‘বাংলাদেশ ২.০’ ধারণায় বৈষম্যহীন ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে নতুন বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ খাত হতে পারে ই-কমার্স। এ খাতের মাধ্যমে শহর-গ্রামের বৈষম্য কমিয়ে মেধাবী মানবসম্পদ ও তাদের সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগানো সম্ভব। এর যথেষ্ট প্রমাণও আমাদের হাতে রয়েছে। গ্রামে বসেও একজন তরুণ অনলাইনভিত্তিক ই-কমার্সের মাধ্যমে সারা দেশের ভোক্তাদের কাছে তাঁর পণ্য পৌঁছে দিতে পারছেন। বিশেষ করে ঢাকার বাইরে কৃষিভিত্তিক ই-কমার্স উদ্যোগের সংখ্যা বাড়ছেই। এরই মধ্যে দেশীয় শিল্পের বিকাশ, উদ্যোক্তা তৈরি এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে এই খাত জাতীয় অর্থনীতির অগ্রগতিতে ভূমিকা পালন করছে। তবে ই-কমার্স খাতে উল্লেখযোগ্য কিছু চ্যালেঞ্জ এখনো রয়ে গেছে।
ই-কমার্স কার্যক্রম ইন্টারনেটের ওপর পুরোটাই নির্ভরশীল। শহর বা গ্রাম সব জায়গায় দ্রুতগতির ইন্টারনেট নিশ্চিত করা জরুরি। দ্রুতগতির ইন্টারনেট সংযোগ পাওয়ার বাধা দূর করলে গ্রাম ও শহরে অনেক উদ্যোক্তা তৈরি হবে। পাশাপাশি সুলভ মূল্যে ইন্টারনেট সংযোগপ্রাপ্তি ই-কমার্স ব্যবসাকে আরও ত্বরান্বিত করবে।
ই-কমার্স উদ্যোক্তারা যাতে সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ পায় সেটিও নিশ্চিত করতে হবে। এর ফলে ই-কমার্স উদ্যোক্তারা তাঁদের ব্যবসাকে আরও এগিয়ে নিতে পারবেন। গত মাসে ইন্টারনেট ব্ল্যাক আউটের ঘটনায় ই-কমার্স উদ্যোক্তারা সব চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ই-কমার্স ব্যবসা একেবারে স্থবির হয়ে পড়েছিল। এসব বিবেচনায় তাঁদের স্বল্প সুদে ঋণসুবিধা দেওয়া এবং ক্ষয়ক্ষতির বিবেচনায় ব্যাংকঋণ পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানো জরুরি। এ ছাড়া ভ্যাট ও ট্যাক্সসংক্রান্ত বিষয়গুলোয় ই-কমার্স খাতসংশ্লিষ্ট নীতিমালা সহজ ও বোধগম্য করতে হবে।
ই-কমার্স খাতে ব্যক্তিগতভাবে আমার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা রয়েছে। অনলাইন খাবার সরবরাহ অ্যাপ ফুড প্যান্ডাকে শুধু একটি ধারণা থেকে সফল স্টার্টআপে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছি। দেশের ই-কমার্স খাতকে আরও বৃহৎ পরিসরে নিয়ে যেতে এই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে চাই। বর্তমানে ই–কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ—ইক্যাবের কার্যনির্বাহী কমিটির সহসভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। ই-কমার্স খাতের উন্নয়নের জন্য কিছু পরিকল্পনা তুলে ধরছি।
একটি পূর্ণাঙ্গ স্টার্টআপ একাডেমি তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। যেসব উদ্যোক্তারা স্টার্টআপ নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী তারা এই একাডেমির মাধ্যমে দেশি ও বিদেশি ভেঞ্চার ক্যাপিটাল (ভিসি) ও অ্যাঞ্জেল ইনভেস্টরদের থেকে তহবিল গঠন, ক্রাউড ফান্ডিং, ব্যবসার পরিসর বাড়ানো, বিভিন্ন প্রতিযোগিতা থেকে তহবিল সংগ্রহ এবং কীভাবে বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে এ সংক্রান্ত পরামর্শ পাবেন।
ই-কমার্স খাতের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের (এমএমই) ব্যবসায় সম্প্রসারণের জন্য লজিস্টিকস ব্যবস্থাপনা, ডিজিটাল বিপণন, ইনভেন্টরি ম্যানেজমেন্ট, ক্রাউড ফান্ডিং, ডেটা অ্যানালাইসিসসহ বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষতা বাড়াতে ই–ক্যাব থেকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এ ছাড়া ই-কমার্স খাতের বিকাশের জন্য গ্রাহক ও উদ্যোক্তা উভয় পর্যায়েই ডিজিটাল স্বাক্ষরতা নিয়ে ব্যাপক কাজ করা যেতে পারে।
