মুনীম হোসেন রানা
মুনীম হোসেন রানা

সাক্ষাৎকার

পড়ে থাকা বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রের অ্যানটেনা হতে পারে দেশের প্রথম রেডিও টেলিস্কোপ: মুনীম রানা

যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী পদার্থবিদ ও অ্যামেচার রেডিও অপারেটর মুনীম হোসেন রানা। সাম্প্রতিক সময়ে সূর্যের অভ্যন্তরের ছবি তোলার জন্য বেশ আলোচিত হয়েছেন। ১৯৮০-১৯৯০ দশকে দেশের বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে আলোচিত নাম মুনীম হোসেন রানা। এখন ব্যস্ত দেশের প্রথম রেডিও টেলিস্কোপ নির্মাণ নিয়ে। ৪ ডিসেম্বর রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে তিনি কথা বলেছেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নানা দিক নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছে পল্লব মোহাইমেন ও জাহিদ হোসাইন খান।

প্রশ্ন

আপনার কাজ ও শখগুলো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক। এগুলো উচ্চপ্রযুক্তির। আপনার বর্তমান পেশাগত কাজ দিয়ে কথা শুরু করি।

মুনীম রানা: আমি বর্তমানে কোহিয়ারেন্ট নামের একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করছি। লেজারনির্ভর প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছি আমরা। এই প্রযুক্তি ফেস রিকগনিশন বা মুখমণ্ডল শনাক্ত করার প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানের জন্য প্রযুক্তি তৈরি করি আমরা। আমি একটি কারিগরি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছি। আমরা সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের এই খাতে পণ্য তৈরি থেকে শুরু করে পণ্য বিপণনের কাজ করি। ২০১৬ সাল থেকে এই প্রতিষ্ঠানে যুক্ত আছি।

প্রশ্ন

এবার বাংলাদেশে এসেছেন কেন?

মুনীম রানা: দীর্ঘদিন পরে বাংলাদেশে আসি ভোলার তারুয়া দ্বীপে রেডিও ক্যাম্প করার জন্য। এখানে এবার অ্যামেচার রেডিওর অপারেটররা আবার আইল্যান্ড অন দ্য এয়ার (আইটিএ) আয়োজন করেন। এ ছাড়া পারিবারিক কিছু কাজ ছিল। একই সঙ্গে আরও কিছু কাজ করছি। আমি দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ থেকে রকেট পাঠানোর কাজে যুক্ত হয়েছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের আজাদ ও তার দল এই কাজ করছে। অ্যামেচার রকেটে আমি অ্যামেচার রেডিও যুক্ত করার কাজটা করছি। এখন যারা রেডিও তৈরির কাজ করছে, আমি তাদের উৎসাহ দিই। তারুয়া সৈকতে বেতার তরঙ্গ নিয়ে একটা ক্যাম্প পরিচালনা করতেই মূলত এবার আসা।

