প্রাগৈতিহাসিক এই প্রাণীগুলোই কি পাখির পূর্বসূরি
প্রাগৈতিহাসিক এই প্রাণীগুলোই কি পাখির পূর্বসূরি

ডানাওয়ালা টিকটিকি কি পাখির পূর্বসূরি

শৈশবের অনেকের প্রিয় ছড়া—‘ঐ দেখা যায় তাল গাছ/ ঐ আমাগের গাঁ,/ ঐ খানেতে বাস করে/ কানা বগীর ছা।/ ও বগী তুই খাস কী?’ সেই কানা বগী মানে বক নিয়ে আমাদের মনে অনেক প্রশ্ন ছিল। তেমনি বকের মতো দেখতে উড়ন্ত প্রাগৈতিহাসিক মেরুদণ্ডী টেরোসরাসদের নিয়ে বহু বছর গবেষণা করছে গবেষক দল। টেরোসরাসরা প্রাগৈতিহাসিক আমলের প্রাণী। ২০ কোটি বছর আগে ট্রিয়াসিক সময়ে পৃথিবীতে তাদের আবির্ভাব ঘটে। প্রথম মেরুদণ্ডী প্রাণী হিসেবে তারাই আকাশে ওড়ায় সক্ষম ছিল। অন্য ডাইনোসরদের মতো ৬ কোটি ৬০ লাখ বছর আগে ধূমকেতুর আঘাতে বিলোপ হয় তারা।

জীবাশ্মবিদ ম্যাথিউ ব্যারের ভাষ্যে, ‘আমাদের কাছে টেরোসরাসদের আসলে পূর্ণাঙ্গ কোনো ফসিল নেই, যে কারণে আমরা জানি না তারা কীভাবে আকাশে ওড়ার ক্ষমতা অর্জন করেছিল।’ যুক্তরাজ্যের শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে জীবাশ্মবিদ ব্রায়ান অ্যান্দ্রে জানান, কোনো কোনো টেরোসরাস দেখতে অনেক ভয়ানক ছিল। কয়েক দশক আগে জানা গেছে, টেরোসরাসরা ছিল সবচেয়ে বড় পাখাওয়ালা উড়ন্ত প্রাণী।

হয় শিকারের মুখে পড়ো, নতুবা শিকারী হও—এ যেন ছিল প্রাগৈতিহাসিক দুনিয়ায় বেঁচে থাকার শর্ত। এই শর্তের মধ্যে তৃতীয় মাত্রা যুক্ত করে প্রাগৈতিহাসিক আমলের টেরোসরাসরা। স্থলের শিকারিদের হাত থেকে বাঁচার জন্য উড়ে পালানোর কৌশল জানত তারা। আবার নিজের শিকারকে ছোঁ মেরে ধরে আকাশে নিয়ে ফেলে দেওয়ার কৌশল জানা ছিল তাদের। এখন পর্যন্ত গবেষকেরা তিন ধরনের মেরুদণ্ডীর সন্ধান পেয়েছেন, যাদের আকাশে ওড়ার মতো মাংসপেশি ছিল। যার মধ্যে টেরোসরাসরা অন্যতম, এই শব্দের গ্রিক অর্থ ডানাওয়ালা টিকটিকি। ২৩ কোটি ৭০ লাখ বছর আগে পৃথিবীর শত্রু-শত্রু খেলার ময়দানে আবির্ভাব হয় তাদের। নামের মধ্যে সরাস থাকলেও কিন্তু তাদের ডাইনোসর বলা হয় না। ডাইনোসরদের দুঃসম্পর্কের আত্মীয় বলা হয় টেরোসরাসদের।

সপ্তদশ শতকে প্রথম টেরোসরাসের ফসিলের সন্ধান মেলে জার্মানির এক চুনাপাথরের এলাকায়। একই চুনাপাথরের এলাকায় আর্কেওপটেরিক্স নামের সবচেয়ে প্রাচীন পাখির সন্ধান পাওয়া যায়। প্রথম দিকে টেরোসরাসের ফসিল দেখে গবেষকেরা ভেবেছিলেন, এটা বোধ হয় কোনো সামুদ্রিক প্রাণীর ফসিল। অন্য একদল গবেষক বাদুড় ও পাখির মধ্যবর্তী কোনো প্রাণী বলে ধারণা করছিলেন। তবে সবচেয়ে কার্যকর গবেষক দলের ভাবনা ছিল, টেরোসরাসরা ছিল প্রথম উড়ন্ত সরীসৃপ। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, বাদুড়ের বহু আগে টেরোসরাসরা আকাশে ওড়ার ক্ষমতা অর্জন করে। ২১ কোটি ৯০ লাখ বছর আগের টেরোসরাসের ফসিল থেকে এ তথ্য জানিয়েছেন গবেষকেরা। সবচেয়ে চমকের কথা হচ্ছে, সবচেয়ে পুরোনো পাখির কঙ্কালের বয়স ১৫ কোটি বছর।

১৫ কোটি ৩০ লাখ বছর আগের কুনপেঙ্গোপটেরাস সাইনেসিস নামের টেরোসরাসের সন্ধান মিলেছে চীনে। ২০২০ সালে গবেষকেরা নেচার সাময়িকীতে ১৫৭ প্রজাতির টেরোসরাস, আদি ডাইনোসরসহ নানা সরীসৃপের শরীরতাত্ত্বিক ছবি নিয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। এ ছাড়া নেচার সাময়িকীতে ২৩ কেটি বছর আগের ২০ সেন্টিমিটার লম্বা আরেকটি সরীসৃপ নিয়ে গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। এই প্রাণীর নাম স্কেলেরোমকলাস টাইলরি। গবেষকদের ধারণা, এই সরীসৃপ থেকে টেরোসরাসদের বিকাশ ঘটেছে। এই সরীসৃপের কিছুটা সরু অঙ্গ, হালকা গড়নের বাহু, হাত ও সোজা প্রকৃতির নখ ছিল। তারা বেশিক্ষণ গাছে থাকত না। যে কারণে গবেষকেরা মনে করেন, টেরোসরাসরা ওড়ার ক্ষমতা নিয়ে গ্লাইডিং করে এক পর্বত থেকে আরেক স্থানে যেত।

ফসিলের ব্যাখ্যা করে জানা যায়, টেরোসরাসরা পোকামাকড় থেকে শুরু করে মাছ খেত। মাংসযুক্ত স্থলের প্রাণীদের উপস্থিতি ছিল তাদের খাবারের তালিকায়। এখনো গবেষকেরা পাখিদের বিকাশের রহস্য উন্মোচনে টেরোসরাসদের নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
সূত্র: সায়েন্স নিউজ অবলম্বনে