ভুট্টার আঁশ দিয়ে তৈরি হবে পোশাক

চিলির আতাকামা মরুভূমিতে ফেলে দেওয়া পোশাকের পাহাড়
এএফপি

দক্ষিণ আমেরিকার দেশ চিলি। দেশটির উত্তরাঞ্চলের বিশাল এলাকাজুড়ে প্রচুর পরিমাণে পোশাক বর্জ্য হিসেবে ফেলা হয়। চলতি বছরের শুরুতে চিলির সেই আতাকামা মরুভূমিতে ফেলে দেওয়া কাপড়ের পাহাড়ের ছবি দেখা সবাই চমকে যান। একটি স্যাটেলাইট ছবি ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। রীতিমতো মহাকাশ থেকে স্পষ্টভাবে বর্জ্যের দৃশ্যমান পাহাড় নতুন বিতর্ক তৈরি করে।

ফ্যাশনশিল্পের সঙ্গে বর্জ্যের ব্যবস্থাপনা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। সাধারণভাবে তুলা ও উলের মতো প্রাকৃতিক তন্তু বা ফাইবার মাটির সঙ্গে মিশে যায় বা পচে যায়। যদিও মানুষের তৈরি বেশির ভাগ তন্তু যেমন পলিয়েস্টার ও নাইলন প্রাকৃতিকভাবে পচনযোগ্য নয়। কয়েক দশক থেকে শুরু করে শত শত বছর ধরে যে আধারে এসব তন্তু ফেলা হচ্ছে, সেখানে সেগুলো তেমনই অপরিবর্তিত অবস্থায় রয়ে গেছে। এমনই থাকবে।

এই সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি বৈজ্ঞানিক সংস্থা বর্জ্যের পলিয়েস্টার ও নাইলন দ্রুত পচে যাওয়ার প্রাকৃতিক উপায় খুঁজে বের করেছে। মন্টানাভিত্তিক বায়োমিমিক্রি নামের একটি প্রতিষ্ঠান এ বিষয়ে কাজ করছে। প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক বেথ র‍্যাটনার বলেন, ‘আমরা পোশাকের জটিল উপকরণগুলো ভেঙে ফেলার চেষ্টা করছি। নতুন উপায়ে রঞ্জকপদার্থ ও কৃত্রিম তন্তুর আবরণের বিষাক্ত প্রভাব থেকে আমরা মুক্তি পেতে পারি। জৈবিক উপকরণ এনজাইম বা ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করে নতুন উপকরণ তৈরির চেষ্টা করছি আমরা। বস্ত্রবর্জ্যের পাহাড়কে ধ্বংস করে জৈব উপকরণে তৈরির সুযোগ আছে।’

বায়োমিমিক্রি ইনস্টিটিউট ডিজাইন ফর ডিকম্পোজিশন নামের একটি কর্মসূচির মাধ্যমে প্রযুক্তিগত সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ২০২৪ সালে কর্মসূচির বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করবে তারা। নতুন প্রক্রিয়ায় কাপড়ের বর্জ্যকে প্রাকৃতিক উপায়ে ভেঙে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। এতে রঞ্জক পদার্থের পরিবর্তে তন্তুর কাঠামোটি ব্যবহার করা হবে। এর মাধ্যমে পানিপ্রতিরোধী কাপড় তৈরি করা যাবে।

ভুট্টার আঁশ থেকে কাপড় তৈরির চেষ্টা চলছে

ফাস্ট ফ্যাশনের কারণে বেশি মাত্রায় পোশাক ব্যবহারের চল বেড়েছে সারা বিশ্বে। যুক্তরাজ্যের এলেন ম্যাকআর্থার ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, প্রতি সেকেন্ডে আবর্জনা ট্রাকভর্তি করে পোশাক ফেলে দেওয়া হয়। যেগুলোর মধ্যে একভাগের কম নতুন পোশাক তৈরিতে পুনর্ব্যবহার করা হয়। প্রতিষ্ঠানটির বিশ্লেষক জুলেস লেনন বলেন, ‘এখনকার ফ্যাশনব্যবস্থা ভেঙে গেছে।