আমার জীবনের যত শিক্ষা, তা আমি নতুন প্রজন্মের কাছে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ করছি এখন। স্কুলজীবন থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত অনেক কিছু প্রথমবারের মতো করে দারুণ সব অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার। তা আমি সবার কাছে ছড়িয়ে দিতে চাচ্ছি এখন। আরেকটা কাজ করছি এখন, যাঁরা অ্যামেচার রেডিও নিয়ে কাজ করেন, তাঁদের মধ্যে আমার আগ্রহ ছড়িয়ে দিতে চাই। যারা শৌখিন রেডিও নিয়ে কাজ করে, তাদের মধ্যে ফক্স হান্টিং নামের একটি খেলা চালু আছে। এই খেলায় বিভিন্ন উৎস থেকে বেতার সংকেত খুঁজে বের করতে হয়। কয়েক মুহূর্তের জন্য কোনো বেতার সংকেত উৎস থেকে খুঁজে বের করার খেলা এটি। যারা অ্যামেচার রকেট বানাবে, সেই সব রকেটের সংকেত বের করবে অ্যামেচার রেডিও নির্মাতারা। আরেকটা কাজ করছি, রাঙামাটির বেতবুনিয়া ভূ–উপগ্রহে সবচেয়ে বড় অ্যানটেনা আছে। সেই অ্যানটেনা অনেক শক্তিশালী। কিন্তু সেটা এখন অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। সেই অ্যানটেনাকে রেডিও টেলিস্কোপে রূপান্তর করার জন্য কাজ করছি। আমরা সাধারণ টেলিস্কোপে শুধু আলো দেখতে পাই। কিন্তু তড়িৎচৌম্বকীয় বর্ণালিতে আলো ছাড়াও রেডিও টেলিস্কোপের মাধ্যমে অতিবেগুনি রশ্মি, এক্স–রে কিংবা অনেক তরঙ্গ, ফ্রিকোয়েন্সি শনাক্ত করা যায়। ধূমকেতু বা মঙ্গল গ্রহকে শুধু টেলিস্কোপ দিয়ে দেখা যায়। কিন্তু রেডিও টেলিস্কোপ দিয়ে ১০০ গুণ বেশি তথ্য পাওয়া যাবে। বেতবুনিয়া উপগ্রহ ভূকেন্দ্রকে আমরা রেডিও টেলিস্কোপে রূপান্তর করতে কাজ করছি। এ জন্য অ্যামেচার রেডিও অপারেটরদের লাগবে। এ ছাড়া বিশাল সংখ্যক তথ্য–উপাত্ত (ডেটা) সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের জন্য সফটওয়্যার জানা অনেক তরুণ লাগবে এই কাজের জন্য। আমি রেডিও টেলিস্কোপের জন্য বিটিআরসিসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করছি। কাজটা করতে পারলে প্রথমবারের মতো আমরা নিজেরা অন্য কোনো দেশের কোম্পানি ছাড়াই মহাকাশ নিয়ে গবেষণার সুযোগ পাব। নিজেদের উপকরণ দিয়ে মহাকাশ বিশ্লেষণের সুযোগ পাব। মহাকাশ নিয়ে নতুন জানালা উন্মুক্ত হবে আমাদের। এটার জন্য অনেক কম খরচ ও অনেক কম সময় লাগবে। অনেক তরুণ আছে, তাদের নিয়ে আমি কাজ করছি। এ ছাড়া দেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞান বিভাগ চালু করা যায় কি না, তা নিয়ে কাজ করছি। এখন পর্যন্ত ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয় কোর্স হিসেবে এই বিষয় পড়ানোর জন্য আগ্রহ দেখিয়েছে।

প্রশ্ন

সূর্যের অভ্যন্তরীণ ছবি তোলা আপনার সাম্প্রতিক শখ। এটার শুরু কীভাবে হলো এবং এখন কোন পর্যায়ে আছে?

মুনীম রানা: মহাজাগতিক যেকোনো কিছু মানুষকে নাড়িয়ে দেয়। এমনই এক ঘটনা দেখা যায় গত বছরের ৮ এপ্রিল। যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো ও কানাডার নির্দিষ্ট কিছু স্থান থেকে পূর্ণ সূর্যগ্রহণ দেখা যায়। আমি সেই পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ দেখতে এক রোমাঞ্চকর যাত্রা করেছিলাম। এই সূর্যগ্রহণকে ‘গ্রেট আমেরিকান সূর্যগ্রহণ ২০২৪’ বলে নামকরণ করা হয়। সূর্যগ্রহণ যে পথে (প্রায় ২০০ মাইল) দেখা যাবে, সেই নির্দিষ্ট এলাকায় ৩ কোটি ২০ লাখের বেশি মানুষ এই গ্রহণ সরাসরি দেখতে পায়। সূর্যগ্রহণ দেখতে প্রায় ৫০০ মাইল পেরিয়ে ডালাস থেকে আরকানসর মাউন্টেন হোম এলাকায় ছুটে যাই আমি। সব মিলিয়ে তখন ১০ ঘণ্টার বেশি গাড়ি চালিয়ে সূর্যগ্রহণের বিরল অভিজ্ঞতা পাই আমি। তখন সূর্যের ছবি তুলতে আধুনিক একটি টেলিস্কোপ ব্যবহার করি। এই টেলিস্কোপ স্বয়ংক্রিয়ভাবে লক্ষ্যবস্তুকে অনুসরণ করতে পারে। এই কাজে নেক্সটার ৮এসই কম্পিউটারাইজড টেলিস্কোপ ব্যবহার করছি। ২০৩২ মিলিমিটার শ্মিডিট-ক্যাসাগ্রিন অপটিক্যাল ডিজাইনের এই টেলিস্কোপের ফোকাল লেন্থ ২০৩২ মিলিমিটার। এর সঙ্গে এক্লিপস স্মার্ট নামের ফ্লিটার ব্যবহার করি। এ ছাড়া ছবি তোলার জন্য ৬০০ মিলিমিটার লেন্সের ডিএসএলআর ক্যামেরা ব্যবহার করি। ক্যামেরার সঙ্গে ছিল ফিল্টার। নর্থ স্টারকে অনুসরণ করা একটা মাউন্ট ব্যবহার করি আমি।

প্রশ্ন

সূর্যের অভ্যন্তরের ছবি তোলার জন্য কী যান্ত্রিক সুবিধা লাগে? কেমন করে সূর্যের ভেতরকার ছবি তৈরি হয়?

মুনীম রানা: সূর্যগ্রহণের ছবি তোলার অভিজ্ঞতার পর থেকে আমি সূর্যের ছবি তোলা শুরু করি। বেশ কয়েকটি ছবি তুলি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছবিটি আমি ২০২৪ সালের ৬ নভেম্বর সম্পন্ন করি। সূর্যের ছবি তোলার কাজ করেছি আমার টেক্সাসের বাসার পেছনের আঙিনা থেকে। সূর্যের ক্রোমোস্ফিয়ার ও ফটোস্ফিয়ারের গভীরের ছবি তুলতে আমি ৭০ মিলিমিটার অ্যাপারচার ও ৪০০ ফোকাল লেন্থের বিশেষ ধরনের সোলার টেলিস্কোপ ব্যবহার করেছি। মডেলটির নাম ‘করোনাডো সোলার ম্যাক্স থ্রি আর ডাবল স্ট্যাক’। ফিল্টার ছিল হাইড্রোজেন আলফা। এই যান্ত্রিক সেটআপ সূর্যের পৃষ্ঠের সূক্ষ্ম বৈশিষ্ট্য যেমন সানস্পট, ফিলামেন্ট ও প্রমিনেন্স দেখতে বেশ সহায়ক। সূর্যের উজ্জ্বলতাকে ধরতে পারে। প্লেয়ার ওয়ান মার্স এম ক্যামেরা দিয়ে উচ্চ রেজল্যুশনে ছবি ধারণ করেছি, যেখানে শার্প ক্যাপ প্রো সফটওয়্যার ব্যবহার করে ছবিগুলো তুলতে হয়েছে। এরপর ৩০০০ ফ্রেম অটো স্ট্যাকার্ট দিয়ে স্ট্যাক করা হয়েছে, যা ছবির স্বচ্ছতা ও গভীরতা বাড়িয়েছে। আরও তীক্ষ্ণ করার জন্য আইএমপিপিজি ব্যবহার করেছি, অ্যাফিনিটি ফটো ভার্সন–২ এ টিউনিং করা হয়েছে। শেষ প্রক্রিয়ার কাজ করেছি লাইটরুম ক্ল্যাসিক ভার্সন ১৩.৩–এ। এসব যন্ত্র সূর্যের ছবি তোলায় সূর্যের সূক্ষ্ম ও জটিল বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তুলতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। সূর্যের সক্রিয় এলাকা হিসেবে যেকোনো ছবি তুলেছি, সেটি প্রক্রিয়াকরণ বেশ কঠিন ছিল। আর সব যন্ত্র যে সহজেই পাওয়া যায়, বিষয়টি এমন নয়। আমার দুটো হাইড্রোজেন আলফা প্রেশার টিউনড এটানল ফিল্টার বিশেষভাবে সংগ্রহ করি। এটা হাতে টিউন করতে হয় বলে সরবরাহকারীর প্রায় দুই মাস পর্যন্ত সময় লেগে যায় এটা দিতে। সূর্যের ছবি তোলা খুবই চ্যালেঞ্জিং। নক্ষত্র হিসেবে সূর্য থেকে প্রচুর তেজস্ক্রিয় আলো ও তাপ নির্গত হয়। খালি চোখে সূর্যের দিকে তাকানো ঠিক নয়। আর টেলিস্কোপে তো অবশ্যই নয়। তখন ক্যামেরা ও চোখ দুটোই নষ্ট হয়ে যাবে। বিশেষ ধরনের সোলার টেলিস্কোপ ও ক্যামেরা ব্যবহার করে সূর্যের ছবি তুলতে হয়।