ই-কমার্সই একমাত্র খাত যা ব্যবসায় ‘লেভেল প্লেয়িং অব ফিল্ড’ নিশ্চিত করতে পারে। এ জন্য প্রয়োজন সহজলভ্য ও নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সংযোগ। বাংলাদেশের ই-কমার্স খাতকে এগিয়ে নিতে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে কিছু সুপারিশ রয়েছে।
প্রথমত, নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সংযোগ জরুরি। ই-কমার্স কার্যক্রমের মূলভিত্তি হলো সহজে গ্রাহকের ইন্টারনেট প্রাপ্তি। সুলভে দ্রুতগতির ইন্টারনেট ছাড়াই ই-কমার্স কার্যক্রম সফল হওয়া সম্ভব নয়। ইন্টারনেটকে এখন ‘পাবলিক ইউটিলিটি’ হিসেবে ঘোষণা করার সময় এসেছে, যেন এটি কখনো বন্ধ না হয়।
দ্বিতীয়ত, সবার ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে স্মার্টফোন ব্যবহারের ওপর বিশেষ জোর দেয়া উচিত। স্মার্টফোন আমদানি ও স্থানীয় উৎপাদনে শুল্ক কমানোর পাশাপাশি স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য ভর্তুকির ব্যবস্থা করা উচিত।
তৃতীয়ত, নগদ অর্থের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে ডিজিটাল লেনদেনকে উৎসাহিত করতে হবে। প্রয়োজনে গ্রাহক ও ব্যবসায়ীদের জন্য ভর্তুকি দেওয়া উচিত।
চতুর্থত, অনলাইননির্ভর ক্ষুদ্র ব্যবসা ও রেস্তোরাঁগুলো ই-কমার্স ব্যবস্থার মেরুদণ্ড। এ ধরনের ব্যবসাগুলোকে সুদমুক্ত ও বিনা জামানতে ঋণ দিলে জাতীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখা যাবে।
পঞ্চমত, স্টার্টআপ সংস্কৃতি উন্নয়নে মেন্টরশিপ ব্যবস্থা, উন্নত ডিজিটাল অবকাঠামো, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির নীতি সহজ করা এবং কর প্রণোদনা প্রদান করা জরুরি। এটাও খেয়াল রাখতে হবে যে, সরকারি সহায়তার সিদ্ধান্ত যেন রাজনৈতিক বিবেচনায় গ্রহণ না করা হয়।
এই পদক্ষেপগুলো গ্রহণের মাধ্যমে আমরা দেশের ই-কমার্স খাতকে আরও শক্তিশালী ও গতিশীল করতে পারব।
বিগত সরকারের সময় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ডিজিটাল কমার্স অথোরিটি অ্যাক্ট ২০২৩ চূড়ান্ত করেছে। তবে ই-কমার্সে বিদ্যমান আইন ও নীতিমালার যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে এ খাতকে নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ রয়েছে। ফলে এই আইন পুনরায় পর্যালোচনার জন্য বিবেচনা করা করা যেতে পারে।
ই-কমার্স খাতের বিকাশে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে হবে। লাইটক্যাসল পার্টনারসের ‘বাংলাদেশ স্টার্টআপ ইনভেস্টমেন্ট রিপোর্ট ২০২৪’ অনুযায়ী, ২০২৪ সালের প্রথমার্ধে দেশে মাত্র ১ কোটি ৯০ লাখ মার্কিন ডলার বিনিয়োগ এসেছে, যা আগের বছরের থেকে ৫৭ শতাংশ কম। এ থেকে উত্তরণে কর-সংক্রান্ত জটিলতা, নীতিমালাগত অনিশ্চয়তা এবং ট্রেড লজিস্টিকস ও কাঠামোগত দুর্বলতা দূর করতে হবে। উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে দক্ষতা ও উদ্ভাবনের বিকাশ ঘটাতে হবে।
সর্বোপরি, অন্তর্বর্তী সরকারের কাছ থেকে আমরা ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ ও সহায়ক নীতিমালা প্রত্যাশা করছি, যা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে সমর্থ হবে।
সৈয়দা আম্বারীন রেজা: ই–ক্যাবের সহসভাপতি এবং ফুড প্যান্ডার সহপ্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক