ফুলবাড়ী থেকে ফ্রিল্যান্সিং করে মাহমুদুলের আয় মাসে ১৬ লাখ টাকা

৩১ বছর বয়সেই সফল ফ্রিল্যান্সার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এখন বিনা মূল্যে শেখাতে চান।

সেরা ফ্রিল্যান্সার সম্মাননা হাতে মাহমুদুল হাসান। গত ১৯ আগস্ট, ঢাকায়

চাকরিটা হঠাৎ একদিন ছেড়ে দিলেন। সেটা ছিল ২০১০ সালে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ানোর কাজ। পরিবারের কাছে বায়না ধরলেন একটা কম্পিউটার কিনে দেওয়ার জন্য। কিন্তু কম্পিউটার পেলেন না। দিনাজপুরের বাড়ি ছেড়ে ঢাকায় চলে এলেন মাহমুদুল হাসান।

ঢাকায় এসে মাহমুদুল একটি তৈরি পোশাক কারখানায় চাকরি শুরু করেন। সকাল–সন্ধ্যা পরিশ্রম করতে থাকেন। উদ্দেশ্য টাকা জমিয়ে কম্পিউটার কেনা এবং ফ্রিল্যান্স আউটসোর্সিংয়ের জন্য কাজ শেখা। সেই সময় (২০১১) তিনি বেতন পেতেন সাড়ে চার হাজার টাকা। লম্বা সময় দাঁড়িয়ে কাজও করতে হয়েছে।

সেই মাহমুদুল এখন ঢাকায় থাকেন না। দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে নিজের বাড়িতে থেকে মাসে গড়ে আয় করেন প্রায় ১৬ হাজার মার্কিন ডলার। টাকার হিসাবে তা ১৬ লাখ টাকার বেশি।

গত ১৯ আগস্ট রাজধানীতে অনুষ্ঠিত জাতীয় ফ্রিল্যান্সার সম্মেলনে সেরা ফ্রি–ল্যান্সারের সম্মাননা পেয়েছেন তিনি। সেখানেই দেখা হয় মাহমুদুল হাসানের সঙ্গে। এর আগে ২০২১ সালে পেয়েছেন বেসিস আউটসোর্সিং অ্যাওয়ার্ডও। সম্প্রতি ফুলবাড়ীতে মাহমুদুলের বাড়িতে গিয়ে বিস্তারিত কথা হয় তাঁর সঙ্গে। কীভাবে একজন সফল মুক্ত পেশাজীবী বা ফ্রিল্যান্সার হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলেছেন, তা জানালেন প্রথম আলোকে

হতে চেয়েছিলেন প্রকৌশলী

মাহমুদুলের স্বপ্ন ছিল প্রকৌশলী হওয়ার, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) পড়ার। ছাত্র ভালো হলেও পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা অনুকূলে ছিল না। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় মাহমুদুলের বাবা আনিসুর রহমান অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিন ভাই-বোনের মধ্যে মাহমুদুল সবার বড়।

দিনাজপুরের ফুলবাড়ী বাজারে বাবার কাঁচামালের দোকানে বসতে হয় তাঁকে। এরপর অনেকবারই পরিবারকে সহায়তা করতে দোকানে বসতে হয়েছে। বারবার পড়াশোনায় বিঘ্ন ঘটলেও উচ্চমাধ্যমিকে ভালো ফল করেছিলেন। কিন্তু অর্থনৈতিক কারণে শেষ পর্যন্ত আর বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষা দিতে পারেননি। তাঁর বন্ধুরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন মাহমুদুলকে খুঁজতে হয়েছিল চাকরি। সেটিও পাননি।

এরপর ভেবেছিলেন বুয়েটে না হোক, অন্য কোথাও কম্পিউটারবিজ্ঞান পড়বেন। সে জন্য টাকা চাই। পড়ার খরচ জোগাতে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে অনলাইনে কাজ করার কথা ভাবেন তিনি। এখন এটাই তাঁর পেশা।

৩১ বছর বয়সেই সফল ফ্রিল্যান্সার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে মাহমুদুলের মোট আয় ছিল দুই লাখ ডলার, টাকার অঙ্কে যা দুই কোটি টাকার বেশি।