আমি সূর্যের ক্রোমোস্ফিয়ার ও ফটোস্ফিয়ার এলাকার ছবি তুলেছি, যা সূর্যের ফটোস্ফিয়ার ও করোনার মধ্যবর্তী স্তরে অবস্থিত। এটি সূর্যের বাইরের দিকের একটি উজ্জ্বল, গোলাপি-লাল রঙের স্তর, যা সাধারণ অবস্থায় দেখা যায় না। পূর্ণ সূর্যগ্রহণের সময় এটি স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হয়। সূর্যের এই স্তর গঠিত মূলত হাইড্রোজেন গ্যাস দিয়ে। আর তাপমাত্রা ফটোস্ফিয়ারের তুলনায় বেশি। ফটোস্ফিয়ার ও ক্রোমোস্ফিয়ার পর্যবেক্ষণ করে বিজ্ঞানীরা সূর্যের চৌম্বকক্ষেত্র, তাপমাত্রার পরিবর্তন ও সৌরঝড়ের উৎপত্তি সম্পর্কে ধারণা নেওয়ার চেষ্টা করছেন। বিশেষ ফিল্টার ও সোলার টেলিস্কোপ দিয়ে আমি যে ছবি তুলেছি, সেখানে একদিকে যাওয়া (সাদা) লাভাস্রোতের মতো গ্যাসীয় অংশ দেখা যায়, যাকে ফ্লেয়ার বলে আর সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো যে আলোকস্রোত দেখা যাচ্ছে, তাকে প্রমিনেন্স বলে। মাঝের কালো অংশ সানস্পট ও করোনা হোল। যে ছবিটি তুলেছি, তা আসলে ৮ মিনিট ২০ সেকেন্ড আগের ছবি।

মুনীম হোসেন রানা
প্রশ্ন

ফিরে যাই নব্বইয়ের দশকে। আপনারা তিন বন্ধু গড়ে তুলেছিলনে একসিস লিমিটেড। দেশের প্রথম ইউপিএস তৈরি করেছিলেন আপনারা। সেটা কীভাবে এবং কেমন সাফল্য পেয়েছিলেন?

মুনীম রানা: আমি ১৯৮১ সালে নটর ডেম কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করি। এর আগে শেরেবাংলা নগর সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয় থেকে ১৯৭৯ সালে মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হই। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় আমি প্রথম রেডিও বানাই। আমার বেড়ে ওঠা আগারগাঁও এলাকায়। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে ১৯৮৫ সালে স্নাতক ডিগ্রি নিই। বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে আমরা তিন বন্ধু দ্য একসিস নামের একটি প্রতিষ্ঠান চালু করি। ১৯৮৫ সাল থেকেই ঢাকায় আমি কম্পিউটার নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করি। তখন ঢাকায় ইউএসএইডের একজন কর্মকর্তা ছিলেন, নাম বব টুরিন। তাঁর কম্পিউটার ছিল। তখন ঢাকায় কম্পিউটার যন্ত্রাংশ পাওয়া যেত না। বব ঢাকায় একটি কম্পিউটার ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন। মাগমিড মাইক্রো ইউজার্স গ্রুপ মিটিং (মাগমিট) নামের সেই ক্লাব থেকে প্রতি মাসে আমরা আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে একবার করে বসতাম। আমরা সেই ১৯৮৬ সালের শুরুর দিকে দেশের প্রথম কম্পিউটার মেলার আয়োজন করি সেখানে। এভাবেই কম্পিউটার নিয়ে আগ্রহ শুরু হয় আমার। ধীরে ধীরে ১৯৮৮ সালে আমরা তিন বন্ধু মিলে একসিস শুরু করি। আমি, আজহারুল মান্নান (প্রয়াত) ও ইকবাল আহমেদ—তিনজনেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি। আমরা ছোটবেলা থেকেই বন্ধু। আমরা ছোটবেলায় বিজ্ঞান ক্লাব করতাম। বিভিন্ন বিজ্ঞান ক্লাব, বিজ্ঞান উৎসবে অংশ নিতাম। ১৯৮১ সালে আমি একটি বিজ্ঞান প্রকল্প করি। পুরো ঢাকা শহরের জন্য একটি ট্রেন ডিজাইন করি আমি। মডেল সেই ট্রেনের নমুনা প্রথম হয়। সেই ট্রেন পুরো শহরে ঘুরবে আর যাত্রী পরিবহন করবে। সেই ট্রেনের ভিডিও একসময় বিটিভির সংবাদের শুরুতে দেখানো হয়েছে অনেক বছর। আমরা কম্পিউটার নিয়ে কাজ শুরুর সময় দেশের বিদ্যুৎ–সেবার অবস্থা তেমন ভালো ছিল না। ইউপিএস (আনইন্টারাপ্টড পাওয়ার সাপ্লাই) তখন বিদেশ থেকে দুই-তিনটি প্রতিষ্ঠান নিয়ে আসত। যদিও সেসব ইউপিএস ১০-২০ মিনিট ব্যাকআপ দিত। বাংলাদেশের বাস্তবতায় আমাদের অনেক সময়ের জন্য ইউপিএস দরকার ছিল। আজহারুল মান্নানের থিসিস ছিল আইপিএস (ইনস্ট্যান্ট পাওয়ার সাপ্লাই) নিয়ে। পরে আমরা সেই আইপিএসকে পরিবর্তন করে একসিসের মাধ্যমে ইউপিএস তৈরি করি। দেশের প্রথম ইউপিএস তৈরি হয়। সেটা বাজারে বেশ চাহিদা তৈরি করে। আমাদের ইউপিএসের নাম ছিল পাওয়ার প্রসেসর। ক্ষমতা ছিল ১০০০ ভিএ। এটি সাড়ে তিন ঘণ্টা ব্যাকআপ দিতে পারত। দ্রুত জনপ্রিয়তা পায় এই দেশি ইউপিএস। সেই সময়ে ১০০০ ভিএ ইউপিএস আমরা বিক্রি করতাম ১৬ হাজার টাকায়। এরপর ৭৫০ভিএ থেকে ২ কেভিএ পর্যন্ত ক্ষমতার ইউপিএস বাজারজাত করি আমরা। আমাদের শিক্ষকেরা বিভিন্ন আয়োজনে নিয়ে যেতেন আমাদের। তখন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের (বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারে প্রধান উপদেষ্টা) আমাদের শিক্ষকেরা নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর জন্য কম্পিউটার বানানোর জন্য। আমাদের সঙ্গে তখন ফিলিপস যোগাযোগ করে। আমাদের ইউপিএস প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করে তারা। তবে আমরা ব্যবসা করতে আগ্রহী ছিলাম না, পরে আর কাজটি এগোয়নি।

