করোনা মহামারির সময় আপনি যে মাস্ক ব্যবহার করছেন, তা এখন হয়তো কোনো সামুদ্রিক পাখির গলায় ঝুলছে। প্রতি মাসে বিশাল পরিমাণে বর্জ্য ফেলা হয় সাগর-মহাসাগরে। যে কারণে করোনা মহামারির সময় ফেলা দেওয়া মাস্কের গন্তব্য এখন বিভিন্ন সাগর-মহাসাগর।
আপনার-আমার ব্যবহৃত নীল রঙের মাস্কের কারণে এখন নীল সমুদ্রের কোনো সামুদ্রিক পাখির জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। একই সঙ্গে নানা কারণে সারা বিশ্বে প্রাণপ্রতিবেশের ওপরে চাপ তৈরি হয়েছে। নতুন এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, বিশ্বের নানা প্রান্তে সামুদ্রিক পাখির সংখ্যা কমে যাচ্ছে। ব্রিটিশ ট্রাস্ট ফর অরনিথলজির বিজ্ঞানীরা নানা কারণে সামুদ্রিক পাখি কমে যাওয়ার কারণ খুঁজে পেয়েছেন। সংস্থার গবেষক পরিবেশবিজ্ঞানী নিনা ও’হ্যানলন বলেন, পাখিরা দূষণকারী পদার্থে প্রভাবিত হচ্ছে। প্লাস্টিক আর সমুদ্রে তেলদূষণের কারণে পাখিরা ঝুঁকির মুখে পড়ছে। শুধু তা-ই নয়, আলো ও শব্দের মতো অদৃশ্য দূষণকারী পাখির জীবনকে বিপন্ন করে তুলছে। সামুদ্রিক পরিবেশে জাহাজসহ নানা কারণে তেলদূষণের মাত্রা বাড়ছে। এতে অউক, সিডাক ও ডাইভার প্রজাতির পাখিরা তেলের কারণে ঝুঁকিতে আছে।
নানা সামুদ্রিক দুর্ঘটনার কারণে হাজার হাজার টন তেল সমুদ্রে পড়ছে, এতে ব্যাপকসংখ্যক সামুদ্রিক পাখির মৃত্যু ঘটছে। তেলের আস্তরণের কারণে অনেক পাখি শ্বাসরোধ হয়ে মারা পড়ছে। পাখির পালকের পানিনিরোধী বৈশিষ্ট্য ধ্বংস করতে পারে দূষিত তেলজাতীয় পদার্থ। এতে পাখিরা হাইপোথার্মিয়ায় আক্রান্ত হয়। তেলের দূষণের শিকার মাছ খেয়ে পাখির প্রজননকাজে নেতিবাচক প্রভাব তৈরি হচ্ছে। বিষক্রিয়ার পাশাপাশি যকৃতের ক্ষতির মতো সমস্যা দেখা যাচ্ছে। এ ছাড়া নানামাত্রায় প্লাস্টিক দূষণের মাত্রা বাড়ছে। অনেক সমুদ্রসৈকত প্লাস্টিকে ঢেকে গেছে। অনুমান করা যায়, বছরে প্রায় ৪৮ লাখ থেকে ১ কোটি ২৭ লাখ মেট্রিক টন প্লাস্টিক মহাসাগরগুলোয় ফেলা হয়। বিশ্বব্যাপী ৫৬ শতাংশের বেশি সামুদ্রিক পাখি প্রজাতি প্লাস্টিক দূষণের কারণে ঝুঁকিতে আছে।
২০১৫ সাল থেকে ব্রিটেনের সিলি দ্বীপপুঞ্জে সামুদ্রিক পাখি প্রায় ২০ শতাংশ কমে গেছে। দ্য আইলস অব সিলি ওয়াইল্ডলাইফ ট্রাস্ট ও রয়্যাল সোসাইটি ফর দ্য প্রোটেকশন অব বার্ডস পাখির আবাসস্থল উন্নত ও সংরক্ষণের জন্য বড় আকারের পদক্ষেপ গ্রহণে কাজ করছে। সাম্প্রতিক এক সমীক্ষা বলছে, সিলি দ্বীপপুঞ্জে রেকর্ড করা সামুদ্রিক পাখির সংখ্যা গত আট বছরে প্রায় এক-পঞ্চমাংশ কমেছে। ২০২৩ সালে সিলিতে ৬ হাজার ৮২১টি সামুদ্রিক পাখির জোড়া ছিল। ২০১৫ সালে এই সংখ্যা ছিল ৮ হাজার ২৯২। যুক্তরাজ্যের কর্নওয়াল থেকে প্রায় ২৮ মাইল দূরের দ্বীপগুলো এখনো ইংল্যান্ডের সবচেয়ে বড় সামুদ্রিক পাখির উপনিবেশগুলোর একটি।
আইলস অব সিলি ওয়াইল্ডলাইফ ট্রাস্টের সামুদ্রিক পাখিবিশেষজ্ঞ ভিকি হেইনি বলেন, সমীক্ষার তথ্য বলছে, বিশ্বের সামুদ্রিক পাখিগুলো হুমকির মধ্যে রয়েছে। ২০১৫ সালে ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার এক জরিপ থেকে জানা যায়, ১৯৫০ সালের চেয়ে সামুদ্রিক পাখির সংখ্যা ৭০ শতাংশ কমে গেছে। এই কমে যাওয়ার প্রবণতা আরও বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সামুদ্রিক পাখির সংখ্যা ৪ ভাগের ১ ভাগ কমে গেছে। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে পাখিরা ঝুঁকির মধ্যে আছে।
কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেট অব দ্য বার্ডসের রিপোর্ট অনুসারে, ৬০ শতাংশ সামুদ্রিক পাখি কোনো না কোনোভাবে প্লাস্টিক পণ্য খাচ্ছে। ৪০ শতাংশ সামুদ্রিক পাখির খাবারে মনুষ্যবর্জ্য প্রবেশ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের আশপাশের সমুদ্রে দেখতে পাওয়া যায় এমন ৭০টি পাখির প্রজাতিকে লাল তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। যেকোনো সময় এরা পৃথিবীতে বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। গত ৫০ বছরে এই ৭০টি পাখির প্রজাতির সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে। জলবায়ু পরিবর্তন ও সমুদ্রের পানির উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ার কারণে বড় পাখিরা আবাস পরিবর্তন করছে, আবার ছোট পাখিদের খাদ্যশৃঙ্খলে পরিবর্তন আসার কারণে বিলুপ্তি ঝুঁকিতে পড়েছে। আবার ঘূর্ণিঝড় ও সাইক্লোনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংখ্যা আগের চেয়ে বেড়েছে। এতেও পাখিদের প্রাণহানি বাড়ছে। অনেক অঞ্চলে মাছ ধরার পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে, এতে খাদ্যসংকটে পড়ছে অনেক পাখি।
সূত্র: বিবিসি, কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় ও ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