মাশরুমের প্রধান উপাদান মাইসেলিয়াম দিয়ে ইনসুলেশন প্যানেল তৈরি করছে বায়োম
মাশরুমের প্রধান উপাদান মাইসেলিয়াম দিয়ে ইনসুলেশন প্যানেল তৈরি করছে বায়োম

ভবন নির্মাণে মাশরুম!

বিভিন্ন দেশে কয়েক দশক ধরেই বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে মাশরুম। দুশ্চিন্তা দূরীকরণের উপায় থেকে শুরু করে খাবারে স্বাদের জন্য নানান মাত্রায় মাশরুমের ব্যবহার বেড়েছে। মাশরুমের প্রধান উপাদান মাইসেলিয়ামের ব্যবহার বাড়াতেও কাজ করছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। লন্ডনের বায়োম্যানুফ্যাকচারিং প্রতিষ্ঠান ‘বায়োম’ পুরো বিষয়কে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে। মাইসেলিয়ামকে তারা ভবন নির্মাণের কাজে ব্যবহার করছে। এ জন্য ইনসুলেশন প্যানেলও তৈরি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে এসব প্যানেল। বায়োমের ডিজাইন ডিরেক্টর ওকসানা বন্ডার বলেন, ‘আমরা বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ সমাধানের চেষ্টা করছি। নির্মাণশিল্প পৃথিবীর জলবায়ুর ওপরে চাপ তৈরি করছে, আমরা সেই খাত নিয়েই কাজ করছি। ভবন নির্মাণে অন্যতম ব্যবহৃত বস্তু হচ্ছে নানান ধরনের ইনসুলেশন প্যানেল। প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি করা হয় বলে পরিবেশের ওপরে বেশি ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। আমরা প্রাকৃতিকভাবে সমাধানের খোঁজ করছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘মাইসেলিয়াম কয়েক সপ্তাহ বিকাশের পরে আমরা তা সংগ্রহ করি। তা শুকিয়ে আমরা ইটের মতো প্যানেল তৈরিতে ব্যবহার করছি। এই প্যানেল বারবার ব্যবহার করা যায়। ব্যবহার শেষে ভেঙে টুকরা করে গবাদিপশুর খাবার হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। পিএইচ মান নিরপেক্ষ ও শতভাগ প্রাকৃতিক বলে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। এখন বিভিন্ন বহুজাতিক নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করার চেষ্টা চলছে।

চামড়ার বিকল্প মাশরুম

আমেরিকার সান ফ্রান্সিসকোর মাইকোওয়ার্কসও মাশরুম নিয়ে কাজ করছে। চামড়াজাত পণ্যের বিকল্প হিসেবে মাশরুমের ব্যবহার করছে তারা। মানিব্যাগ থেকে শুরু করে হাতব্যাগ কিংবা রান্নাঘরের তৈজসপত্রের জন্য মাশরুমের বিকল্প ব্যবহার করছে তারা। মাইকোওয়ার্কসের সহপ্রতিষ্ঠাতা সোফিয়া ওয়াং বলেন, ‘মাইসেলিয়াম থেকে তৈরি রেইশি নামের বস্তু উদ্ভাবন করেছি আমরা। চামড়াজাত পণ্যের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে এই বস্তু। পানি, কাঠের গুঁড়া আর মাইসেলিয়ামের সংযোগে আমরা চামড়ার বিকল্প উদ্ভাবন করেছি। এই পণ্য উৎপাদনের কার্বন নির্গমনের হার অনেক কম। এরই মধ্যে মাথায় পরার টুপি বা হ্যাট থেকে শুরু করে নানান বিলাসবহুল পণ্য উৎপাদনে কাজ করা শুরু করেছে প্রতিষ্ঠানটি। শুধু তা–ই নয়, প্রতিষ্ঠানটি জেনারেল মটরসের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গাড়ির অন্দরসজ্জার নানান পণ্য তৈরি করছে।’ ওয়াং আরও বলেন, ‘মাইসেলিয়ামের মাধ্যমে প্রাণীর চামড়া মতো পাতলা স্তর তৈরি করা যায়। সেই স্তর ট্যান করা বা রং করার মাধ্যমে চামড়ার বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। আমরা বড় আকারে উৎপাদন চালু করলে এসব পণ্যের দাম আরও কমবে। প্রতিষ্ঠানটি এ কাজের জন্য ১২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সংগ্রহ করেছে। সাউথ ক্যারোলাইনাতে বিশাল মাইসেলিয়াম উৎপাদন কেন্দ্র চালুর চেষ্টা করছে মাইকোওয়ার্কস।’