প্রশ্ন

ইন্টারনেট নিয়েও তো কিছু করেছিলেন...

মুনীম রানা: ১৯৮৮-৯৯ সালে দেশে ইন্টারনেট চালুর আগে ঢাকা-কুমিল্লা কম্পিউটার থেকে কম্পিউটার সংযোগ করি। তখন কুমিল্লা প্রশিকায় কাজ করতেন মুজিবুর রহমান স্বপন। তাঁর সহযোগিতায় ঢাকা–কুমিল্লা কম্পিউটার সংযোগে সফল হই। এমনিতে নিজেরা বঙ্গভবনে লোকাল এরিয়া নেটওয়ার্ক (ল্যান) সংযোগ তৈরি করি। দুটি কম্পিউটার দিয়ে ওয়ার্কস্টেশন তৈরি করি আমরা। তখন কোনো তার পাওয়া যেত না। ক্যানন প্রিন্টারের তার কেটে ওয়ার্কস্টেশন তৈরি করি, দুই কম্পিউটারের মধ্যে সংযোগ ঘটাই। মডেম দিয়ে অনেক পরীক্ষা চালাই। মডেম থেকে মডেম সংযোগ তখনকার টেলিফোন সংযোগ ব্যবহার করে কম্পিউটার-কম্পিউটার সংযোগ তৈরি করি। তখনো কিন্তু ইন্টারনেট চালু হয়নি। আমরা বাংলা ম্যাগাজিন তৈরির জন্য বর্ণ সফটওয়্যারসহ নানা কিছু নিয়ে কাজ করি। ইশতিয়াক কাশেম নামের এক চিকিৎসক বন্ধু ছিলেন আমার, চিকিৎসক হলেও প্রযুক্তি নিয়ে আগ্রহী ছিল। তাঁর বাবা তখনকার টিঅ্যান্ডটির বড় কর্মকর্তা। তাঁর বাসা থেকে আমরা বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সংযোগ স্থাপনে সফল হয়েছিলাম। জীবনে এমন অনেক পরীক্ষা চালিয়েছি আমরা।

প্রশ্ন

যুক্তরাষ্ট্রে কবে গেলেন? বাংলাদেশের ব্যবসা গুটিয়ে ফেললেন কেন?

