ময়লা ফেলার জন্য জরিমানার মুখে পড়েছে একটি মার্কিন প্রতিষ্ঠান। সাধারণ একটি ঘটনা মনে হলেও আসলে ময়লা ফেলা হয়েছে মহাকাশে, আর সেই আবর্জনা যেখানে–সেখানে ফেলার জন্য যুক্তরাষ্ট্র সরকার ডিশ নেটওয়ার্ক নামের প্রতিষ্ঠানটিকে জরিমানা করেছে। স্পেস জাঙ্ক বা মহাকাশে আবর্জনা ফেলার জন্য বিশ্বে প্রথমবারের মতো জরিমানা করার ঘটনা ঘটল।
মহাকাশে নানা বর্জ্য জমতে জমতে ভাসমান মেঘের মতো ভাগাড়ে পরিণত হয়। তারপরই সেই ভাসমান বর্জ্যের আঘাতে স্পেস শাটল ধ্বংসের গল্প দেখা গিয়েছিল ‘গ্র্যাভিটি’ নামের হলিউডের বিখ্যাত সিনেমায়। ২০১৩ সালের বিজ্ঞান কল্পকাহিনির সেই সিনেমায় দেখা যায়, ভাসমান মহাকাশের নানা বর্জ্যের কারণে ধ্বংস হয় হাবল স্পেস টেলিস্কোপ ও নাসার স্পেস শাটল।
কল্পবিজ্ঞানের মতো কিন্তু বাস্তবে মহাকাশে ময়লার ভাগাড় তৈরি হয়েছে। আমাদের চারপাশের পৃথিবীর নানা জায়গা, মহাসাগর থেকে শুরু করে হিমালয় পর্বত এলাকায় নানা রকমের বর্জ্য ছড়িয়ে দিচ্ছি আমরা। পৃথিবীর কক্ষপথে অর্ধযুগের বেশি সময় ধরে কৃত্রিম উপগ্রহসহ (স্যাটেলাইট) নানা খেয়াযান পাঠাচ্ছি আমরা। নানাভাবে মহাকাশে আমাদের চারপাশের পৃথিবীকে আমরা ভাসমান বর্জ্য দিয়ে ঘিরে ফেলছি। কেউ যেন দেখার নেই। এবারই প্রথম পৃথিবীর কক্ষপথে মহাকাশে আবর্জনা ছড়ানোর জন্য মার্কিন সরকার জরিমানা করল। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ফেডারেল কমিউনিকেশন কমিশন ডিশ নেটওয়ার্ককে জরিমানা করে। জরিমানার পরিমাণ নেহায়েত কম না কিন্তু। একটি ব্যবহৃত ও পুরোনো স্যাটেলাইটকে দায়িত্বহীনভাবে রাখার জন্য এই জরিমানা করা হয়েছে। ১ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার বা দেড় কোটি টাকার বেশি জরিমানা দিতে হবে প্রতিষ্ঠানটিকে।
ইকোস্টার সেভেন নামের স্যাটেলাইটের জন্য দায় স্বীকার করেছে ডিশ নেটওয়ার্ক। স্পেস জাঙ্ক সেসব বর্জ্যকে বলা হয়, যা পৃথিবীর চারপাশে কক্ষপথে অবস্থান করছে। এখন কোনো ব্যবহার নেই এমন সব স্যাটেলাইটই এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এসব নিয়ন্ত্রণহীন বর্জ্যের কারণে বর্তমানে উৎক্ষেপণ করা মহাকাশযানের সঙ্গে সংঘর্ষের ঝুঁকি রয়েছে।
ডিশের ইকোস্টার সেভেন ২০০২ সালে পাঠানো হয় মহাকাশে। পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে ২২ হাজার মাইল ওপরে অবস্থান করে স্যাটেলাইটটি। ২০২২ সালে স্যাটেলাইটটির ব্যবহারের কার্যকারিতা শেষ হয়। স্যাটেলাইটটিকে কক্ষপথ থেকে ১৮৬ মাইল দূরে সরানোর জন্য আদেশ দেওয়া হয়। ২০২২ সালে আদেশ দেওয়ার পরে কক্ষপথ থেকে কেবল ৭৬ মাইল দূরে সরিয়ে রাখা হয়। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ফেডারেল কমিউনিকেশন কমিশনের ব্যুরো চিফ লোয়ান এগাল বলেন, ‘স্যাটেলাইট পরিচালনের পরিধি এখন নানাভাবে বাড়ছে। মহাকাশনির্ভর অর্থনীতির বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে আমাদের উন্মুক্ত চলাচলের বিষয়টি ভাবতে হবে। জরিমানার বিষয়টি যতটা না শাস্তির, তার চেয়ে সবাইকে সতর্ক হতে নির্দেশ দিচ্ছে। জরিমানার পরিমাণ ডিশ নেটওয়ার্কের সামগ্রিক আয়ের তুলনায় খুবই নগণ্য। প্রতিষ্ঠানটি শুধু ২০২২ সালে ১ হাজার ৬৭০ কোটি মার্কিন ডলার আয় করেছে।’
যুক্তরাজ্যে সেন্ট্রাল ল্যাঙ্কাশায়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্পদার্থবিদ্যার গবেষক ড. মেগান আর্গো বলেন, ‘জরিমানার বিষয়টি অন্যান্য স্যাটেলাইট পরিচালনকারীদের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। প্রথমবারের মতো স্যাটেলাইট অপারেটররা কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থার অধীনে এল। আমাদের কক্ষপথে অনেক বেশি জিনিস ছড়িয়ে আছে। সেখানে সংঘর্ষের ঝুঁকি দিন দিন বাড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে এসব বর্জ্য অন্য সব স্যাটেলাইটের চলতি পথে আঘাত করতে পারে।’
১৯৫৭ সালে প্রথম স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করা হয়। এখন পর্যন্ত ১০ হাজারের বেশি স্যাটেলাইট মহাকাশে উৎক্ষেপণ করা হয়েছে। যার মধ্যে অর্ধেকের বেশি এখন অকার্যকর। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার হিসাবে ১০ সেন্টিমিটারের বেশি দৈর্ঘ্যের অনেক বর্জ্য মহাকাশে ছড়িয়ে আছে। ২৫ হাজারের বেশি কৃত্রিম বস্তু আমাদের পৃথিবীকে ঘিরে রেখেছে। নাসার প্রধান বিল নেলসন গত জুলাই মাসে বিবিসিকে বলেছিলেন, মহাকাশের আবর্জনা একটি প্রধান সমস্যা এখন। আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনটিকে উড়ন্ত বর্জ্যের হাত থেকে রক্ষা করতে চলার পথ বদলাতে হবে। এমনকি এক টুকরা ধাতুর গতি সেখানে প্রতি ঘণ্টায় সাড়ে ১৭ হাজার মাইল, যা এই গতিবেগে মহাকাশচারীকে স্পেসওয়াকের সময় আঘাত করতে পারে।
পুরোনো স্যাটেলাইটসহ খেয়াবর্জ্য বলতে খেয়াযানের রং, রকেটের অংশবিশেষকে বোঝানো হয়। খেয়াবর্জ্যের আঘাতে শুধু স্যাটেলাইট বা স্পেস শাটল ঝুঁকির মুখে পড়ছে না, আমরা যারা পৃথিবীতে আছি, তাদের মাথার ওপরও কিন্তু আঘাত হানতে পারে। এই আশঙ্কাকে রীতিমতো কেসলার সিনড্রোম হিসেবে নামকরণ করা হয়েছে। ১৯৬৯ সালে সোভিয়েত খেয়াবর্জ্য পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করার কথা জানা যায়।
সেই সব বর্জ্য সমুদ্রপৃষ্ঠে পড়লেও আঘাত হানে একটি জাপানি জাহাজে। সেবার পাঁচজন নাবিক আহত হন। ১৯৭৯ সালে স্কাইল্যাবের অংশবিশেষ অস্ট্রেলিয়ার ওপর আঘাত হানে, যে কারণে নাসাকে ময়লা ফেলার অভিযোগে ৪০০ ডলার জরিমানা করা হয়েছিল।
সূত্র: বিবিসি, স্পেস ডটকম