এরই মধ্যে পুরো পৃথিবী জেনে গেছে ‘গ্রেট আমেরিকান একলিপস’ নামের পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের খবর। গতকাল সোমবার ৮ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো ও কানাডার নির্দিষ্ট কিছু স্থানে সর্বোচ্চ ৪ মিনিট ২৭ সেকেন্ড পূর্ণ সূর্যগ্রহণ দেখা যায়। বহুল প্রতীক্ষিত এই পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ দেখতে দেশগুলোর বিভিন্ন শহরে কয়েক লাখ মানুষ ভিড় করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের ডালাসপ্রবাসী বাংলাদেশি পদার্থবিদ মুনীম রানাও ছিলেন দর্শকদের ভিড়ে। পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ দেখা ও ছবি তোলার অভিজ্ঞতা আজ হোয়াটসঅ্যাপে প্রথম আলোকে জানান মুনীম রানা।
মুনীম রানা বলেন, ‘পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ দেখার জন্য অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে অবশেষে আমরা ডালাস থেকে আরকানসাস অঙ্গরাজ্যে পৌঁছাই। এরপর শুরু হয় নতুন উত্তেজনা। বিভিন্ন মুঠোফোন অ্যাপের মাধ্যমে আমরা প্রথমেই মেঘহীন এলাকা খুঁজে বের করার চেষ্টা করি। কিন্তু বিধি বাম, যেখানেই যাই, সেখানেই আকাশজুড়ে মেঘের ঘনঘটা। অবশেষে আমরা ওজরাক মাউন্টেন রেঞ্জে ডোভার নামের একটি স্থান খুঁজে পাই। পাহাড়টিতে আমাদের আগেই অনেক মহাকাশপ্রেমী অবস্থান করছিলেন। এরপর আমরা টেলিস্কোপ ও ক্যামেরা বসানোর কাজ শুরু করি। সঙ্গে থাকা ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসের শিক্ষক বাংলাদেশি পদার্থবিদ আহসান রবিন টেলিস্কোপের মাধ্যমে সূর্যগ্রহণ অনুসরণ শুরু করেন। সঙ্গে ছিলেন বাংলাদেশি পদার্থবিদ ফাহমিদা রুমাও। আমাদের এই কার্যক্রম দেখতে ভিড় করেন অনেকেই।’
সূর্যগ্রহণ শুরু হলে চারপাশের মানুষের কোলাহল যেন একমুহূর্তের জন্য থমকে যায়। এমন এক দৃশ্য দেখার সুযোগ আসে, যা মানবজীবনে খুব কম দেখা যায়। এ বিষয়ে মুনীম রানা জানান, ‘সাড়ে তিন মিনিটের মতো সূর্যগ্রহণ ঘটে এখানে। প্রথমে বৃত্তাকার চাঁদের দেখা পাই আমরা। তারপর দেখতে পাই আংটি আকৃতির অভূতপূর্ব এক দৃশ্য। চারপাশে সাদা-কালো আলোকছটায় মুগ্ধ হয়ে পড়ি আমরা। মুহূর্তের মধ্যে অন্ধকার নেমে আসে চারদিকে। আলোহীন এক পরিবেশে আকাশে বিন্দু বিন্দু তারার দেখা পাই আমরা। বৃহস্পতি গ্রহসহ বিভিন্ন তারা ও নক্ষত্রের একঝলক দেখতে পারি। এরপর আমরা টেলিস্কোপে ধারণ করা ছবিগুলো ডেভেলপে ব্যস্ত হয়ে যাই। টেলিস্কোপের ছবি বিশেষ প্রক্রিয়ায় ডেভেলপ করতে হয়। নব্বই দশকে যেমন ফিল্ম থেকে ছবি ডেভেলপ করতাম, তেমন করেই এসব ছবি কম্পিউটারের মাধ্যমে ডেভেলপ করতে হয়। একেকটি ছবি ডেভেলপ করতে প্রায় দুই ঘণ্টা সময় লেগে যায়। এখনো অনেক ছবি ডেভেলপ করার কাজ চলছে।’
চোখে দেখা সূর্যগ্রহণের ছবি দেখে ভীষণ চমকের মুখে পড়েন মুনীম রানা। তিনি বলেন, ‘সূর্যগ্রহণের প্রথম মুহূর্ত থেকেই চলতে থাকে আমার ছবি তোলা। সারা জীবনে এমন দৃশ্য আর তো দেখার সুযোগ পাব না। সাড়ে তিন মিনিট সময়ে পাঁচ শতাধিক ছবি তুলি আমি। তুমুল উত্তেজনায় মনে হচ্ছিল যেন শৈশবে ফিরে গেছি। শ্বাসরুদ্ধকর এক আবহে হাজার হাজার মানুষ মহাজাগতিক এক স্নিগ্ধতার মুখোমুখি হই। সেই সময়কার সাময়িক রোমাঞ্চকর অবস্থা কোনো ভাষা বা বর্ণে প্রকাশ করা যাবে না। প্রথম যে ছবি তৈরি হয়, তা দেখে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ি। বিশাল আকাশে একচিলতে আলোর রেখা আমরা যে কত ক্ষুদ্র, তার অস্তিত্বই যেন প্রমাণ করে।’
একেকটি ছবি যেন একেকটি গল্প প্রকাশ করছে। মুনীম রানা বলেন, ‘আলোকছটা দেখার অনুভূতি যে এত দারুণ হয়, তা ভাষায় প্রকাশ করা যাচ্ছে না। বিশাল আকাশের বুকে বিশাল সূর্যের ওপর আমাদের চন্দ্রের আপাত অবস্থান। সাদাকালো এক অভূতপূর্ব দৃশ্য যেন ছবির মধ্যে লুকিয়ে আছে।’
সারা জীবন মানুষের হাতে কিংবা গয়নার দোকানে হীরার আংটির দেখা মেলে। আকাশে বিশালাকার এক হীরার আংটির চমক দেখা গেল গ্রেট আমেরিকান পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণে। মুনীম রানা বলেন, আলোর আংটি দেখার অভিজ্ঞতা কখনোই ছিল না। স্বচক্ষে তা দেখার অভিজ্ঞতা পেলাম। ছবির দিকে ভালো করে তাকালে সূর্যের আলোকছটা দেখা যায়। মনে হয় যেন বদ্ধ কোনো কৌটা থেকে আলো বেরিয়ে আসছে প্রবলগতিতে। আরেকটি ছবিতে চাঁদকে কালো টিপের মতো মনে হয়। মনে হয় সূর্যের কপালে যেন কেউ চাঁদকে টিপ হিসেবে বসিয়ে দিয়েছে।
মুনীম রানা বলেন, ‘আসছে ১০ এপ্রিল আমরা ঈদ উদযাপন করব। এবার যেন সবাই ঈদের চাঁদ দেখার বদলে আমার মতো সূর্য দেখার জন্য বসে ছিল। এবারের পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ দেখার অভিজ্ঞতা অনেক বছর আমার স্মৃতিতে থাকবে। বিশাল মহাকাশে বিশাল সূর্য আর চাঁদের কাছে আমরা যে কত ছোট, বিন্দুর চেয়েও ছোট, এটা সূর্যগ্রহণ না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।’