স্নো ক্র্যাব
স্নো ক্র্যাব

১০০ কোটি কাঁকড়া মারা গেল কেন

পূর্ব বেরিং সাগরের অধিবাসী স্নো ক্র্যাব বা তুষার কাঁকড়া। হুট করে তুষার কাঁকড়ার সংখ্যা কমে গেছে বলে চিন্তায় পড়েছেন জলবায়ু ও জীববিজ্ঞানীরা। ইউএস ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমোস্ফিয়ারিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (নোয়া) আলাস্কা ফিশারি সায়েন্স সেন্টারের সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানীরা এ তথ্য প্রকাশ করেছেন। ২০১৮ থেকে ২০১৯ সালে বেরিং সাগর থেকে প্রায় ১০০ কোটি তুষার কাঁকড়া অদৃশ্য হয়ে যায়। ধারণা করা হচ্ছে, পানির উষ্ণতার জন্য তাদের সলিলসমাধি ঘটে।

পূর্ব বেরিং সাগরের তুষার কাঁকড়াদের হারানোর ঘটনায় সবাই চমকে যান। বিজ্ঞানী কোডি সুউয়ালস্কি বলেন, প্রকৃত অর্থে এ ঘটনা একধরনের বড় রকমের মৎস্য বিপর্যয়। ‘সায়েন্স’ সাময়িকীতে তুষার কাঁকড়ার হারিয়ে যাওয়ার রহস্য নিয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করা হয়েছে। রহস্য সমাধানের জন্য তুষার কাঁকড়ার জীবনে উষ্ণ তাপমাত্রার বিষয়টি নিয়ে গবেষণা চালানো হয়।

আলাস্কার উপকূলে বসবাসকারী প্রাণিকুলের প্রায় ৯০ শতাংশই তুষার কাঁকড়া। তুষার কাঁকড়া তুলনামূলকভাবে ছোট আকারের হয়ে থাকে। নামে তুষার থাকলেও এরা সাদা নয়, অনেকটা গলদা চিংড়ির মতো দেখতে লাল। অগভীর এলাকায় সমুদ্রের তলদেশে বাস করে। বহু বছর ধরে সামুদ্রিক খাবার হিসেবে এদের খাওয়া হচ্ছে। বেরিং সাগরের ঠান্ডা পানিতে বেড়ে ওঠা তুষার কাঁকড়া স্থানীয়ভাবে ট্যানার কাঁকড়া নামেও পরিচিত। সাধারণত সমুদ্রতলে ৩৫ ডিগ্রি ফারেনহাইটের নিচে থাকে এরা। যদিও উষ্ণ অবস্থায় ৫৩ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত তাপমাত্রায় বেঁচে থাকতে পারে এরা।

প্রথমে আলাস্কার জেলেরা তুষার কাঁকড়া নাটকীয়ভাবে কমে যাওয়ার বিষয়টি খেয়াল করেন। করোনা মহামারির কারণে কাঁকড়া নিয়ে গবেষণায় এক বছরের জন্য বিরতি নেওয়া হয়। কত সংখ্যার কাঁকড়া নিখোঁজ হয়েছে, সে সম্পর্কে ২০২৩ সালের শুরুতে একটি ধারণা প্রকাশ করা হয়। গবেষকেরা বলছেন, ১০০ কোটির বেশি তুষার কাঁকড়া হারিয়ে গেছে। প্রথম দিকে গবেষক দল বিভিন্ন অঞ্চলে অনুসন্ধান শুরু করে। ধারণা করা হয়, কাঁকড়া অন্য জায়গায় চলে গেছে। কিন্তু অনেক অনুসন্ধানের পরও তাদের খোঁজ মেলেনি। তুষার কাঁকড়া যে অঞ্চলে বাস করে, সেই অঞ্চলের তাপপ্রবাহের একটি ঘটনা সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা জানতে পারেন। সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে কাঁকড়ার শক্তির প্রয়োজন হয় বেশি।

গবেষকরা দেখেছেন, পানির তাপমাত্রা মাত্র ৩ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বাড়লে কাঁকড়ার ক্যালরির চাহিদা দ্বিগুণ হয়ে যায়।

রেকর্ড থেকে দেখা যায়, দাবদাহের কারণে সমুদ্রপৃষ্টের তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গিয়েছিল।

কাঁকড়াদের সেই পরিস্থিতিতে নিজেদের টিকিয়ে রাখার জন্য দ্বিগুণ খাবারের প্রয়োজন হয়। গবেষণা থেকে জানা যায়, দাবদাহের ঠিক আগে আগে কাঁকড়ার জনসংখ্যা নাটকীয়ভাবে বেড়ে গিয়েছিল। সেই সময়ে খাদ্য সংগ্রহে বেশি প্রতিযোগিতায় লড়তে হয়েছে কাঁকড়াদের। এ কারণে কাঁকড়ারা অনাহারে মৃত্যুর মুখে পড়েছিল। কাঁকড়াদের কমে যাওয়ার ঘটনার পর আলাস্কা অঞ্চলে পরপর দুই মৌসুমের জন্য তুষার কাঁকড়া ধরা নিষিদ্ধ করা হয়। দাবদাহের কারণে অন্য প্রজাতির প্রাণীরা কাঁকড়ার দুর্দশার সুযোগ নিয়েছিল বলে মনে করা হচ্ছে। উষ্ণ তাপমাত্রার কারণে প্যাসিফিক কডের প্রাণীরা কাঁকড়ার আবাসস্থল দখল করে নেয়। সেই দাবদাহের কারণে কেবল কাঁকড়াই নয়, স্যামন, সামুদ্রিক পাখি ও সিলের সংখ্যাও বেশ কমেছে এ এলাকায়।

ব্রিটিশ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ ক্রিস্টোফার হার্লে বলেন, ‘আমরা চরম তাপমাত্রার কারণে বেশি বড় দুর্ঘটনার সাক্ষী হচ্ছি। দাবদাহের কারণে আরও অনেক প্রজাতি ও বাস্তুতন্ত্রের ওপর নেতিবাচক প্রভাব আমরা খেয়াল করছি। কিছু প্রাণী, যেমন সাবল ফিশ ও ওয়ালেই পোলক নামের সামুদ্রিক মাছের সংখ্যা উষ্ণ তাপমাত্রার কারণে বৃদ্ধি পেয়েছে। কিছু প্রজাতি অন্যদের তুলনায় বড় পরিবেশগত পরিবর্তনের সঙ্গে আরও দ্রুত মানিয়ে নিতে পারে। মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রের তাপমাত্রা বাড়তে থাকলে বেরিং সাগরে বসবাসকারী প্রজাতির মানচিত্র বদলে যাবে। ‘জীববিজ্ঞানীদের সমুদ্রের প্রাণী সংরক্ষণের পরিকল্পনায় আরও পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। মৎস্যবিজ্ঞানীরা একসময় অতিমাত্রায় মাছ ধরার বিষয়ে খুব চিন্তিত ছিলেন। হোয়াইট হোয়েল বা সাদা তিমি সংরক্ষণের কারণে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা গেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কাঁকড়ার মতো ছোট ছোট প্রাণীকে সংরক্ষণ নিয়ে ভাবতে হবে আমাদের।’ আলাস্কার তুষার কাঁকড়া কি আবারও ফিরে আসবে না? এমন প্রশ্নের উত্তরে গবেষকেরা জানিয়েছেন, বড় আকারের কাঁকড়া ফিরে আসতে কমপক্ষে চার বছর সময় লাগতে পারে। দীর্ঘ মেয়াদে উষ্ণতা বৃদ্ধি ও সামুদ্রিক বরফ হ্রাসের জন্য বিজ্ঞানীরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, তুষার কাঁকড়ারা সম্ভবত আরও উত্তরের ঠান্ডা পানিতে চলে যাবে।

সূত্র: স্মিথসোনিয়ান ম্যাগাজিন ও ফিজিস ডট ওআরজি