২০১৯ সালের কথা! স্বামীর সঙ্গে ঢাকায় আসেন পপি। বেশ কটা সরকারি চাকরির পরীক্ষা দেন। কিন্তু ফলাফল শূন্য। আত্মবিশ্বাস তলানিতে গিয়ে ঠেকে। কষ্টার্জিত শিক্ষাসনদগুলোকে ঠুনকো মনে হয়। একটি স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। সে সময় ঝোঁকেন অনলাইন ফ্রিল্যান্সিংয়ের দিকে। প্রশিক্ষণ নেন, একসময় টুকটাক কাজও শুরু করেন; কিন্তু শুরুতেই স্বামীর পুরোনো কম্পিউটারটি বিগড়ে বসে।
মন খারাপ হয়ে গেল পপির। দিন কয়েক পর শাশুড়ি এলেন বেড়াতে। পুত্রবধূর মন খারাপ টের পেলেন। সব শুনে শাশুড়ি নিজের জমানো টাকা তুলে দেন পুত্রবধূর হাতে। শাশুড়ির টাকায় ল্যাপটপ কিনে অনলাইনে ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ শুরু করেন পপি। মাসে এখন প্রায় তিন লাখ টাকা আয় করেন তিনি।
যশোরের মনিরামপুরের পপি রানী সিন্হার পরিচয় এখন ফ্রিল্যান্সার বা মুক্ত পেশাজীবী। পপি কাজ করেন প্রফেশনাল গুগল অ্যাড এক্সপার্ট ও বিজনেস অ্যানালিস্ট হিসেবে। সরকারি চাকরি না পাওয়ার কষ্টকে এখন আর কোনো কষ্টই মনে হয় না।
উল্টো ঘরে বসে বিদেশের কাজ করছেন। বিদেশিদের কাছে নিজেকে, নিজের কাজকে ঠিকঠাক উপস্থাপন করতে পারছেন—এটাকেই বড় সাফল্য মনে করেন এক সন্তানের এই মা। এতেই তাঁর আনন্দ।
শামীম হোসাইনের প্রতিটি ভিডিও দেখার পর মনে হতো, ঠিক দিকনির্দেশনা পাচ্ছি। একসময় ১ হাজার ৯৯০ টাকায় রেকর্ডেড কোর্স কিনি। শুরু করি অনুশীলন। তখন কাজ করতাম স্বামীর পুরোনো ল্যাপটপে।পপি রানী
ছোটবেলা থেকে নিজের একটি পরিচিতি তৈরি করতে চেয়েছেন পপি। বাবার তেমন সামর্থ্য ছিল না। তাই এমএম কলেজে অর্থনীতি নিয়ে স্নাতক শ্রেণিতে পড়ার সময় যশোরের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে খণ্ডকালীন চাকরি শুরু করেন। ২০১৪ সালে পপি যখন তৃতীয় বর্ষে, তখন তাঁর বিয়ে হয়ে যায়। স্বামী রত্নদ্বীপ দাস চাকরি করেন বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে; কিন্তু পড়াশোনা চালিয়ে যান পপি। অর্থনীতিতে প্রথম শ্রেণি পেয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন।
২০১৯ সালে স্বামীর সঙ্গে ঢাকায় আসেন পপি। বিসিএস ও আইইএলটিএস পরীক্ষার জন্য কোচিংয়ে ভর্তি হন। একই বছর বেশ কটি সরকারি চাকরির পরীক্ষায় প্রাথমিকভাবে টেকেন; কিন্তু চূড়ান্ত পরীক্ষায় কোনোটিতেই উত্তীর্ণ হতে পারেননি। পপির ভাষ্য, ‘নিজের কষ্টার্জিত চারটি সনদকে অযৌক্তিক মনে হতে শুরু হলো। তলানিতে চলে যায় আমার আত্মবিশ্বাস।’
২০২১ সালে ধানমন্ডি জুনিয়র ল্যাবরেটরি স্কুলের ইংরেজি মাধ্যমে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন পপি। এ সময় ফ্রিল্যান্সিংয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন তিনি। পরে অবশ্য স্বামীর চাকরিসূত্রে চলে যান নারায়ণগঞ্জে।
২০২৩ সালের মাঝামাঝি। সংসারে সহযোগিতা করার মতো কেউ ছিল না। সাত বছরের মেয়ের দেখভাল, তার পড়াশোনা; নিজের চাকরি করা কঠিন হয়ে পড়ে পপির জন্য। চাকরি ছেড়ে দিয়ে ঘরে বসে উপার্জনের বিকল্প চিন্তা করেন। ইউটিউবে ফ্রিল্যান্সিংয়ের ভিডিও দেখা শুরু করলেন।
২০২২ সালের জুলাইয়ে অনলাইন ডিজিটাল বিপণনের প্রশিক্ষণ কোর্সে ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হন পপি। পরের বছরের জানুয়ারিতে কোর্স শেষ করেন। তবে অনলাইনে ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ আদান–প্রদানের ওয়েবসাইট বা অনলাইন মার্কেটপ্লেসে কাজ করার আত্মবিশ্বাস তখনো সঞ্চয় করতে পারেননি।
