সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে আজ থেকে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। অসহযোগের প্রথম দিনেই আজ রোববার সারা দেশ রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। সন্ধ্যা পর্যন্ত ৯০ জন মানুষ নিহত হওয়ার সংবাদ পাওয়া গেছে। এ পরিস্থিতিতে আজ বেলা ১২টার দিকে মোবাইল সংযোগদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে (অপারেটর) ফোর-জি ইন্টারনেট সেবা বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে সরকার। তবে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট চালু রাখা হয়।
এরপর মেটার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, বার্তা আদান–প্রদানের অ্যাপ মেসেঞ্জার ও হোয়াটসঅ্যাপ বন্ধের নির্দেশও দেয় সরকারি একটি সংস্থা। আজ বেলা একটার পর ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি) প্রতিষ্ঠানগুলোকে এ নির্দেশ দেওয়া হয়।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ-সংঘাতের জেরে গত ১৭ জুলাই রাত থেকে মোবাইল ইন্টারনেট ও ১৮ জুলাই রাতে দেশে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। পাঁচ দিন পর গত ২৩ জুলাই ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ সীমিত পরিসরে ফিরে আসে। আর ১০ দিন পর গত ২৮ জুলাই মোবাইল ইন্টারনেট চালু হয়। কিন্তু বন্ধ ছিল ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম ও টিকটক। ৩১ জুলাই বেলা দুইটার পর থেকে বাংলাদেশে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো চালু করা হয়। আবার গত শুক্রবার দুপুরে মোবাইল নেটওয়ার্কে মেটার প্ল্যাটফর্মগুলোর ক্যাশ বন্ধ করা হয়। পাশাপাশি মোবাইলে টেলিগ্রাম অ্যাপও বন্ধ করা হয়। সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার পর তা আবার চালু করা হয়েছিল।
কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু আন্দোলন বাড়তি বল প্রয়োগে দমন করার পাশাপাশি এবার ‘ইন্টারনেট ক্র্যাকডাউন’ চালানো হচ্ছে। যা সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার অনেক কিছুকেই ব্যাহত করেছে। গ্যাস-বিদ্যুতের প্রিপেইড মিটার রিচার্জও করতে হয় ইন্টারনেটের মাধ্যমে। প্রিপেইড মিটারের ব্যালান্স শেষ হয়ে অনেকের বাসাই বিদ্যুৎ ও গ্যাসহীন হয়ে পড়ে। প্রথম দফার ইন্টারনেট ক্র্যাকডাউনে কারফিউয়ের মধ্যে গ্যাস ও বিদ্যুতের কার্যালয়ে গিয়ে মানুষকে প্রিপেইড মিটার রিচার্জ করতে হয়েছে। মোবাইল ব্যাংকিং, এটিএম সেবাও ব্যাহত হয়েছে ইন্টারনেট বন্ধ রাখার কারণে।
ইন্টারনেট যে এখন জীবনযাপনের অনিবার্য অংশ, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। বর্তমান সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়ন করে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের দাবি করছে। এ ধারণার লাইফলাইন হলো ইন্টারনেট। সাধারণ মানুষের যেমন প্রয়োজন ইন্টারনেট, তেমনি এই প্রযুক্তি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কর্মকাণ্ডের চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে।
তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) খাতে এখন দেশের প্রায় সাড়ে ছয় লাখ তরুণ মুক্ত পেশাজীবী বা ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করেন। এঁদের কাজটা শতভাগ ইন্টারনেটনির্ভর। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাঁরা দেশে বসে বিদেশের গ্রাহকদের কাজ করে দেন ইন্টারনেটের মাধ্যমে।