আগের চেয়ে বেশি কাপড় তৈরি হচ্ছে। এসব কাপড় অনেক কম ব্যবহার করছি আমরা। ফ্যাশন শিল্প আন্তর্জাতিক ফ্লাইট ও সামুদ্রিক পরিবহনের চেয়ে বেশি বার্ষিক গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের জন্য দায়ী। ফ্যাশন দুনিয়ার নানা কাঁচামাল উৎপাদন পদ্ধতি ও রং করার প্রক্রিয়ার কারণে মাটির ক্ষয় ও পানিদূষণ বাড়ছে। জীববৈচিত্র্যের ক্ষতির ক্ষেত্রেও পোশাকের নানা রাসায়নিক দ্রব্য নেতিবাচক প্রভাব রাখছে।’

স্প্যানডেক্স নামক ফ্যাব্রিকের নির্মাতা লাইক্রা। এই ব্র্যান্ডের কর্মকর্তা জিন হেগেডাস বলেন, ‘অনুমান করা হয় কার্বন নির্গমনের প্রায় ৮ থেকে ১০ শতাংশের জন্য দায় আছে টেক্সটাইল ও পোশাকশিল্পের। আমাদের পরিবর্তন করতেই হবে। পলিয়েস্টারের জন্য আমরা প্রাকৃতিক কোনো ভিন্ন পদার্থ প্রতিস্থাপক হিসেবে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি। পলিয়েস্টার আর নাইলনের মতো পদার্থ পেট্রোলিয়াম থেকে তৈরি হয়। শুধু একটি উপাদান বদলে ফেললে অনেক পরিবর্তন আসবে। মোট তন্তুর ৭০ শতাংশ তৈরি হয় পেট্রোলিয়ামভিত্তিক ফাইবার থেকে। একটি পদার্থ পরিবর্তন করতে পারলে কার্বন নিঃসরণের হার ৪৪ পর্যন্ত কমিয়ে দিতে পারে।’

নতুন কাঁচামাল খোঁজার জন্য লাইক্রা যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া রাজ্যের কৃষকদের সহায়তা নেওয়ার চেষ্টা করছে। কোরে নামের একটি কোম্পানি কৃষকদের সঙ্গে মিষ্ট ভুট্টার (সুই কর্ন) মাধ্যমে একটি নতুন ফেব্রিক বা কাপড় তৈরির চেষ্টা করছে। নতুন এই ফেব্রিকের নাম দেওয়া হয়েছে কিরা। লাইক্রা তার ফেব্রিক তৈরিতে মূল উপাদান হিসেবে ভুট্টা ব্যবহার করছে।

কাগজ তৈরি বা পশুর খাদ্যের জন্য যে ভুট্টা চাষ করা হয়, সেই ভুট্টার মাধ্যমে নতুন কাপড় তৈরি করা হচ্ছে। পলিয়েস্টারের পরিবর্তে প্রাকৃতিক ভুট্টা ব্যবহার করে উপাদান তৈরি করতে লাইক্রা বড় আকারের প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এ কারণে আইওয়াতে বড় একটি বায়ুচালিত কারখানা তৈরি করা হয়েছে। আগামী বছর থেকেই ভুট্টার তন্তু থেকে পোশাক উৎপাদন করা হবে। প্রাথমিকভাবে ৭০ শতাংশ পোশাক নতুন ভুট্টাভিত্তিক ফাইবার থেকে তৈরি করা হবে।

সারা বিশ্বেই বিকল্প উপায়ে পোশাক নির্মাণের চেষ্টা চলছে। মার্কিন প্রতিষ্ঠান মাইকোওয়ার্কস মাশরুম থেকে চামড়ার মতো উপাদান তৈরি করছে। দক্ষিণ ক্যারোলিনায় কারখানায় স্থাপন করেছে প্রতিষ্ঠানটি। বিকল্প চামড়া হিসেবে রেইশি নামের উপাদান দিয়ে নানা পণ্য তৈরি করছে তারা। অন্যদিকে, যুক্তরাজ্যভিত্তিক ফ্যাবার ফিউচার স্ট্রেপ্টোমাইসেস কোইলিকলার নামের ব্যাকটেরিয়া নিয়ে কাজ করছে।

রঞ্জন প্রক্রিয়ায় এই ব্যাকটেরিয়া ব্যবহারের কাজ চলছে। এই ব্যাকটেরিয়া নীল আর লাল থেকে শুরু করে হলুদ রং তৈরিতে কাজে আসছে। ফিনল্যান্ডে স্পিনোভা নামে একটি সংস্থা কাঠ দিয়ে পোশাক তৈরি করছে।

সূত্র: বিবিসি