যেভাবে শুরু 

মাহমুদুল ২০১০ সালে ফ্রিল্যান্সিং সম্পর্কে এক বন্ধুর কাছে শোনেন। এরপর প্রথম আলোয় প্রকাশিত ফ্রিল্যান্সিং বিষয়ে একটা লেখা পড়ে আগ্রহ জন্মে। তখন কম্পিউটার, ইন্টারনেট কিংবা স্মার্টফোন কিছুই ছিল না মাহমুদুলের। তবে পত্রিকা পড়তেন নিয়মিত। তখন বুঝতে পারেন ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজে সময়ের বাঁধাধরা ছক নেই। পড়াশোনাতেও বিঘ্ন ঘটবে না, আবার বাড়িতেও টাকা দেওয়া যাবে। 

মাহমুদুল ভেবেছিলেন ওয়েবসাইট ডিজাইন ও ডেভেলপমেন্ট নিয়ে কাজ করবেন। তাই ফটোশপের কাজ শেখেন প্রথমে। ঢাকা থেকে বই নিয়ে এসে চর্চা করতে থাকেন। কাজ করতে করতে গ্রাফিক ডিজাইন বিষয়টি ভালো লাগে তাঁর এবং সিদ্ধান্ত নেন এই বিষয়ে দক্ষতা বাড়াবেন।

প্রতিযোগিতায় নকশা বিক্রি

দিনাজপুর সরকারি কলেজ থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতক মাহমুদুল হাসান ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ শুরু করেন ২০১২ সাল থেকে। বছরখানেক গ্রাফিক ডিজাইন চর্চার পর অনলাইনে কাজ দেওয়া–নেওয়ার ওয়েবসাইট (মার্কেটপ্লেস) ফ্রিল্যান্সার ডটকমে লোগো ডিজাইন প্রতিযোগিতায় অংশ নেন।

প্রথমবারই দ্বিতীয় হন তিনি। তাঁর আগ্রহ বেড়ে যায়। প্রতিযোগিতায় নিয়মিত অংশ নিতে নিতে ২০১৩ সালে একটা লোগো ডিজাইন প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়ে ৯০ ডলার আয় করেন। সেটাই ফ্রিল্যান্সিংয়ে তাঁর প্রথম উপার্জন। এরপর প্রতিযোগিতার পাশাপাশি বিদেশি গ্রাহকের কাজ করা শুরু করেন মাহমুদুল। একসময় তাঁর এক পুরোনো গ্রাহক একটা চাকরির প্রস্তাব দেন। যেটি দূর থেকেই করা যাবে। সেই প্রস্তাব গ্রহণ করেন মাহমুদুল।

মাস কয়েক পর ওই প্রতিষ্ঠান থেকে তাঁকে লন্ডন গিয়ে কাজ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু তত দিনে মাহমুদুল ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। লন্ডনে না গিয়ে কয়েকজন বন্ধু ও পরিচিতকে নিয়ে তিনি নিজেই একটা প্রতিষ্ঠান চালু করেন। তবে কয়েক মাস পর এই উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। এরপর আবার একা কাজ শুরু করেন মাহমুদুল।

ইচ্ছাশক্তি ও আন্তরিক আগ্রহ

মাহমুদুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইচ্ছা ও কাজের প্রতি দরদ থাকলে কেউ আটকাতে পারবে না। আমি অনেক কষ্ট করেছি, যেটা বলে বোঝাতে পারব না হয়তো, কিন্তু এখন তার ফল পাচ্ছি। অনেকে আমার সফলতাটা দেখে, কিন্তু পেছনে যে কঠিন গল্প, সেটা কেউ জানে না। আমার একটি প্রতিষ্ঠান আছে, নাম ইমাজিন ডিজিটাল। এখন আমি সেখানে একটা দল করেছি, সাতজন আমার সঙ্গে কাজ করেন।’

মাহমুদুল নিজের এলাকার ছেলেমেয়েদের জন্য কিছু করতে চান। বিনা মূল্যে তাদের শেখাতেও চান। মাহমুদুল হাসানের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার মধ্যে আরও আছে নিজস্ব ওয়েবসাইটে নিজের নকশা বিক্রি করা। ব্যক্তিগত জীবনে বিবাহিত তিনি। ২০২১ সালে অতিকা আক্তারকে বিয়ে করেছেন। এই দম্পতির রয়েছে সাত মাস বয়সী এক মেয়ে, নাম মুনজারিন আফরিন।