মাইক্রোসফটের সহপ্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস কাজ থেকে অবসর নিলেও বিশ্বের নানা প্রান্তের বিজ্ঞান ও উদ্ভাবনসংক্রান্ত গবেষণার বিষয়ে নিয়মিত খোঁজখবর রাখেন। এ জন্য উদ্ভাবনের সঙ্গে যুক্ত বিজ্ঞানী ও তরুণ উদ্ভাবকদের সঙ্গে সরাসরি কথাও বলেন বিল গেটস। গত অক্টোবর মাসে সেনেগালের রাজধানী ডাকার ভ্রমণের সময়ও বিভিন্ন উদ্ভাবন ও গবেষণা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেছেন তিনি। ২ নভেম্বর সেই ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিজের ব্লগ সাইট ‘গেটস নোটস’-এ প্রকাশ করেছেন বিল গেটস। পাঠকদের জন্য লেখাটি প্রকাশ করা হলো।
গত মাসে আমি সেনেগাল ভ্রমণে গিয়েছিলাম। আমি সব সময় ভ্রমণের সুযোগের অপেক্ষায় থাকি আর নিজের ফাউন্ডেশনের অংশীদারদের উল্লেখযোগ্য কাজ দেখতে পছন্দ করি। এ ধরনের ভ্রমণ আমাকে প্রতিদিন কাজ করার জন্য আগের তুলনায় বেশি উৎসাহিত করে। ভ্রমণের জন্য সেনেগাল একটি আকর্ষণীয় দেশ। বহু বছর কার্যকর নীতিনির্ধারণের ওপর গুরুত্ব দেওয়ার ফলে দেশটির স্বাস্থ্য খাতের অনুকরণীয় অগ্রগতি হয়েছে। দেশটির কিছু পরিসংখ্যান মন ছুঁয়ে যায়। ১৯৯২ সাল থেকে সেনেগাল শিশুদের অপুষ্টিতে আক্রান্তের হার অর্ধেকে নামিয়ে এনেছে। ২০০০ সাল থেকে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর সংখ্যা ৭০ শতাংশ কমেছে দেশটিতে। ২০০৫ সাল থেকে স্বাস্থ্যবান শিশু জন্মদানে সক্ষম নারীর সংখ্যা ৬২ থেকে ৮০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এই সফরে আমি ইনস্টিটিউট পাস্তুর দা ডাকার বা আইপিডি গবেষণা কেন্দ্র পরিদর্শন করেছি। প্রায় এক শতাব্দী ধরে বিশ্ব স্বাস্থ্যের নানান বিষয় নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি কাজ করছে। আইপিডি আফ্রিকার এই অঞ্চলে রোগের প্রাদুর্ভাব নিয়ে গবেষণা করে থাকে। সেনেগালে আমি তরুণ বিজ্ঞানী ও গবেষকদের সঙ্গেও দেখা করেছি। নিজেদের দেশের মানুষকে সুস্থ রাখতে সেনেগালসহ নানা দেশের বিজ্ঞানীরা অসাধারণ সব কাজ করছেন।
ডাকারে দ্য গেটস ফাউন্ডেশনের গ্র্যান্ড চ্যালেঞ্জের বার্ষিক সভায় আমি যোগ দিই। গেটস ফাউন্ডেশন ২০ বছর আগে গ্র্যান্ড চ্যালেঞ্জ চালু করে। এর মাধ্যমে স্বাস্থ্যবিষয়ক বড় সমস্যা চিহ্নিত করার পাশাপাশি গবেষকদের অনুদান দেওয়া হয়। ২০০৩ সালে প্রথম ১৪টি গ্র্যান্ড চ্যালেঞ্জ দেওয়া হয়। প্রাথমিক তালিকায় এমন একটি ভ্যাকসিন তৈরির কাজ ছিল, যার রেফ্রিজারেশনের (নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় সংরক্ষণের) প্রয়োজন হয় না। সুপ্ত যক্ষ্মা সংক্রমণের জন্য টিকা তৈরি করা ও সুইমুক্ত ওষুধ সরবরাহ ব্যবস্থা উদ্ভাবনও তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ছিল। পরের বছরগুলোয় নতুন দুই শতাধিক চ্যালেঞ্জ তালিকাভুক্ত করা হয়। এ বছরের শুরুতে প্রথম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই–নির্ভর চ্যালেঞ্জ যোগ করা হয়েছে। সেনেগালে বিভিন্ন দেশের গবেষকদের উদ্ভাবন ও আবিষ্কার সম্পর্কে জানার সুযোগ হয়েছে। সেখানে আমার দেখা ৫টি দুর্দান্ত উদ্ভাবনের কথা লিখছি।
এআই প্রশিক্ষক, যা স্বাস্থ্যকর্মীদের গর্ভধারণের চিকিৎসা সম্পর্কে শেখার সুযোগ করে দিয়েছে। উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ সব বিষয়ে এআই প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। একটা ভয়ানক পরিসংখ্যান হচ্ছে, প্রতি দুই মিনিটে একজন নারী প্রসবের সময় মারা যান। অমৃতা মহলে ও তাঁর প্রতিষ্ঠান আর্মম্যান ভারতে মায়েদের চিকিৎসা উন্নত করতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর এই এআই প্রশিক্ষক ব্যবহার করছে। তাদের বিস্তৃত ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল ভবিষ্যতে স্বাস্থ্যকর্মীদের উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভাবস্থার চিকিৎসা শেখানোর কাজে ব্যবহার করা হবে। চিকিৎসাবিষয়ক প্রশিক্ষণ দিতে সক্ষম চ্যাটবটটি ইংরেজি ও তেলেগু ভাষায় ব্যবহার করা যায়। চমৎকার দিকটি হলো, চ্যাটবটটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে ব্যবহারকারীর অভিজ্ঞতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে উত্তর দিতে পারে। আপনি নতুন নার্স বা কয়েক দশকের অভিজ্ঞতাধারী ধাত্রী হোন না কেন, এআই প্রশিক্ষক আপনাকে জীবন বাঁচানোর জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান দিয়ে আরও দক্ষ করে তুলতে পারে।
সাশ্রয়ী এমআরএনএ ভ্যাকসিন প্ল্যাটফর্ম আরেকটি আলোচিত উদ্ভাবন। এই প্ল্যাটফর্ম ভ্যাকসিন উৎপাদনে সহায়তা করছে। এমআরএনএ ভ্যাকসিন করোনা মহামারির সময় লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু ঠেকাতে সাহায্য করেছে। বেলজিয়ামের কোয়ান্টুম নামের একটি কোম্পানি নতুন এ প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছে। এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে খুব সহজে দ্রুত ভ্যাকসিন উৎপাদন করা যাবে। বিভিন্ন প্রকরণের এমআরএনএ ভ্যাকসিন তৈরির জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে সহায়তা করছে প্ল্যাটফর্মটি। আমি গর্বিত যে গেটস ফাউন্ডেশন নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে স্থানীয়ভাবে এমআরএনএ ভ্যাকসিন উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বিনিয়োগ করছে। এই বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় চার কোটি মার্কিন ডলার। ইনস্টিটিউট পাস্তুর দা ডাকার বা আইপিডিতে বিনিয়োগ করা হচ্ছে যা কোয়ান্টুমের প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করবে। এই প্ল্যাটফর্ম টিকার সরবরাহ বৃদ্ধি করবে। কম খরচে জরুরি পরিস্থিতিতে দ্রুত ভ্যাকসিন প্রদানে সাহায্য করবে। স্থানীয় বিজ্ঞানীদের নিজস্ব ভ্যাকসিন আবিষ্কার ও গবেষণায় পথ দেখাবে।
ম্যালেরিয়া রোগের প্রাদুর্ভাব কমাতে আণবিক স্তরে মশা ট্র্যাক করার নতুন উপায় নিয়ে গবেষণা চলছে। কয়েক দশকের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে ম্যালেরিয়ার মতো মশাবাহিত রোগের ঘটনা বেড়েছে। কেনিয়া মেডিকেল রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ইসাবেলা ওয়ার মশার বিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন। তিনি মশাদের ট্র্যাক করতে আণবিক এপিডেমিওলোজি ব্যবহার করেন। যেসব মশা ওষুধপ্রতিরোধী, তাদের সন্ধান করা হবে। এই গবেষণাপদ্ধতি কোথায় মশার বিস্তার ঘটছে, আর কীভাবে তা বন্ধ করা যায়, সে সম্পর্কে পথ দেখাবে।
রোগের চিকিৎসা পদ্ধতি আরেকটি দারুণ উদ্ভাবন মাইক্রোবায়োম। আমাদের দেহে মানবকোষের চেয়ে বেশি মাইক্রোবায়াল কোষের আবাস। মাইক্রোবায়োমের ভালো ব্যাকটেরিয়া খারাপ ব্যাকটেরিয়াকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে ভূমিকা পালন করে। যখন সেই ভারসাম্যে সমস্যা দেখা যায়, তখন আপনি ব্যাকটেরিয়াল ভ্যাজিনোসিসের মতো রোগে আক্রান্ত হন। এই সাধারণ রোগের কারণে নারীরা এইচআইভি সংক্রমণের ঝুঁকিতে পড়েন। সন্তান অকালে জন্ম দেওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এই রোগের বর্তমান চিকিৎসা খুব কার্যকর নয়। যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটির মেলিন ঝু ও তাঁর দল নতুন পদ্ধতি নিয়ে কাজ করছে। নতুন পদ্ধতিতে একটি গেটওয়ে হিসেবে ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধিকে বাধা দেওয়ার জন্য ওলিক অ্যাসিড ব্যবহার করে হচ্ছে। খারাপ জীবাণু ধ্বংসের জন্য কাজ করবে ওলিক অ্যাসিড। একই সঙ্গে ভালো ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে। এই গবেষণা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।
আগামী দিনের মহামারির জন্য নতুন ওষুধ উন্নয়নের প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা হয়েছে। করোনা মহামারির আগে থেকেই অনেক টিকা তৈরিতে অগ্রগতি ছিল। ওষুধের ক্ষেত্রেও যে তেমন অগ্রগতি ছিল, তা বলা যাবে না। যুক্তরাষ্ট্রের ডেকয় থেরাপিউটিকসের নতুন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছে। ওষুধ তৈরির প্রক্রিয়াকে দ্রুততর করার জন্য কাজ করছে তারা। লাইপোপেপটাইড অণু ভাইরাসে ফিউশন যন্ত্রপাতির ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে। ডেকয়ের গবেষণা শেষ হলে বিজ্ঞানীরা এক দিন বা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে নতুন ভাইরাসের জন্য থেরাপি ডিজাইন করতে প্ল্যাটফর্মটি ব্যবহার করতে পারবেন।
সেনেগালে বিজ্ঞান ও উদ্ভাবনের শক্তি দেখে আমার বিশ্বাস জোরালো হয়েছে। কোনো সন্দেহ নেই যে আমাদের বিশ্ব বেশ কিছু কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। মেধাবী বিজ্ঞানীরা তাঁদের প্রতিভাকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলায় উৎসর্গ করছেন। এভাবে অগ্রগতি সম্ভব হবে। আমরা এমন ভবিষ্যতের কাছাকাছি যাচ্ছি, যখন সব মানুষ সুস্থভাবে জীবন যাপন করবে।
ভাষান্তর: জাহিদ হোসাইন খান