৫৪ বছর আগে ১৯৬৯ সালে চাঁদের বুকে মানুষের পা পড়ে। সুনির্দিষ্টভাবে বললে মার্কিনিদের পা পড়ে। চাঁদের আর্থিক গুরুত্ব কম বলে এরপর আর কোনো দেশ তেমন কোনো অভিযানের পরিকল্পনা করেনি। সম্প্রতি চন্দ্রবুকে আবারও মানুষের পায়ের ছাপ ফেলার উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কোন দেশের মানুষের পায়ের ছাপ পড়বে চাঁদের মাটিতে।
ইউরোপীয় স্পেস এজেন্সি চন্দ্রজয়ের জন্য একটি কার্গো জাহাজের মতো খেয়াযান তৈরির পরিকল্পনা করছে। প্রতিদ্বন্দ্বী বিভিন্ন দেশের চন্দ্রজয় ও অনুসন্ধান কর্মসূচির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য ইউরোপীয় স্পেস এজেন্সি এই বিশাল পদক্ষেপ নিচ্ছে।
নতুন করে মহাকাশ অন্বেষণের ঘোষণা দিয়েছে ইউরোপীয় স্পেস এজেন্সি (ইএসএ)। ২২টি ইউরোপীয় দেশ সর্বসম্মতভাবে ইএসএর তহবিল জোগাচ্ছে। মহাকাশ গবেষণা সংস্থাটি ২০২৮ সালের মধ্যে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন থেকে পৃথিবীতে কার্গো খেয়া পরিচালনার কাজ শুরু করছে। প্রথমবারের মতো ইউরোপের কোনো সংস্থা নভোচারী পরিবহনের যান তৈরির পরিকল্পনা করছে। প্রাথমিকভাবে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন থেকে নভোচারী বহনের জন্য ব্যবহার করা হবে সেই কার্গো খেয়াযান।
ইএসএ প্রত্যাশা করছে, ইউরোপীয় দেশগুলো চাইলে সেই যান চাঁদের বুকেও পাঠানো যাবে। জার্মানির কোলনে অবস্থিত ইউরোপীয় মহাকাশচারী কেন্দ্রের প্রধান ফ্রাঙ্ক ডি উইন বলেন, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে শক্তিশালী অংশীদারত্বের পথ হিসেবে চন্দ্রবুকে কার্গো পাঠানোর সুযোগ আছে। অনেক বছর ধরে রাশিয়ার ঘাড়ে চড়ে নানা খেয়াযানে মহাকাশে যেতে হচ্ছে ইউরোপের নভোচারীদের। রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে মহাকাশ নিয়ে রাশিয়া ও ইউরোপের সম্পর্ক বেশ দুর্বল এখন। এর ফলে ইউরোপের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি হয়েছে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করছেন। বিশ্বের মাত্র তিনটি দেশের নিজস্ব মহাকাশচারী পাঠানোর ক্ষমতা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীনের পাশাপাশি সেই পথে ইউরোপের আসার সুযোগ দেখছেন অনেকেই। ভারত গগনযান ক্যাপসুলের ক্রুবিহীন পরীক্ষামূলক ফ্লাইট এরই মধ্যে পরীক্ষা করছে। এই খেয়াযান নিয়ে ভারত চতুর্থ দেশ হিসেবে খেয়াযাত্রী পারাপারে প্রকাশ্যেই কাজ করছে।
এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে মহাকাশে মানব পরিবহনব্যবস্থা নিয়ে ‘রেভল্যুশন স্পেস: ইউরোপস মিশন ফর স্পেস এক্সপ্লোরেশন’ নামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। ১২ জন বিশ্লেষক সেই প্রতিবেদনে মহাকাশে পরিবহনব্যবস্থার গুরুত্ব তুলে ধরেন। সেই রিপোর্টে বলা হয়, মহাকাশ অভিযান একটি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ২০ বছর আগে ইন্টারনেটের শুরু নিয়ে যেমন পরিবেশ ছিল, খেয়াযান পরিবহন নিয়েও তেমন অবস্থা এখন। বিশ্বের সব দেশই এখন সম্পূর্ণরূপে পৃথিবী প্রদক্ষিণকারী নানা কৃত্রিম উপগ্রহের ওপর নির্ভরশীল। যোগাযোগ ও পরিবহনসেবায় উপগ্রহগুলো দৈনন্দিন জীবনে নানাভাবে যুক্ত এখন।
মহাকাশে মানুষ ও পণ্য পরিবহনে নিজস্ব ও শক্তিশালী ব্যবস্থা ইউরোপের ভবিষ্যতের সমৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সেই পরিপ্রেক্ষিতে নতুন পণ্যবাহী কার্গো যান তৈরি করতে চায় ইএসএ। একই সঙ্গে একটি নতুন ধরনের রকেট তৈরির কথাও জানিয়েছে সংস্থাটি। নতুন মহাকাশযানটির নকশা ও নির্মাণের জন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সেবা নিতে চাইছে ইএসএ। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা যুক্তরাষ্ট্রে ইলন মাস্কের স্পেসএক্সের মাধ্যমে মহাকাশচারী পাঠাচ্ছে। একইভাবে কাজ করতে চায় ইএসএ। যুক্তরাজ্যের লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইয়ান ক্রফোর্ড বলেন, কোনো সন্দেহ নেই যে স্পেসএক্স সাধারণভাবে মহাকাশে পণ্য আনার খরচ কমিয়েছে। এর মাধ্যমে চাঁদে যাওয়া আরও সহজ হচ্ছে বলা যায়। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কারণে চন্দ্রজয়ে আবারও মানুষের আগ্রহ তৈরি হচ্ছে।
চাঁদে রোবটের মাধ্যমে পণ্য পরিবহন করতে পারে এমন একটি যান তৈরির জন্য কাজ করছে নাসা। বেসরকারি মার্কিন কোম্পানির কাছ থেকে সেবা নিচ্ছে নাসা। যদি সবকিছু ঠিক থাকে, তাহলে আগামী বড়দিনের সময় নতুন চমক দেখা যেতে পারে। মার্কিন কোম্পানি অ্যাস্ট্রোবটিক টেকনোলজি পেরিগ্রিন মিশন–১ চালু করবে। এটি একটি চন্দ্রযান, যা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নাসার জন্য নকশা করেছে। চাঁদে যাওয়ার আগ্রহ গত এক দশকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে।
২০২১ সালের ডিসেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে আন্তর্জাতিক চাঁদ দিবস পালনের অনুমোদন মেলে। প্রতিবছর ২০ জুলাই চাঁদ দিবস পালিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক চাঁদ দিবসের সভাপতি ড. নাসর আল-সাহাফ বলেন, ‘আমি দেখতে পাচ্ছি, চাঁদে যাওয়ার জন্য বৈশ্বিক আগ্রহ তৈরি হচ্ছে। জাপান গত ৬ সেপ্টেম্বরে তানেগাশিমা মহাকাশ কেন্দ্র থেকে চাঁদে একটি নভোযান প্রেরণ করে। জাপানের প্রথম মুন ল্যান্ডার হিসেবে যানটি উৎক্ষেপণ করা হয়। জাপান-ভারত কিংবা চীনের মতো দেশের চন্দ্রজয়ের প্রতিযোগিতা আবারও চোখে পড়ছে। সেই প্রতিযোগিতায় ইউরোপ কেন পিছিয়ে থাকবে?
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান