বিল গেটস
বিল গেটস

বিল গেটসের আশা

ম্যালেরিয়া শিগগিরই নির্মূল হতে পারে

মাইক্রোসফটের সহপ্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস কাজ এখনো বিশ্বের নানা প্রান্তের বিজ্ঞান ও উদ্ভাবন–সংক্রান্ত গবেষণার বিষয়ে নিয়মিত খোঁজখবর রাখেন। নিজের দাতব্য সংস্থা বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে বিভিন্ন গবেষণা ও বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনে যুক্ত আছেন বিল গেটস। শুধু তা–ই নয়, দাতব্য সংস্থাটির মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ, দারিদ্র্য বিমোচন ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় প্রতিবছর শত শত কোটি ডলার ব্যয়ও করেন তিনি। সম্প্রতি ম্যালেরিয়া রোগ নির্মূলের সম্ভাবনা নিয়ে নিজের ব্লগসাইট ‘গেটস নোটস’-এ একটি লেখা লিখেছেন বিল গেটস। পাঠকদের জন্য লেখাটি সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরা হলো।

আমি কিছুদিন আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম রেডিটে একটি ভিডিও দেখেছিলাম। ভিডিওতে দেখা যায়, একটি মশা রক্ত চোষার চেষ্টা করছে, কিন্তু ব্যর্থ হচ্ছে। সেই ভিডিওতে দর্শকদের কিছু উত্তর ছিল বেশ মজার। আমি লক্ষ করেছি, বেশির ভাগ মানুষই ‘আমি কীভাবে এই ব্যক্তির মতো সুপারপাওয়ার পেতে পারি?’ ধরনের প্রশ্ন করেছিলেন। এই রক্তচোষা প্রাণীকে (মশা) সর্বজনীনভাবে কতটা ঘৃণা করা হয় তার প্রমাণ দেখছিলাম।

রেডিট ব্যবহারকারীসহ অন্য সবার জন্য আমার কাছে একটি সুসংবাদ আছে । মশার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে, বিশেষ করে মারাত্মক রোগ ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সত্যিকারের অগ্রগতি হয়েছে। আমি বিশ্বাস করি, শিগগির ম্যালেরিয়া সম্পূর্ণরূপে শেষ করার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম আমরা তৈরি করে ফেলব।

ম্যালেরিয়া নির্মূল করার জন্য মেলিন্ডা ও আমি ২০০৭ সাল থেকে কাজ করছি। তখন আমরা বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে একদল নেতার সামনে দাঁড়িয়েছিলাম। অনেকের কাছে অসম্ভব বলে মনে হলেও তখন আমরা কিছু করার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলাম। প্রতিটি দেশ থেকে ম্যালেরিয়া সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করার কথা বলেছিলাম। এটি না হওয়া পর্যন্ত আমাদের লক্ষ্য ছিল যতটা সম্ভব জীবন বাঁচানো। আমাদের কাছে থাকা সরঞ্জাম দিয়ে জীবন বাঁচানোর কথা বলে থাকি। রোগ নির্মূল করা কোনো নতুন ধারণা ছিল না। ১৯৫৫ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একই ধরনের ঘোষণা দিয়েছিল। সেই আগের অভিযানে বিশ্বের অনেক ধনী এলাকা সফল হলেও আফ্রিকা, এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, পূর্ব ইউরোপ, মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা, ক্যারিবিয়ান ও ওশেনিয়া এলাকা ব্যর্থ হয়। অর্ধশতাব্দী ধরে চেষ্টার পরও ম্যালেরিয়া এখনো বছরে ৫০ কোটি লোককে সংক্রামিত করছে। এতে বছরে ১০ লাখ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে।

আজ পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। আমাদের কাছে গত বছরের তথ্য আছে। ২০২২ সালে বিশ্বব্যাপী ২৪৯ মিলিয়ন আক্রান্তের ঘটনা দেখা যায়। এই সময়ে ছয় লাখ আট হাজার মানুষ মারা গেছে। এসব বিস্ময়কর সংখ্যা। ২০০৭ সালে বিশ্ব যেখানে ছিল, এখন তার অনেক উন্নতি হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আরও ১৭টি দেশকে ম্যালেরিয়ামুক্ত ঘোষণা করেছে। আফ্রিকার বাইরে এই রোগে বেশির ভাগ মৃত্যু নির্মূল করা গেছে।

