ঘূর্ণিঝড় ও হারিকেন বেশ পরিচিত শব্দ আমাদের কাছে। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঝড়কে ঘূর্ণিঝড় ও হারিকেন বলা হয়। যে অঞ্চলে ঝড় সংঘটিত হয়, তার ওপর নির্ভর করে নামকরণ করা হয়। উত্তর আটলান্টিক মহাসাগর ও উত্তর-পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরে, এই ঝড়গুলোকে হারিকেন বলা হয়। দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগর এবং ভারত মহাসাগরে ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড় বলা হয়।
হারিকেনসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ আগের চেয়ে বেড়েছে। সম্প্রতি স্যাটেলাইটের মাধ্যমে হারিকেন লির ছবি বিশ্লেষণ করা হয়েছে। আটলান্টিকের ওপর ধেয়ে আসা বড় আকারের হারিকেন লি। আবহাওয়াবিদেরা এই হারিকেনের আকার বুঝে তাকে একটি দানবঝড় বলে আখ্যায়িত করেন। হারিকেন লি খুবই দ্রুত প্রচণ্ড ঝড়ে পরিণত হয়। দ্রুতগতির হারিকেন হিসেবে এই ঝড় তৃতীয়। এই হারিকেনের বাতাসের গতি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৩৫ মাইল বা তার বেশি বেড়ে যায়। এ ধরনের গতি বছরের পর বছর বাড়ছে। জলবায়ু বিজ্ঞানীরা একমত যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আরও অনেক বেশি হারিকেন লি তৈরি হবে। দৈত্যাকার সব হারিকেন উপকূলে আঘাত করবে দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে।
আগে বছরে দ্রুতগতির আর প্রচণ্ড শক্তিসম্পন্ন গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঘূর্ণিঝড় দেখা যেত হাতে গোনা কয়েকটি। নেচার সাময়িকীতে প্রকাশিত একটি সমীক্ষা ভিন্ন তথ্য দিচ্ছে। উপকূলরেখার ২৪০ মাইলের মধ্যে দ্রুতগতির আর প্রচণ্ড ঝড়ের সংখ্যা বেড়েছে। ৪০ বছর আগের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি ঝড় দেখা যাচ্ছে। ২০২২ সালের হারিকেন ইয়ান ও ২০১৮ সালে হারিকেন মাইকেল শক্তিশালী হারিকেন ছিল। হারিকেন মাইকেলকে প্রথমে সাধারণ দ্বিতীয় মাত্রায় শ্রেণিভুক্ত করা হলেও তীব্রতা বেড়ে যায় পরবর্তী সময়ে। এই ঝড়ের কারণে আড়াই হাজার কোটি মার্কিন ডলারের ক্ষতি হয়।
অন্যদিকে হারিকেন লির অবস্থান আটলান্টিক মহাসাগরের খোলা পানির ওপরে ছিল। গবেষকেরা আশঙ্কা করছেন, ভবিষ্যতে হারিকেন আরও বিপজ্জনক জায়গা থেকে গতি নিয়ে তীব্র আকার ধারণ করতে পারে। হাজার হাজার মানুষ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় পড়বে। তাৎক্ষণিক সময়ে এ ধরনের ঝড়ের ওপর নজর রাখা কঠিন। হারিকেনের মূল অংশের কার্যকলাপের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। যেখান থেকে তথ্য সংগ্রহ করা এখনো অনেক কঠিন। বিজ্ঞানীরা এখন এই হুমকির বিষয়ে সতর্ক করতে নতুন পদ্ধতি তৈরির চেষ্টা করছেন।
ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমস্ফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, এখন শক্তিশালী হারিকেনের মাত্রা বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের আলবানি বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডল-সংক্রান্ত বিজ্ঞানী ব্রায়ান ট্যাং বলেন, হারিকেন তৈরির সময় পরিবেশের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। উষ্ণতা থেকে শুরু করে সমুদ্রের পানির অবস্থার ওপর নির্ভর করে হারিকেন কতটা বিকাশ করবে। যেকোনো হারিকেন তৈরির জন্য পরিবেশের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। হারিকেনের নিচে সমুদ্রের পানি যদি যথেষ্ট উষ্ণ হয়, তবে বাষ্পীভূত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রচুর পরিমাণে শক্তি জমা হয়। ফলে বায়ুচাপের ওপর প্রভাব তৈরি হয়। এতে দ্রুত বাতাস ধাবমান হয়। এই অবস্থা চারপাশের আর্দ্র বাতাসের মাধ্যমেও প্রভাবিত হয়। হারিকেনের ভেতরেই আর্দ্রতা জমা হয় আর শক্তি জমতে থাকে। হারিকেনের নিচের দিকের বাতাসের গতি ওপরের দিকের বাতাসের গতির চেয়ে তুলনামূলকভাবে কম থাকে, এই অবস্থা হারিকেনকে তার শক্তি ধরে রাখতে সাহায্য করে।
মার্কিন সরকারের জ্বালানি বিভাগের বিজ্ঞানী রুবি লিউং বলেন, সাইক্লোনের উৎপত্তিতে সাগরের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। নদী থেকে মিঠাপানি সমুদ্রে যায়। এই স্বাদুপানি তুলনামূলক উষ্ণ হয়। নদী থেকে সমুদ্রে যাওয়ার পর নোনা পানির ওপর নদীর মিঠাপানি থাকে। নোনা পানির ঘনত্ব বেশি ও ভারী হয়। এই পরিস্থিতিতে ঝড় তৈরি হওয়া কিছুটা কঠিন। একটি ঝড়ের জন্য পৃষ্ঠের দিকে সমুদ্রের গভীরের শীতল জল তুলে আনা বেশ কঠিন। যদি ওপরের পৃষ্ঠের পানি উষ্ণ থাকে, তবে যেকোনো হারিকেন শক্তিশালী হতে পারে। এই কারণে ২০১৭ সালের ইরমা হারিকেন আরও বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠে। হারিকেনটি তার চলার পথে সমুদ্রের ওপর অবস্থা করে শক্তি সঞ্চয় করে স্থলের দিকে আগমন করে।
গবেষকেরা ২০২০ সালে আমাজন অরিনোকো নদী কীভাবে ঝড়ের শক্তি বিকাশে কাজ করে, তা নিয়ে গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। মিঠাপানি যেমন ঝড়ের শক্তি বাড়ায়, তেমনি ঝড়ের সময় বৃষ্টি হলে সমুদ্রপৃষ্ঠে মিঠাপানি জমে। এতেও ঝড়ের শক্তি বাড়ে। এখন সাগর-মহাসাগর সব উষ্ণ জলাধার হিসেবে কাজ করে, যে কারণে ভবিষ্যতে আরও বড় ঝড় তৈরির সব মসলাই প্রকৃতির মধ্যে দেখা যাচ্ছে।
সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক