে করপোরেশন নামে একটি লজিস্টিকস প্রতিষ্ঠান চালু করেন। নদীপথে বালু, পাথর কয়লা পরিবহনের পাশাপাশি ট্রান্সপোর্ট ব্যবসা করত প্রতিষ্ঠানটি। তিনি দেখেন, ডিজিটাল বাংলাদেশে বিভিন্ন খাতে উন্নতি হলেও অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন খাতে তেমন প্রযুক্তির ছোঁয়া লাগেনি। কারণ, নৌপথে হাজার হাজার পণ্যবাহী জাহাজ চললেও সেগুলোর অবস্থান জানার সুযোগ মেলে না। এমনকি পণ্যবাহী জাহাজ, বিশেষ করে বাল্কহেড ভাড়ার জন্য পুরোপুরি নির্ভর করতে হয় দালালদের ওপর। এ সমস্যা সমাধানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী কাজল আবদুল্লাহকে সঙ্গে নিয়ে চালু করেন জাহাজী অ্যাপ।

বাধা পেরিয়ে সাফল্য

অ্যাপটি ব্যবহারের জন্য নিবন্ধিত নৌযানে একটি ভেহিকেল ট্র্যাকিং সিস্টেম বা ভিটিএসযুক্ত ট্র্যাকার করতে হয়। এই ভিটিএস ট্র্যাকারের মাধ্যমে নদীতে চলাচল করা জাহাজের সর্বশেষ অবস্থান তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়। উন্নত মানের ট্র্যাকিং সেবা দিতে চীন থেকে ভিটিএস ট্র্যাকার আমদানি করেন তাঁরা। কিন্তু শুরুতেই তাঁদের এ উদ্যোগ মুখ থুবড়ে পড়ে। কারণ, বাংলাদেশের নদীপথে মোবাইল নেটওয়ার্ক খুব দুর্বল এবং নদীপথের আর্দ্রতার কারণে ভিটিএস ট্র্যাকারগুলো দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। এর মধ্যে আঘাত হানে করোনা মহামারি, ফলে সারা দেশেই ব্যবসা বন্ধের উপক্রম। এই সময় দুই বন্ধু সিদ্ধান্ত নেন, তাঁরা ঘুরে দাঁড়াবেন। বাংলাদেশেই তৈরি করবেন কম দামের ভিটিএস ট্র্যাকার, যা নদীপথের সব স্থানে উন্নত মানের নেটওয়ার্ক সেবা দেওয়ার পাশাপাশি টেকসই হবে। এরই মধ্যে নিজেদের কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের আইডিয়া প্রকল্প থেকে ১০ লাখ টাকা অনুদান পান তাঁরা। এই অর্থ দিয়েই নিজস্ব ভিটিএস ট্র্যাকার তৈরি করেন তাঁরা। যন্ত্রটি নদীপথে উন্নত মানের সেবা দেওয়ার পাশাপাশি দুর্ঘটনার সতর্কতাও পাঠাতে পারে।

অ্যান্ড্রয়েড ও আইওস অপারেটিং সিস্টেম চলা স্মার্টফোনের উপযোগী জাহাজী অ্যাপটি কাজে লাগিয়ে নৌযানের অবস্থান জানার পাশাপাশি সেগুলো ভাড়াও করা যায়। স্মার্টফোন না থাকলেও ক্ষতি নেই, ফিচার ফোনে এসএমএসের মাধ্যমে নৌযানের অবস্থান জানায় অ্যাপটি। যাত্রা শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৫০০টি জাহাজ জাহাজীর সেবা ব্যবহার করছে।

নিজেদের কার্যক্রম তুলে ধরে জাহাজীর সহপ্রতিষ্ঠাতা কাজল আবদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, নাম শুনে অনেকেই জাহাজীকে ট্র্যাকিং প্রতিষ্ঠান মনে করেন। কিন্তু আসলে জাহাজী বাংলাদেশের নৌপথের প্রথম ই-লজিস্টিকস ও ডেটা অ্যানালিটিকস প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে ২৭ জন কর্মী রয়েছেন জাহাজীর। আগামী আগস্ট মাস থেকে আমরা অ্যাপের মাধ্যমে বাল্কহেড বুকিং সুবিধা চালুর উদ্যোগ নিয়েছি। এ সুবিধা কাজে লাগিয়ে পণ্য সরবরাহকারীরা সরাসরি মালিকের কাছ থেকে বাল্কহেড ভাড়া নিতে পারবেন। এর ফলে নৌপথে পণ্য পরিবহন খরচ ৩ থেকে ৫ শতাংশ কমবে। এরই মধ্যে ‘জাহাজী জবস’ নামে নতুন সুবিধা চালু করা হয়েছে। ফলে জাহাজী অ্যাপের মাধ্যমে জাহাজের কর্মীরা চাকরির খোঁজ করতে পারবেন।

স্বীকৃতি

জাহাজী সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সিড স্পার্ক সাউথ এশিয়া (কোহর্ট ৪) প্রোগ্রামে বিজয়ী হয়েছে। ২০২১ সালে অনুষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু ইনোভেশন গ্র্যান্ট (বিগ) আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় সেরা তিনে স্থান পেয়েছিল জাহাজী।