বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে ক্রমেই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে প্রবালপ্রাচীর। সারা বিশ্বের বিভিন্ন ধরনের প্রবালপ্রাচীর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় প্রকৃতিতে জরুরি অবস্থা চলছে বলে ঘোষণা দিয়েছেন জলবায়ু বিশ্লেষকেরা। শুধু তা–ই নয়, ২০২৩ সালকে পৃথিবীর জলবায়ুর জন্য বেশ আতঙ্কজনক বলে আখ্যা দিয়েছেন অনেকে। পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি, দাবানলসহ বিভিন্ন কারণে জলবায়ুর সংকটের মাত্রা বাড়ছে। সেই খারাপ সংবাদের ভিড়ে আরও মন খারাপের কথা জানিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ান গবেষক ওভ হোয়েগ-গুল্ডবার্গ। কোরাল ব্লিচিং বা সামুদ্রিক শৈবালের রং হারানোর মতো একটি দুর্যোগের কথা জানিয়েছেন তিনি। ওভ হোয়েগ-গুল্ডবার্গ বলেন, ‘ব্লিচিং পাউডার দিয়ে রঙিন কাপড় বেশি ধুলে কাপড় তার উজ্জ্বলতা হারায়। একইভাবে রঙিন প্রবালপ্রাচীরের রং সাদা হয়ে যাওয়ার ঘটনা জীববিজ্ঞানীদের চোখে পড়ছে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা প্রবালপ্রাচীরের ভবিষ্যৎ ভালো নয়। ২০২৩ সালের বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে সামুদ্রিক প্রবালের অবস্থা বেশ ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে রঙিন প্রবালপ্রাচীর সাদা হয়ে যাচ্ছে। গ্রেট ব্যারিয়ার রিফসহ বিভিন্ন প্রবালপ্রাচীর মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। ৪০ বছর ধরে আমরা এ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছি।’
সামুদ্রিক বিভিন্ন প্রজাতির এক-চতুর্থাংশের আবাসস্থল হচ্ছে প্রবালপ্রাচীর। কোরাল ব্লিচিংয়ের বিষয়ে কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এই বিজ্ঞানী চার শতাধিক বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র লিখেছেন। সমুদ্রের সবচেয়ে বিস্তৃত ইকোসিস্টেম প্রবালপ্রাচীরের নানা বিষয় তিনি সবার সামনে তুলে ধরছেন।
আশির দশক থেকে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের প্রবালপ্রাচীরের মধ্যে ঝুঁকির বিষয়টি লক্ষ করা যায়। রোগ, দূষণ, অতিরিক্ত সূর্যালোকের কারণ নাকি পানির লবণাক্ততার পরিবর্তনে প্রবালপ্রাচীর তার রঙিন ভাব হারায়, তা নিয়ে তখন গবেষণা করা হয়নি। বিজ্ঞানী হোয়েগ-গুল্ডবার্গ প্রবাল পরীক্ষা করে প্রথম বিশ্বের সামনে কোরাল ব্লিচিংয়ের ধারণা প্রকাশ করেন। প্রবাল একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রার সীমার মধ্যে সক্রিয় থাকে। সেই তাপমাত্রা বেড়ে গেলে প্রবালের রং ও পুষ্টির উৎস ক্ষুদ্র শেওলাগুলো ভেতর থেকে বের হয়ে যায়। আর তাই তাপমাত্রা বাড়তে থাকলে প্রবালপ্রাচীর একপর্যায়ে সাদা হয়ে যায়।
১৯৯৪ সালে প্রথম তাহিতি দ্বীপে বড় ধরনের ব্লিচিংয়ের ঘটনা চোখে পড়ে বিজ্ঞানীদের। সেখানকার প্রবালপ্রাচীর বেশ গভীরভাবে ব্লিচিংয়ের শিকার হয়। সে সময় পলিনেশিয়া অঞ্চলে থাকা প্রবালের ক্ষতির বিষয়টি তেমনভাবে গুরুত্ব দিয়ে উপস্থাপন করা হয়নি।
নব্বইয়ের দশকের শেষ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের প্রবালপ্রাচীরের ক্ষতির বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করা হয়। পর্যবেক্ষণের তথ্যাদি থেকে জানা যায়, ১৯৯৮ সালে সারা বিশ্বের সব প্রবালপ্রাচীর ব্লিচের শিকার হয়েছে। বিজ্ঞানী হোয়েগ-গুল্ডবার্গ প্রবালপ্রাচীরের সমস্যা নিয়ে একটি মডেল তৈরি করেন। এই মডেল অনুসারে কোন কোন এলাকার প্রাচীর কত ঝুঁকিতে রয়েছে তা ধারণা করা যায়। গত কয়েক বছরে আবারও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা প্রবালপ্রাচীর ব্লিচের মুখে পড়ছে। এক দশকে ছয় বা তার চেয়ে বেশিবার ব্লিচের শিকার হয়েছে অনেক প্রবালপ্রাচীর।
প্রবালপ্রাচীর সাদা হয়ে যাওয়ার বিষয়টি বিজ্ঞানী হোয়েগ-গুল্ডবার্গ আলসার রোগের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘আলসার হলে আপনি সব সময় সতর্ক থাকেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর মাত্রা বাড়লে আপনি সমস্যা বোধ করবেন। প্রবালপ্রাচীরের সমস্যা এমন করে বাড়ছে। ১৯৯৮ সালের কোরাল ব্লিচিংয়ের ঘটনার পরের ২০ বছরের পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। গ্রেট ব্যারিয়ার রিফকে বিপদগ্রস্ত স্থানের তালিকায় রাখার সময় চলে এসেছে। আমাদের গ্রহে জরুরি অবস্থা চলছে। এসব প্রবালপ্রাচীর মানবজাতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের প্রকৃতির অবস্থা আগের মতো ফিরিয়ে আনতে দ্রুত কাজ করতে হবে।’
হোয়েগ-গুল্ডবার্গের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী, ২০২২ সালে গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ ষষ্ঠবারের মতো ব্লিচিংয়ের শিকার হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া না হলে আগামী কয়েক দশকে এসব প্রবালপ্রাচীর শুধু গল্পে শোনা যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান