আলাদিনের চেরাগের গল্প তো সবারই কমবেশি জানা। ওই যে আরব্য রজনীর গল্পে চেরাগের দৈত্যের কাছে আলাদিন তিনটি ইচ্ছার কথা প্রকাশ করে, আর দৈত্য তা অনুসরণ করে। এমনই এক গাছের কথা চিন্তা করুন। যাকে আপনি যে ফল খেতে চান বললেই তা এনে দেবে! গাছ কি বাস্তবে আপনার কথা শুনবে?
আরব্য রজনীর গল্পের মতো করেই গাছের সঙ্গে কথা বলার নতুন এক কৌশল উদ্ভাবন করেছেন গবেষকেরা। নতুন এক যন্ত্রের কৌশল উদ্ভাবন করা হয়েছে, যার মাধ্যমে মানুষের কথা শুনতে পারবে গাছপালা। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্সবারি ল্যাবরেটরির উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা এই যন্ত্র তৈরি করেছেন। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির মতো শোনালেও এ রকম যন্ত্র তাঁরা উদ্ভাবন করেছেন। আলোভিত্তিক বার্তা ব্যবহারের মাধ্যমে কথা বলার উপায় বের করেছেন তাঁরা।
প্রাথমিকভাবে পরীক্ষাগারে উদ্দীপক হিসেবে তামাকের মৃদু ব্যবহার করা হয়। এর মাধ্যমে উদ্ভিদের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সক্রিয় করার বিষয়টি জানা যায়। একটি বার্তাবাহক হিসেবে গবেষকেরা এমন যন্ত্র তৈরি করছেন, যা ফসলের সঙ্গে মানুষের কথা বলার সুযোগ করে দেবে।
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী আলেকজান্ডার জোনস বলেন, বিষয়টা অনেকটা পথচারী পারাপারের জন্য রাস্তায় সংকেত ব্যবহারের মতো। চলন্ত রাস্তায় পথচারীরা সংকেত দেখে যেমন সিদ্ধান্ত নেন, তেমনি গাছেরাও সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আমরা আসন্ন একটি রোগের প্রাদুর্ভাব বা কীটপতঙ্গের আক্রমণ সম্পর্কে ফসলকে সতর্ক করতে পারি। এতে ফসল নিজে থেকে ব্যাপক ক্ষতি রোধ করতে তাদের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সক্রিয় করতে পারে। গাছপালাকে চরমভাবাপন্ন আবহাওয়ার বিষয়ে যেমন, তাপপ্রবাহ বা খরার বিষয়েও জানানো যায়। এতে তারা তাদের রক্ষায় পানি সংরক্ষণসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা নিতে পারে। এই পদ্ধতিতে আরও দক্ষ ও টেকসই কৃষিব্যবস্থা চালু করা যায়, যার মাধ্যমে রাসায়নিকের ব্যবহার কমানো যেতে পারে।
কেমব্রিজ গবেষকেরা জৈব সেন্সরের মাধ্যমে আগে গবেষণা করেন। জৈব ও রাসায়নিক বিক্রিয়া পরিমাপ করে ফ্লুরোসেন্টের ব্যবহার করে শস্যের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। এই বায়োসেন্সর ফসলের পরিবেশগত চাপের প্রতি প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে ধারণা দেয়।
নতুন গবেষণায় হাইলাইটার নামের একটি যন্ত্রের কথা বলা হয়েছে। এই যন্ত্র ফসলে একটি নির্দিষ্ট জিন সক্রিয় করতে বিশেষ পরিস্থিতি ব্যবহার করে। প্রকৌশলী বো লারসেন আলো-নিয়ন্ত্রিত জিন এক্সপ্রেশন সিস্টেম নামের এই ব্যবস্থা উদ্ভাবন করেন, যা অপটোজেনেটিকস সিস্টেম নামে পরিচিত। ফসলের সঙ্গে কথা বলার লক্ষ্যে এই ব্যবস্থা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। অপটোজেনেটিকস পদ্ধতিতে একটি নির্দিষ্ট উপায়ে আলোকসংকেতের মাধ্যমে কোষকে সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় করতে পারে। আলোক উৎসের উদ্দীপক সস্তা আর বিপরীতমুখ বলা যায়।
আবার এসব উদ্দীপক বিষাক্ত নয় বলে বেশ কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যায়। গবেষণা অনুসারে, যখন শস্যের কোষে হাইলাইটারের মাধ্যমে তথ্য পাঠানো হয়, তখন তা শস্য গ্রহণ করতে পারে। আলোক উদ্দীপক কোষের নির্দিষ্ট আচরণ সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় করার কাজ করতে পারে। বর্তমান হাইলাইটার ব্যবস্থা নীল আলোতে নিষ্ক্রিয়। এই যন্ত্র অন্ধকারে বেশ কাজ করে। এ ছাড়া সাদা আলো, সবুজ আলো এবং লাল আলোর অবস্থায় সক্রিয়ভাবে গাছের সঙ্গে যোগাযোগে কাজ করে।
গত দশক থেকেই অপটোজেনেটিকস জীববিজ্ঞানীদের সামনে নতুন পথ উন্মোচন করছে। এই পদ্ধতিতে নিউরন বা কোষ আলাদা করা যায়। এই আবিষ্কার মৃগীরোগ, মেরুদণ্ডের আঘাত ও পারকিনসন রোগের মতো রোগ সম্পর্কে নতুন তথ্য প্রদান করছে। এই পদ্ধতিতে বিজ্ঞানীরা যে কোষ নিয়ন্ত্রণ করতে চান, সেখানে প্রথমে আলো সংবেদনশীল প্রোটিন (ফটোরিসেপ্টর) সন্নিবেশ করান। তারপর কোষের কর্মক্ষমতা সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় করতে আলো ব্যবহার করেন।
একইভাবে অপটোজেনেটিকস উদ্ভিদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হচ্ছে, যদিও ব্যাপারটি বেশ কঠিন। গাছপালার মধ্যে প্রচুর ফটোরিসেপ্টর থাকে। উদ্ভিদ নিজের বৃদ্ধি ও বিকাশের সমন্বয় করতে আলোর বিস্তৃত বর্ণালি ব্যবহার করে। অন্ধকার আর আলোর উপস্থিতি উদ্ভিদ ফটোরিসেপ্টর ও কোষব্যবস্থাকে সক্রিয় করে। এই বিষয়টিকে মাথায় রেখেই নতুন হাইলাইটার উদ্ভাবন করা হয়েছে।
‘প্লস বায়োলজি’ জার্নালে এ বিষয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। হাইলাইটার নামের যন্ত্রটি বেশ চমকপ্রদ। এর মাধ্যমে উদ্ভিদে অপটোজেনেটিকসের মাধ্যমে সংকেত বা তথ্যাদি প্রদানে নতুন পথ উন্মোচন হলো। হাইলাইটার এককথায় বিভিন্ন অপটিক্যাল বৈশিষ্ট্য নিয়ে উদ্ভিদের জন্য একটি যোগাযোগ টুলবক্স বলা যায়। এটি ফসলের উন্নতির জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করবে। এই যন্ত্রের মাধ্যমে ফুল ফোটা বা ফল পাকার জন্য আমরা গাছের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি।
সূত্র: ইনডিপেনডেন্ট