ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপের মূল প্রতিষ্ঠান মেটা এবার নিজেদের তথ্য–উপাত্ত বা ডেটা পরিবহন অবকাঠামো আরও শক্তিশালী করতে নতুন পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, মেটা একটি ৪০ হাজার কিলোমিটারের বেশি দীর্ঘ সাবমেরিন ফাইবার অপটিক কেব্ল নেটওয়ার্ক পরিকল্পনা করছে। এই প্রকল্পের সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার কোটি মার্কিন ডলারের বেশি।
সাবমেরিন কেব্ল নেটওয়ার্ক নির্মাণে এটাই হবে মেটার প্রথম একক মালিকানাধীন উদ্যোগ। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে প্রতিষ্ঠানটির অ্যাপ ও পরিষেবাগুলোর ডেটা পরিবহনব্যবস্থায় এক নতুন মাত্রা যোগ হবে।
মেটা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ইন্টারনেট ব্যবহারকারী। প্রতিষ্ঠানটির সেবা ও এর বিপুলসংখ্যক ব্যবহারকারী বিশ্বব্যাপী মোট স্থায়ী ইন্টারনেট ট্র্যাফিকের ১০ শতাংশ এবং মোবাইল ট্র্যাফিকের ২২ শতাংশ ব্যবহার করে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ আরও বাড়ালে এ ব্যবহার আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই সেবা নিশ্চিত করতে এবং নির্ভরযোগ্য অবকাঠামো গড়ে তুলতে মেটা এবার নিজস্ব ইন্টারনেট সঞ্চালন কাঠামো তৈরির পরিকল্পনা করেছে।
সাবমেরিন কেব্ল–বিশেষজ্ঞ সুনীল টাগারে প্রথম এই প্রকল্পের খবর দেন। তাঁর মতে, প্রথম পর্যায়ে এই প্রকল্পে ২০০ কোটি ডলারের বাজেট ধরা হলেও এটি বাস্তবায়নের সময় খরচ বেড়ে এক হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। তবে মেটার ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো জানিয়েছে, প্রকল্পটি এখনো পরিকল্পনার পর্যায়ে রয়েছে। ২০২৫ সালের শুরুর দিকে মেটা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকল্পের রুট, সক্ষমতা এবং এর প্রয়োজনীয়তার কারণ ব্যাখ্যা করতে পারে।
প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী, সাবমেরিন কেব্ল যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূল থেকে শুরু হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা হয়ে ভারতে পৌঁছাবে। সেখান থেকে অস্ট্রেলিয়া হয়ে এটি যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম উপকূলে ফিরে আসবে। রুটটি এমনভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে, যাতে ভূরাজনৈতিক উত্তেজনাপূর্ণ অঞ্চল যেমন লোহিত সাগর, দক্ষিণ চীন সাগর এবং অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা এড়ানো যায়।
বিশ্বজুড়ে ইন্টারনেট ডেটা পরিবহনের জন্য চার দশক ধরে সাবমেরিন কেব্ল একটি গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। তবে এ ধরনের কেব্লের মালিকানা সাধারণত টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠানের কাছে সীমাবদ্ধ ছিল। মেটার এই উদ্যোগ প্রমাণ করে বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো এখন নিজেদের ডেটা অবকাঠামো নিয়ন্ত্রণে আরও সক্রিয় হচ্ছে।
মেটার সাবমেরিন কেব্ল প্রকল্প গ্রহণের পেছনে কয়েকটি বড় কারণ রয়েছে।
১. ডেটা পরিবহনে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ: মেটার ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহারকারীর সংখ্যা বিশ্বব্যাপী কয়েক শ কোটি। এই নেটওয়ার্ক তৈরি করে প্রতিষ্ঠানটি ডেটা পরিবহনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারবে।
২. ভূরাজনৈতিক ঝুঁকি কমানো: সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সাবমেরিন কেব্ল বিভিন্ন সংঘাতের শিকার হয়েছে। লোহিত সাগর, দক্ষিণ চীন সাগর এবং মালাক্কা প্রণালির মতো ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলগুলো এড়িয়ে মেটার নির্ধারিত রুট ডেটা পরিবহনে আরও নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।
৩. ভারতের প্রতি কৌশলগত মনোযোগ: ভারতে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপের ব্যবহারকারীর সংখ্যা বিশ্বে সর্বোচ্চ। এ ছাড়া ভারতে তুলনামূলক কম খরচে ডেটা সেন্টার নির্মাণ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) মডেল প্রশিক্ষণের সুযোগ রয়েছে। মেটার পরিকল্পনা অনুযায়ী, এই কেব্ল ভারতে প্রতিষ্ঠানটির ডেটা অবকাঠামো আরও শক্তিশালী করতে সহায়ক হবে।
৪. অর্থনৈতিক গুরুত্ব: মেটার আয়ের বেশির ভাগই উত্তর আমেরিকা মহাদেশের বাইরে থেকে আসে। নিজস্ব কেব্ল থাকলে সেসব অঞ্চলে সেবা প্রদানের মান আরও উন্নত হবে।
বিশ্বে সাবমেরিন কেব্ল নেটওয়ার্ক নির্মাণে সক্ষম প্রতিষ্ঠানগুলোর সংখ্যা সীমিত এবং তারা অধিকাংশই বড় প্রকল্পে ব্যস্ত। ফলে মেটার এই প্রকল্প বাস্তবায়নে কয়েক বছর সময় লাগতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই নেটওয়ার্ক কয়েক ধাপে নির্মাণ করা হতে পারে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে মেটা বৈশ্বিক ডেটা পরিবহনব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে সক্ষম হবে। মেটা এই বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানালেও ধারণা করা হচ্ছে ২০২৫ সালের শুরুর দিকে প্রকল্পের বিস্তারিত পরিকল্পনা প্রকাশ করা হবে।
সূত্র: টেকক্রাঞ্চ