কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হার-জিত কবিতায় লিখেছেন, ‘ভিমরুলে মৌমাছিতে হল রেষারেষি, দুজনায় মহাতর্ক শক্তি কার বেশি। ভিমরুল কহে, আছে সহস্র প্রমাণ তোমার দংশন নহে আমার সমান।’ ভিমরুলের যতই শক্তি থাকুক না কেন মানুষের কারণে ভালো নেই ভিমরুলেরা। ফসল রক্ষার জন্য বর্তমানে ক্ষতিকর রাসায়নিক কীটনাশকের বদলে জৈব কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। আর জৈব কীটনাশকের কারণে বিপদে পড়েছে ভিমরুলেরা।
বোলতা হাইমেনোপ্টেরা বর্গের পোকা। সবচেয়ে বড় প্রজাতির বোলতাকে ভিমরুল নামেও ডাকা হয়। সাধারণত অ্যাকুলেট পরিবারের ভেসপিডে জাতীয় সব পোকাকেই বোলতা বলা হয়ে থাকে। জৈব কীটনাশকের কারণে এসব প্রাণীর বংশই নির্বংশ হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছে বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। এমনতেই বিভিন্ন ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়ার কারণে এসব ক্ষুদ্র পতঙ্গ বিপদে থাকে, সেখানে জৈব কীটনাশক নতুন সংকট তৈরি করছে। জৈব কীটনাশকের কারণে বোলতাসহ বিভিন্ন কীটপতঙ্গে ছত্রাক সংক্রমিত হয়। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, মিসকোসাইটারাস মেটাথোরাসিকাস প্রজাতির বোলতায় বিউভেরিয়া ব্যাসিয়ানা ছত্রাক সংক্রমণ হয়ে থাকে। অসুস্থ বোলতার সঙ্গে সুস্থ বোলতার সংযোগ ঘটলেই সুস্থ বোলতাও অসুস্থ হয়ে পড়ে।
কবি মহাদেব সাহার ‘মন ভালো নেই’ কবিতার ছন্দে বলতে হচ্ছে ভিমরুলেরা ভালো নেই। এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড পলিউশন রিসার্চ জার্নালে বোলতাসহ নানা প্রাণীর সংকট নিয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, বিউভেরিয়া ব্যাসিয়ানা ছত্রাকযুক্ত জৈব কীটনাশক বোলতার প্রজাতির ওপরে প্রভাব ফেলছে। ব্রাজিলের সাও পাওলো বিশ্ববিদ্যালয়ের রিবেইরো প্রেটো স্কুল অফ ফিলোসফি, সায়েন্সেস অ্যান্ড লেটারসের বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে জৈব কীটনাশক নিয়ে গবেষণা করছেন। তারা আচরণগত পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে দেখেছেন জৈব কীটনাশক বোলতাকে মেরে ফেলে।
এ বিষয়ে বিজ্ঞানী আন্দ্রে রদ্রিগেজ ডি সুজা বলেন, ‘বোলতা সাধারণভাবে অন্য কীটপতঙ্গ খেয়ে ও পরাগায়নে মাধ্যমে ফসলের উপকার করে। জৈব কীটনাশকের কারণে বোলতায় ছত্রাক সংক্রমিত হয়। সিনথেটিক কীটনাশক যেমন ইমিডাক্লোপ্রিডের কারণে বোলতা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মারা যায়। পুরো বোলতার প্রজাতি নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে এই কীটনাশক। অন্যদিকে জৈব কীটনাশক বা বায়োপেস্টিসাইড প্রাথমিকভাবে কম প্রাণঘাতী, কিন্তু ১৯ দিনের মধ্যে অসংখ্য বোলতা মেরে ফেলে। তবে সিনথেটিক কীটনাশকের তুলনায় জৈব কীটনাশকের কার্যকারিতা আলাদা। জৈব কীটনাশকের ব্যাসিয়ানা ছত্রাকের স্পোর রয়েছে, যা শুধু পোকামাকড়, স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং অন্যান্য প্রাণীকে সংক্রামিত করে। সিনথেটিক কীটনাশক স্তন্যপায়ী প্রাণীদের জন্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতির ও বিষাক্ত হয়ে থাকে। সঠিকভাবে ব্যবহার না করলে মানুষের জন্য এটি বিপজ্জনক হতে পারে।’
গবেষণায় দেখা যায়, জৈব কীটনাশক বা বায়োপেস্টিসাইডের সংস্পর্শে থাকা প্রায় অর্ধেক বোলতা মারা গেছে। অন্যদিকে সিনথেটিক যৌগের সংস্পর্শে আসা সব বোলতা মারা গেছে। রাসায়নিক কীটনাশকের ঘনত্ব কম বলে এত পোকামাকড় মারা যায়, সেখানে রাসায়নিক অবস্থা আরও বাড়লে কতটা ভয়ানক হবে পরিস্থিতি, তা আন্দাজ করা যাচ্ছে।
বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ছত্রাকের স্পোর সমন্বিত জৈব কীটনাশক ফসলে স্প্রে করা হয়। অনিয়ন্ত্রিত জৈব কীটনাশক সিনথেটিক কীটনাশকের মতো কঠোরভাবে পরীক্ষা করা প্রয়োজন। দিনের বেলা বোলতা ফসলের মাঠে ঘুরে বেড়ায়। আর তাই দিনের বেলা এই ধরনের জৈব কীটনাশক প্রয়োগ করা এড়িয়ে চলা প্রয়োজন।
সূত্র: ফিজিস ডট অর্গ