বাজার বাড়ছে

বৈশ্বিক ভাবে মাশরুমের বাজার বড় হচ্ছে। বর্তমানে এই বাজারের আকার ৬৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হলেও ২০২৮ সালে তা ৯০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করছেন বাজারবিশ্লেষকেরা। এ বিষয়ে ভিয়েনা ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির গবেষক মিশেল জোনস বলেন, বিভিন্ন প্রয়োজনীয় বস্তু উৎপাদনে মাইসেলিয়াম ব্যবহার বাড়ছে। সাত বছর আগে আমি মাইসেলিয়াম নিয়ে পিএইচডি গবেষণা শুরুর সময়ে এসব নিয়ে কোনো কাজই শুরু হয়নি। এখন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইতালি, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়াসহ নানান দেশে মাশরুম নিয়ে কাজ চলছে। অনেক স্টার্টআপ মাশরুমনির্ভর পণ্য উৎপাদনে কাজ করছে।

মাংসের বিকল্প মাশরুম

মাইসেলিয়ামনির্ভর খাদ্য উৎপাদনের জন্য বিভিন্ন দেশের প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। উচ্চ প্রোটিনের মাংসের বিকল্প হিসেবে মাশরুমের ব্যবহার বাড়ছে। সাদা ময়দার বিকল্প হিসেবে হয়তো ভবিষ্যতে মাশরুমের ব্যবহার আমরা দেখতে পাব। জার্মানির বার্লিনের বস্ক ফুডস মুরগি আর অন্যান্য প্রাণীর মাংসের বিকল্প নিয়ে গবেষণা করছে। এরই মধ্যে ৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ সংগ্রহ করেছে তারা। প্রতিষ্ঠানটির সহপ্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান শেফ বলেন, ‘আরবান ফার্মিং বা নগর কৃষির ধারণাকে গুরুত্ব দিয়ে আমরা মাইসেলিয়াম উৎপাদনের সুযোগ বাড়াচ্ছি। কম খরচে আমরা মাংসের বিকল্প তৈরিতে কাজ করছি। মাইসেলিয়ামে তৈরি বিকল্প মাংস আসল মাংসের মতোই স্বাদের। মসলা দিয়ে দারুণ সব খাবার তৈরি করা যায়। আমেরিকার অনেক দোকানে অবশ্য এরই মধ্যে মাশরুমের তৈরি বার্গার হরহামেশাই বিক্রি হচ্ছে। এ বছরের শুরুতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিকল্প মাংস ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। পুরো ইউরোপে বিকল্প মাংসের ব্যবহার টুকটাক দেখা গেলেও খোদ যুক্তরাজ্যে আইনের মারপ্যাঁচে আটকে আছে বিষয়টি। ১৯৯৭ সালের আইন অনুসারে মাশরুমের তৈরি মাংস আসল খাবার নয় বলে বিবেচিত হচ্ছে এখনো সেখানে। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ভবিষ্যতের ভেষজ খাবারের চাহিদা বাড়বে, সেখানে মাশরুমের তৈরি বিকল্প খাবারগুলো টেকসই ও পরিবেশবান্ধব হবে। খাবারের সঙ্গে যেহেতু স্বাদের বিষয়টি জড়িত, তাই হয়তো আরেকটু সময় লাগবে বলে মনে করেন তারা।

সূত্র: বিবিসি