মহাকাশ থেকে দেখা পৃথিবী
মহাকাশ থেকে দেখা পৃথিবী

পৃথিবী যদি সমতল হতো. . .

একসময় মনে করা হতো যে পৃথিবী গোলাকার নয়, সমতল। বিজ্ঞানীরা কয়েক শ বছরের প্রচেষ্টায় সেই বিশ্বাস বদলে দিয়েছেন। যদিও এখনো অনেকেই বিশ্বাস করতে চান যে পৃথিবী সমতল। এ নিয়ে পশ্চিমা দুনিয়ায় রীতিমতো দল বেঁধে আন্দোলনে নামতে দেখা যায় অস্বীকারকারীদের।

পৃথিবী সমতল হলে এখন যেভাবে দুনিয়া চলছে, তা বদলে যাবে। প্রাকৃতিক নানা ঘটনা ও অবস্থার নাটকীয়তা মারাত্মকভাবে ভেঙে পড়বে। পৃথিবী মহাকাশের পটভূমিতে একটি চ্যাপ্টা থালার মতো ভাসতে থাকবে। ১৯৫৭ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের স্পুতনিক-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবী সমতল নয়, আসলে গোলাকার এমন ভাবনা সবাই বৈজ্ঞানিকভাবে মেনে নেন। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার ক্যালটেকের গ্রহবিজ্ঞানী ডেভিড স্টিভেনসন বলেন, ‘যদি পৃথিবী কোনোভাবে সত্যিকার অর্থে সমতল হতো, তাহলে আজ আমরা যে গ্রহ দেখছি, তা ভিন্ন আচরণ করত। তখন সমতল পৃথিবীতে মানুষ কীভাবে থাকত বা অন্য প্রাণের কীভাবে বিকাশ হতো, তা নিয়ে অনেক কল্পনা আছে। মহাজাগতিক বস্তু হিসেবে ডিস্ক বা থালার মতো আকার নিতে পৃথিবীকে দ্রুত ঘুরতে হতো।’

সেই অবস্থায় গ্রহটির ক্ষুদ্র আকারে ভেঙে পড়ার ঝুঁকি আছে। ১৮৫০–এর দশকে জ্যোতির্বিজ্ঞানী জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল গাণিতিকভাবে দেখান যে কঠিন ও থালার মতো আকৃতি মহাবিশ্বে কোনো বস্তুকে স্থিতিশীল অবস্থা দিতে পারে না। তিনি শনির বলয় নিয়ে গবেষণা করেন। ম্যাক্সওয়েল ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে শনি গ্রহের বলয় অনেক ক্ষুদ্র ও সংযোগহীন কণা দিয়ে তৈরি। তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী পরবর্তীকালে সঠিক প্রমাণিত হয়।

ম্যাক্সওয়েল গণিতের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করে বলেন যে ছায়াপথের চারপাশে কোনো গ্রহের আকার থালার মতো হবে না। এমন কোনো গ্রহ বা মহাজাগতিক বস্তু নেই। জাদু ছাড়া পৃথিবীকে সমতল করে তোলা যাবে না। সমতল পৃথিবী বেশি দিন স্থায়ী হতো না মহাকাশে। তৈরির কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কারণে গ্রহটি আবার একটি গোলক হিসেবে রুপান্তরিত হতে শুরু করত। মাধ্যাকর্ষণ শক্তি সব দিক থেকে সমানভাবে টানে বলে গ্রহ বা মহাজাগতিক সব বস্তু আপাতত গোলক বা গোলাকার হয়। গ্রহের ঘূর্ণনের গতি যা–ই হোক না কেন, মহাকর্ষের কারণে সেটা গোলাকার হয়। স্থিতিশীল ও কঠিন ডিস্কের মতো পৃথিবীর বাস্তব অবস্থায় টিকে থাকা সম্ভব নয়।

পৃথিবী সমতল হলে আমাদের বর্তমান যে বায়ুমণ্ডল আছে, তা নষ্ট হয়ে যাবে। মহাকর্ষের কারণে বায়ুমণ্ডলকে পৃথিবী আটকে রেখেছে। পৃথিবী সমতল হলে জোয়ার-ভাটা বলে পৃথিবীতে কিছুই থাকত না। চাঁদের মহাকর্ষীয় টানের কারণে জোয়ার হয়। চাঁদ নিজেই হারিয়ে যেত পৃথিবী সমতল হলে। চাঁদের অস্তিত্বের সঙ্গে গোলাকার পৃথিবী ও তার মাধ্যাকর্ষণ শক্তি জড়িত। ধারণা করা হয়, চাঁদের সৃষ্টি হয়েছিল তখন, যখন অন্য একটি দৈত্যাকার গ্রহ–আকারের বস্তু পৃথিবীর ওপর বিধ্বস্ত হয়েছিল। সেই দুর্ঘটনায় তৈরি হওয়া ধ্বংসাবশেষ পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ দ্বারা আটকে যায়, যা পরবর্তী সময়ে পৃথিবীর টানে চন্দ্রের আকার ধারণ করে।

পৃথিবী গোলাকার বলেই মাধ্যাকর্ষণের কারণে পৃথিবীর ভূপৃষ্টে স্তরযুক্ত কাঠামো দেখা যায়। সবচেয়ে ঘন পদার্থ পৃথিবীর কেন্দ্রকে ঘিরে আসে। আর কিছুটা হালকা পদার্থ ম্যান্টেল ও বেশি হালকা পদার্থে ভূত্বক তৈরি হয়েছে। পৃথিবী সমতল হলে এই স্তরযুক্ত কাঠামো হারিয়ে যেত। পৃথিবীর অভ্যন্তরের তরল লাভা বাইরে চলে আসত। গোলাকার বলেই পৃথিবী গতিশীল চুম্বক হিসেবে কাজ করে। এতে আমাদের গ্রহের চৌম্বকক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। চৌম্বকক্ষেত্র গ্রহের বায়ুমণ্ডলকে সৌরবায়ুর প্রভাব থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে। সমতল হলে আরও বিপর্যয় দেখা দেবে। ৪০০ কোটি বছর আগে গ্রহের চৌম্বকক্ষেত্র বিপর্যস্ত হওয়ার কারণে মঙ্গলগ্রহের বায়ুমণ্ডল ধ্বংস হয়ে যায়। যদি পৃথিবী সমতল হতো, তাহলে মহাদেশীয় প্লেটগুলোও ধ্বংস হয়ে যেত।

যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সিটির কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যামন্ট-ডোহার্টি আর্থ অবজারভেটরির ভূপদার্থবিদ জেমস ডেভিস বলেন, পৃথিবীর মহাদেশীয় প্লেটগুলো ভীষণ নড়াচড়া করে। পৃথিবী সমতল হলে এভাবে নড়াচড়া করা সম্ভব হতো না। সমতল পৃষ্ঠে মাধ্যাকর্ষণ খুব ভিন্নভাবে কাজ করবে। সেই সমতল পৃথিবীতে হাঁটাচলাও বেশ কঠিন হবে। সমতল কাঠামো থাকলে আপনি হাঁটলে আপনাকে কেন্দ্রের দিকে আরও শক্তভাবে টানবে। আপনি যদি প্রান্তের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করেন, তাহলে আপনাকে আবার মাঝখানে টেনে নিয়ে আসবে। পৃথিবী সমতল হলে কোনো সময় বিভাজন থাকত না। পৃথিবীর সব জায়গায় তখন সূর্য একই সময়ে উঠত ও অস্ত যেত। মেরু ও নিরক্ষীয় জলবায়ুতে কোনো পার্থক্য থাকত না। তখন কোনো দিগন্ত থাকত না। আপনি যদি কোনো পাহাড়ে চড়েন, তাহলে তখন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত পরিষ্কার দেখতে পেতেন।

সূত্র: স্পেস ডটকম