মুনীম রানা: আমি ১৯৯৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে পিসি শো–৯৫ প্রযুক্তি মেলায় বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে গিয়েছিলাম। পরে আমি ২০০০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাই। প্রযুক্তি বনাম ব্যবসার বিতর্কে আমি প্রযুক্তি নিয়ে আগ্রহী ছিলাম। যে কারণে পরে আমি প্রযুক্তি নিয়ে আরও কাজ করতে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাই। আমি সে বছর লাস ভেগাসের কমডেক্স মেলায় অংশ নিই। বাংলাদেশ স্টলের তৈরির দায়িত্ব ছিল আমরা। আমরা ঢাকা থেকে স্টল বানিয়ে নিয়ে যাই যুক্তরাষ্ট্রে বিমানে করে। কুঁড়েঘরের মধ্যে কম্পিউটার ব্যবহার করছি—এমন একটি মডেল উপস্থাপন করি আমরা। সত্যিকারের কুঁড়েঘর নিয়ে যাই যুক্তরাষ্ট্রে। সেই কুঁড়েঘর দেখতে অনেকেই মেলায় ভিড় করে। আমাদের স্বপ্ন ছিল কুঁড়েঘরে বসে কোডিং করব—সেই স্বপ্ন তো এখন বাস্তব।

প্রশ্ন

শহীদ রাজুর বড় ভাই আপনি। টিএসসির সড়কদ্বীপের ঐতিহাসিক রাজু ভাস্কর্যের মডেলও আপনি। রাজু সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন।

মুনীম হোসেন: আমার ছোট ভাই মঈন হোসেন রাজু। ১৯৯২ সালের ১৩ মার্চ মারা যায়। রাজু প্রকৃতিপ্রেমী ছিল, যুদ্ধের বিরুদ্ধে কথা বলত। শহীদুল্লাহ্‌ হলে থাকত রাজু, ছাত্ররাজনীতি করত। সন্ত্রাসবিরোধী পদক্ষেপ নেয় রাজু। জাগাও বিবেক, রুখো সন্ত্রাস—এমন সব স্লোগানে প্রতিবাদ করত রাজু। ১৩ মার্চ দুই গ্রুপের মারামারির মধ্যে মারা যায় রাজু। ছাত্র ঐক্য নামের সংহতির নেতৃত্ব দেওয়ার সময় গুলিতে মারা যায় রাজু। পরবর্তী সময়ে রাজু ভাস্কর্য তৈরি হয়। সেই ভাস্কর্যের রাজুর অবয়ব নেওয়া হয় আমার চেহারা থেকে। সন্ত্রাসবিরোধী রাজু স্মারক ভাস্কর্য নির্মাণে জড়িত শিল্পীরা ছিলেন ভাস্কর শ্যামল চৌধুরী ও সহযোগী গোপাল পাল। ১৯৯৭ সালে ভাস্কর্য উদ্বোধন করা হয়।

প্রশ্ন

চব্বিশের আগস্ট–পরবর্তী বাংলাদেশে তরুণদের নিয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাওয়ার জন্য কী করা যেতে পারে?

মুনীম রানা: নতুন বাংলাদেশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার অনেক সুযোগ আছে। হৃদয়ে অনুপ্রেরণা তৈরি করতে হবে। আমার জীবন থেকে দেখেছি, পড়াশোনা সব না। হৃদয়ে অনুপ্রেরণা থাকতে হবে। দেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর পরিবেশ তৈরি করতে হবে। মনোযোগ বাড়াতে হবে অনেক। আমাদের ছোটবেলায় একটা কিছু নিয়ে লেগে থাকলে তার সব দেখে ছাড়তাম। এখনকার তরুণদের মধ্যে এমন আগ্রহ তৈরি করতে হবে। আমাদের মহাকাশ গবেষণা নিয়ে সামনে কাজের অনেক সুযোগ আছে।

প্রশ্ন

আপনার কাজ ও শখ নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?

মুনীম রানা: সব সময়ই আমার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নিয়ে আগ্রহ। আমার জীবনের দিকে তাকালে দারুণ সব সংযোগ খুঁজে পাই। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক যত কাজ করেছি জীবনে তার সবই এক সংযোগে এগিয়ে যাচ্ছে। আমি সবখানেই প্রকৃতি ও জীবনের সংযোগ বিজ্ঞানের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করি। সবকিছুই তৈরি হয়েছে দারুণ কোনো কাজের জন্য। আমি পুরো জীবনটাই রেডিও ও ক্যামেরা দিয়ে কাটিয়ে দিয়েছি, সামনে এসব অভিজ্ঞতা বইয়ে প্রকাশ করতে চাই।