২০২৩ সালের মাঝামাঝি। সংসারে সহযোগিতা করার মতো কেউ ছিল না। সাত বছরের মেয়ের দেখভাল, তার পড়াশোনা; নিজের চাকরি করা কঠিন হয়ে পড়ে পপির জন্য। চাকরি ছেড়ে দিয়ে ঘরে বসে উপার্জনের বিকল্প চিন্তা করেন। ইউটিউবে ফ্রিল্যান্সিংয়ের ভিডিও দেখা শুরু করলেন। দেখতে দেখতে স্কিল আপারের প্রতিষ্ঠাতা শামীম হোসাইনের তৈরি কিছু ভিডিও চোখে পড়ে। পপি রানী বলেন, ‘শামীম হোসাইনের প্রতিটি ভিডিও দেখার পর মনে হতো, ঠিক দিকনির্দেশনা পাচ্ছি। একসময় ১ হাজার ৯৯০ টাকায় রেকর্ডেড কোর্স কিনি। শুরু করি অনুশীলন। তখন কাজ করতাম স্বামীর পুরোনো ল্যাপটপে।’ এভাবেই আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন পপি।
ডিজিটাল বিপণন বিষয়গুলোর মধ্যে গুগল অ্যাডসের ওপর পপির আগ্রহ জন্মায়। গুগল অ্যাড এক্সপার্ট হিসেবে ঢাকার একটি এজেন্সিতে নামমাত্র বেতনে চাকরির সুযোগ পান। যোগ দেন সেখানে। উদ্দেশ্য ছিল হাতে-কলমে কাজ করে দক্ষতা বাড়ানো। এরপর মার্কেটপ্লেসে নিয়মিত কাজ করতে থাকেন। পরিবার ও সন্তানকে সময় দেওয়ার পরও এক শর বেশি প্রকল্প সম্পন্ন করেছেন তিনি।
পপি রানী সিন্হা বলেন, ‘অনেক চড়াই-উতরাই পার হতে হয়েছে। স্বামী-সন্তানকে সময় দিতে হয়েছে। তবু আমি পেরেছি। স্বামীর পূর্ণ সমর্থন ছিল। সে জন্যই কাজ করা আমার জন্য সহজ হয়েছে।’
মাত্র এক মাসের মাথায় পপি ফাইভআরের লেভেল ওয়ান এবং দুই মাসের মাথায় লেভেল টু সেলার হিসেবে নিবন্ধিত হন। পপি রানী সিন্হা এখন ফাইভআরের টপ রেটেড ফ্রিল্যান্সার। মার্কেট প্লেসের বাইরে যুক্তরাষ্ট্রের একটি বেসরকারি এজেন্সিতে গুগল অ্যাডস এক্সপার্ট হিসেবে কাজ করছেন।
শাশুড়ির কাছ থেকে ল্যাপটপ পাওয়ার কাহিনী শোনা গেল পপির মুখেই। নারায়ণগঞ্জে বাসায় বসেই কাজ চলছিল তখন। কিন্তু পুরোনো সেই কম্পিউটারটি হঠাৎ নষ্ট হয়ে গেল। কাজ বন্ধ। মন খারাপ পপির। তখন তাঁর শাশুড়ি লাকি দাস এলেন বেড়াতে। টের পেলেন, পুত্রবধূর মন খারাপ। কারণ জানতে চাইলেন। শাশুড়ির চাপাচাপিতে পপি সব খুলে বললেন। শাশুড়ি তিন বছর ধরে কিছু টাকা জমিয়েছিলেন। জমানো সেই টাকাই পুত্রবধূর হাতে তুলে দিলেন। সেই টাকায় ভালো মানের একটি ল্যাপটপ কেনা হলো।
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে পপি ফাইভআর মার্কেটপ্লেসে প্রথম যোগ দিলেন। দুই সপ্তাহের মাথায় প্রথম অর্ডার পেয়ে যান, ৬০ ডলারের। ‘ফাইভ স্টার’ রেটিং পেয়ে সম্পন্ন করেছিলেন কাজটি। সেই থেকে শুরু। আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। মাত্র এক মাসের মাথায় পপি ফাইভআরের লেভেল ওয়ান এবং দুই মাসের মাথায় লেভেল টু সেলার হিসেবে নিবন্ধিত হন। পপি রানী সিন্হা এখন ফাইভআরের টপ রেটেড ফ্রিল্যান্সার। মার্কেট প্লেসের বাইরে যুক্তরাষ্ট্রের একটি বেসরকারি এজেন্সিতে গুগল অ্যাডস এক্সপার্ট হিসেবে কাজ করছেন। সম্প্রতি আপওয়ার্ক মার্কেটপ্লেসেও বেশ কয়েকটি কাজ করেছেন তিনি। মাসে এখন আয় করছেন আড়াই হাজার মার্কিন ডলারের বেশি।নিজেকে দেশের বাইরে, বিদেশিদের কাছে উপস্থাপন করতে পেরে আনন্দিত পপি। তিনি বলেন, ‘পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের কাছে কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। একই সঙ্গে বাসায় বসে বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষকে ব্যবসা বাড়াতে সাহায্য করতে পেরেও আমি গর্বিত।’
পপি রানী সিন্হা মনে করেন, তাঁর মতো হাজার হাজার শিক্ষিত গৃহিণীর জন্য সাফল্যের চাবিকাঠি হতে পারে ফ্রিল্যান্সিং। যার মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারেন তাঁরা।