গতকাল শনিবার প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, এক সপ্তাহেরও বেশি ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ থাকায় বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সাররা। ইন্টারনেট না থাকায় সারা দেশের ফ্রিল্যান্সাররা বিদেশ থেকে গ্রাহক বা বায়ারের পাঠানো বার্তার উত্তর দিতে পারেননি। আবার কারও কারও কাজ জমা দেওয়ার সময় পেরিয়ে হয়ে গেছে। ফ্রিল্যান্সাররা প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘আমাদের কথা কাকে বলব, কে শুনবে? আমাদের ক্ষতিটা আমরা বোঝাতে পারছি না। আমরা হারিয়ে যাচ্ছি, আমাদের কাজগুলো অন্য দেশে চলে যাচ্ছে।’
দেশের ফ্রিল্যান্সাররা কাজ করে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা (রেমিট্যান্স) আনেন। ইন্টারনেট বন্ধ করে রাখলে বা গতি কমিয়ে দিলে তাঁরা কাজটাই করতে পারেন না। ঢাকার একজন ফ্রিল্যান্সার তৌহিদুর রহমান বলেছেন, ‘আর একবার ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট হলে ফ্রিল্যান্সাররা পথে বসে যাবেন। প্রথমবারেই অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বুঝিয়ে বলেছি, কিছু বায়ার শুনেছেন কিন্তু অন্যরা চলে গেছেন। আবার যদি ইন্টারনেট বন্ধ রাখা হয় বা গতি কমিয়ে দেওয়া হয়, তবে বাংলাদেশের নাম শুনলেই বায়াররা আর আগ্রহ দেখাবে না।’
ফ্রিল্যান্সিং কাজের মূল ব্যাপারটাই হলো বিদেশে গ্রাহকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা, চাহিদামতো কাজ সম্পন্ন করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ বুঝিয়ে দেওয়া। গ্রাহকদের আস্থা অর্জন করতে, মার্কেটপ্লেসে নিজের প্রোফাইল সমৃদ্ধ করতে একজন ফ্রিল্যান্সারের বছরের পর বছর সময় লাগে। ইন্টারনেট না থাকার যোগাযোগহীনতায় তাঁদের গ্রাহক ছুটে যায়, আর তাঁদের কাজের পারিশ্রমিক হিসেবে বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসে না। বড় কথা হলো আন্তর্জাতিক গ্রাহকের আস্থা চলে যায় বাংলাদেশের ওপর থেকে। আজ আবার ইন্টারনেট ক্র্যাকডাউন হওয়ার পর একজন ফ্রিল্যান্সার ফেসবুকে একটি বার্তায় লিখেছেন, ‘ইন্টারনেট যেহেতু নেই, সেহেতু আমার প্রতিষ্ঠানের সবাই কালকে রাস্তায় থাকবে। আমার প্রতিষ্ঠানের ৮০ জনের কালকের অফিস হবে রাস্তায়...।’
ই-কমার্স এবং ফেসবুকনির্ভর এফ-কমার্স উদ্যোক্তারাও ইন্টারনেট না থাকায় অসহায়ত্ব বোধ করছেন। গুজব ঠেকাতে সরকার ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করে দেয়। কিন্তু এই ফেসবুকে পেজ অনেকের মূল জীবিকা। বাড়তি আয় হিসেবে নয় ফেসবুকভিত্তিক অনেক উদ্যোগ একেকটি পরিবারের মূল আয়ের উৎস। ফেসবুকে লাখ লাখ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা। এঁদের একটা বড় অংশ নারী। দিন আনি দিন খাই—এমন অবস্থাও অনেকের। ফেসবুক বন্ধ থাকলে তাঁদের দিন চলে কীভাবে?
দেশের আইসিটি শিল্পের সফটওয়্যার ও তথ্যপ্রযুক্তি সেবা খাতও পুরো ইন্টারনেটনির্ভর। আইসিটি শিল্পের জীবনরেখাই হলো ইন্টারনেট। আর কলসেন্টারসহ বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং (বিপিও) পুরোটাই ইন্টারনেটনির্ভর। বাংলাদেশে রপ্তানিমুখী সফটওয়্যার ও তথ্যপ্রযুক্তি সেবা খাতের বাজার এখন বছরে ৫০ কোটি মার্কিন ডলার। অভ্যন্তরীণ বাজার ১০০ কোটি ডলারের মতো। সব মিলিয়ে আইসিটি শিল্পে দেশে প্রায় চার লাখের মতো মানুষ এখন কাজ করেন। ইন্টারনেটের এমন আসা-যাওয়ার খেলা চলতে থাকলে আইসিটি খাতের অপমৃত্যু ঠেকানো যাবে না।
কোনো অবস্থায়ই ইন্টারনেট বন্ধ রাখার সুযোগ এখন নেই। ইন্টারনেট বন্ধ থাকলে দেশের অর্থনীতি, দেশের ভাবমূর্তিতে দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তাই স্বাভাবিক ইন্টারনেটের গ্যারান্টি চাই। মোবাইল ও ব্রডব্যান্ড—দুই ধরনের ইন্টারনেটই এক মিনিটের জন্যও বন্ধ রাখা যাবে না।
পল্লব মোহাইমেন: সাংবাদিক ও প্রথম আলো হেড অব নিউ ইনিশিয়েটিভ