কীটনাশকযুক্ত মশারি, কীটনাশক স্প্রে, দ্রুত ডায়াগনস্টিক পরীক্ষা ও চিকিৎসা, প্রথম প্রজন্মের টিকা ও প্রতিরোধমূলক ওষুধ লাখ লাখ মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে। আমাদের এসব ব্যবহার করতে হবে, বিনিয়োগ করে যেতে হবে। একা সব করা যাবে না, এসবই কিন্তু যথেষ্ট নয়। ম্যালেরিয়া একটি উল্লেখযোগ্যভাবে অভিযোজিত পরজীবী দ্বারা সৃষ্ট রোগ। এই রোগ ক্রমাগত পরিবর্তিত হচ্ছে। আমাদের ওষুধ ও প্রতিরোধের বিরুদ্ধে বাধা তৈরি করছে। ম্যালেরিয়া প্রতিরোধ গড়ে তুলছে। এটির সঙ্গে লড়াই করা অনেকটা হোয়াক-এ-মোল নামের আর্কেড খেলার মতো। (এ খেলায় একটি বোর্ডে কয়েকটি গর্তসদৃশ ছিদ্র দিয়ে কোনো প্রাণীর মাথা বের হয়ে আসে, তখন একটি হাতুড়ি দিয়ে তার ওপরে বাড়ি দিতে হয়। কোন প্রাণী কোন গর্ত দিয়ে বের হয়, তা আগে থেকে জানা যায় না।) ম্যালেরিয়াকে যখন আমরা মনে করি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছি, তখন অন্য কোথাও বা একটি নতুন আকারে দেখা যায়।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় অতিরিক্ত চ্যালেঞ্জ দেখা যাচ্ছে। কোভিড-১৯ মহামারি আমাদের অগ্রগতিতে বড় ধাক্কা দিয়েছে। ২০২০ সাল থেকে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্তের ঘটনা ও মৃত্যু বাড়ছে। ম্যালেরিয়ার আক্রমণ এখনো করোনা মহামারির আগের পর্যায়ে ফিরিয়ে নেওয়া যায়নি। জলবায়ু পরিবর্তন মশার আবাসস্থলকে প্রসারিত করছে। ম্যালেরিয়া বিস্ফোরিত হওয়ার হুমকিতে রয়েছে। লাখ লাখ মানুষকে রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। একই সময়ে আমরা জীবাণুর ওষুধ-প্রতিরোধ দেখতে পাচ্ছি। এতে বর্তমান চিকিৎসার কার্যকারিতা কমে যাওয়ার হুমকিতে রয়েছে। ম্যালেরিয়া এখনো দুর্বল মানবগোষ্ঠীকে সবচেয়ে বেশি আঘাত করছে। প্রতি মিনিটে একটি শিশুকে হত্যা করে ম্যালেরিয়া।

সম্প্রতি দুটি প্রথম-প্রজন্মের ম্যালেরিয়া টিকার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। যদিও জীবনরক্ষায় টিকাগুলোতে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এসব টিকা ছোট শিশুদের জন্য তৈরি করা হয়েছে, যারা গুরুতর রোগ ও মৃত্যুর জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। তাদের একাধিক ডোজ দেওয়া প্রয়োজন। এই টিকা দীর্ঘস্থায়ী সুরক্ষা প্রদান করে না। টিকায় সংক্রমণ বন্ধ হয় না। টিকা আপনাকে অসুস্থ হওয়া থেকে রক্ষা করতে পারে। অর্থাৎ টিকা নেওয়ার পরও মশার কামড় থেকে ম্যালেরিয়া আক্রান্ত হতে পারেন। তাই গবেষকেরা এখন পরবর্তী প্রজন্মের ম্যালেরিয়া টিকা তৈরি করতে কাজ করছেন। এই টিকা সব বয়সীদের জন্য ব্যবহার করা যাবে।

জিন ড্রাইভ ম্যালেরিয়া ও অন্যান্য মশাবাহিত রোগের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াইয়ে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে। এই পদ্ধতি বর্তমানে গবেষণার পর্যায়ে রয়েছে। এ পদ্ধতিতে জেনেটিক পরিবর্তনের মাধ্যমে ম্যালেরিয়ার জীবাণু বিস্তারকারী স্ত্রী অ্যানোফিলিস মশার সংখ্যাকে হ্রাস করা হয়। এ মশাই শুধু কামড়ায় ও রোগটি ছড়ায়। যুক্তরাজ্যের লন্ডনে গবেষকেরা ডাবলসেক্স জিন সম্পাদনা করছেন। এই জিনযুক্ত স্ত্রী মশার হুল মানুষের ত্বককে ভেদ করতে পারে না। এই বিষয়টি রেডিটের ভিডিওতে দেখা গেছে।

ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে বিভিন্ন টিকার ধারণা পরীক্ষা করা হচ্ছে। প্রথমে মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি নিয়ে চারপাশে অনেক আগ্রহ ছিল। এটি ল্যাবে তৈরি প্রোটিন। এসব প্রোটিন নকশা করা হয়েছে আমাদের ইমিউন সিস্টেম যেভাবে ক্ষতিকারক প্যাথোজেনের বিরুদ্ধে লড়াই করে সেই ধারণাকে কেন্দ্র করে৷ এ পদ্ধতিতে শরীরে টিকা অ্যান্টিবডি তৈরির বদলে সরাসরি ইনজেকশনের মাধ্যমে দেওয়া হয়। এই পদ্ধতি কয়েক মাস সুরক্ষা দিতে পারে। আমরা ২০২৮ সালের মধ্যে এ পদ্ধতির পরীক্ষা শেষ করব। এখন পর্যন্ত পদ্ধতিটি আশা দেখাচ্ছে আমাদের।

বর্তমানে ম্যালেরিয়ার চিকিৎসায় সাধারণত ওষুধের ককটেল বা মিশ্রণ ব্যবহার করা হয়। এ জন্য প্রায়ই আর্টেমিসিনিনভিত্তিক মিশ্রণ থেরাপি বা এসিটিএস ব্যবহার করা হচ্ছে। কল্পনা করুন, চিকিৎসকের একটি ডোজে ম্যালেরিয়া নিরাময় হচ্ছে। পাশাপাশি রোগীদের সাময়িকভাবে মশার জন্য বিষাক্ত করে তোলে। এটি একটি নতুন ধরনের চিকিৎসাব্যবস্থা। একে সিঙ্গেল এনকাউন্টার র‍্যাডিক্যাল কিউরস বা এসইআরসি বলা হয়। বড় জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংক্রমণ বন্ধ করতে এই চিকিৎসাব্যবস্থা ব্যবহার করা যাবে আশা করা হচ্ছে। একটি নতুন এসইআরসি মিশ্রণের পরীক্ষা চলছে, যা ২০২৬ সালে অনুমোদিত হতে পারে।

ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে অ্যাট্রাকটিভ টার্গেটেড সুগার বেট বা চিনির টোপ ব্যবহার করা হচ্ছে। এ পদ্ধতিতে কীটনাশকমিশ্রিত মিষ্টি খাবার দিয়ে চিনির মাধ্যমে মশাকে আকর্ষণ করা হয়। যদিও প্রথম-প্রজন্মের টোপে কিছু দুর্বলতা ছিল। বিজ্ঞানীরা কৃত্রিম টোপের উন্নত সংস্করণ তৈরি করতে কাজ করছেন।

ড্রোন ও এআইয়ের মতো নতুন প্রযুক্তি ইতিমধ্যে আমাদের আরও কার্যকরভাবে মশার প্রজনন সাইট খুঁজে বের করতে ও আক্রমণ করতে সাহায্য করছে। উৎস থেকে ম্যালেরিয়া সংক্রমণ কমানোর সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। প্রযুক্তিনির্ভর লার্ভা উৎসের ব্যবস্থাপনা এবং শহুরে এলাকায় এসব বিশেষভাবে কার্যকর। আমরা যতই নির্মূলের কাছাকাছি যাচ্ছি, ততই মশা নজরদারি ও ভেক্টর নিয়ন্ত্রণ আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। সহজ প্রযুক্তির সাহায্যে ফোনের মাধ্যমে যে কেউ কীটতত্ত্ববিদ হিসেবে কাজ করতে সক্ষম হবে তখন।

আগামী পাঁচ থেকে আট বছরের মধ্যে ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে আমাদের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম থাকবে বলে আমি মনে করি। আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আর্থিক ও রাজনৈতিক। ম্যালেরিয়া হ্রাসে যে বিনিয়োগ, তার বিপরীতে ভালো ফলাফল সত্ত্বেও এ বিষয়ে মনোযোগ ও তহবিল কমে যাচ্ছে। বিশ্বের সামনে অনেক প্রতিযোগিতামূলক বিষয় রয়েছে। যদিও ম্যালেরিয়া প্রায়ই উপেক্ষা করা হয়। আলোচনায় সব সময় না থাকলেও এই রোগ নির্মূলের স্বপ্ন টিকে আছে। স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করার জন্য আমাদের সম্পদ ব্যবহার করা নিশ্চিত করতে হবে।

বর্তমানে প্রতি মিনিটে একটি শিশু ম্যালেরিয়ায় মারা যাচ্ছে। এমন একটি পৃথিবীর কথা কল্পনা করুন, যেখানে কোনো শিশু মারা যায় না। ম্যালেরিয়া শেষ হওয়ার অর্থ এটাই। এর মানে লাখ লাখ শিশু সুস্থভাবে বেড়ে উঠবে, নিয়মিত স্কুলে যাবে আর পূর্ণ সম্ভাবনায় বেড়ে উঠবে।

সূত্র: গেটস নোটস