গভীর সমুদ্রের তলদেশ থেকে খনিজ সংগ্রহের প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছে অনেক দেশ। এরই মধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে সমুদ্রের গভীর তলদেশ খনন করে কোবাল্ট, নিকেল, তামা আর ম্যাঙ্গানিজের মতো খনিজের সন্ধান শুরু করেছে কানাডার ‘দ্য মেটাল কোম্পানি’। দূর নিয়ন্ত্রিত মাইনিং রোবট ব্যবহার করে সমুদ্রের তলদেশ থেকে বিভিন্ন খনিজ সংগ্রহও শুরু করেছে প্রতিষ্ঠানটি। সংগ্রহ করা খনিজ প্রক্রিয়াজাত করে বৈদ্যুতিক ব্যাটারিতে ব্যবহার করা হবে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক জলসীমায় সমুদ্রের তলদেশ থেকে খনিজ সংগ্রহ করা নিষিদ্ধ। আর তাই ২০২৫ সালের মধ্যে বড় পরিসরে উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরের আন্তর্জাতিক জলসীমায় খনন শুরু করার জন্য ইন্টারন্যাশনাল সিবেড অথরিটির (আইএসএ) কাছ থেকে অনুমতি পাওয়ার চেষ্টা করছে প্রতিষ্ঠানটি।
যুক্তরাজ্য, ব্রাজিল, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানিসহ প্রায় ৩০টি দেশ পরিবেশগত প্রভাব সম্পর্কে উদ্বেগের কারণে সমুদ্রের তলদেশ খননে নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত রাখতে চায়। অন্যদিকে চীনসহ বেশ কয়েকটি দেশ আন্তর্জাতিক জলসীমায় বড় আকারের সমুদ্রের তলদেশ খননের জন্য বেশ আগ্রহী। দ্য মেটাল কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জেরার্ড ব্যারন বলেন, ‘আমরা আশা করছি, আগামী বছরের শেষের দিকে বাণিজ্যিকভাবে গভীর সমুদ্রে খনন শুরু করতে পারব।’ বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে নরওয়ে নিজ জলসীমায় গভীর সমুদ্র খননের জন্য অনুমতি দিয়েছে। অন্যদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন পেন্টাগনকে ১ মার্চের মধ্যে সমুদ্রের তলদেশ খননের বিষয়ে একটি প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। গত বছর দেশটির ৩১ কংগ্রেস সদস্য গভীর সমুদ্র খননের বিষয়ে একটি খোলা চিঠি লেখার পর এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
সমুদ্রের তলদেশে থাকা শিলাকে ‘পলিমেটালিক নোডুলস’ বলা হয়। এসব সংগ্রহ করার পদ্ধতি বেশ জটিল ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। আর তাই ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ফান্ড ফর নেচার (ডব্লিউডব্লিউএফ) গভীর সমুদ্রে খননের বিরোধিতা করেছে। সমুদ্রের তলদেশ খনন করে খনিজ সংগ্রহের ফলে সামুদ্রিক জীবন ঝুঁকিতে পড়তে পারে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। ডব্লিউডব্লিউএফের উপদেষ্টা ও সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানী কাজা লোয়েন ফাজারটফ্ট বলেন, যদি খননের কাজ সেখানে শুরু করা হয়, তাহলে সমুদ্রের বাসস্থান ও বিভিন্ন প্রজাতি ধ্বংসের মুখে পড়বে। গভীর সাগরে থাকা অনেক প্রজাতি অন্য কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। খনন শুরু করলে সেগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে। খনিজ খনন করার সময় বাস্তুতন্ত্র সরাসরি ধ্বংসের পাশাপাশি শব্দ ও পলিদূষণের কারণে বড় ক্ষতি ও সংকট দেখা দিতে পারে।
ইউরোপিয়ান একাডেমিস সায়েন্স অ্যাডভাইজরি কাউন্সিলও সমুদ্রের তলদেশ খননের বিরোধিতা করছে। প্রতিষ্ঠানটির বিজ্ঞানী অধ্যাপক মাইকেল নর্টন বলেন, ‘সমুদ্রের তলদেশ থেকে খনিজ সংগ্রহের কারণে খনন করা অঞ্চলের প্রাণী ও গাছপালা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। সমুদ্রতট বা সমুদ্রের স্রোতের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। আমরা প্রচুর পরিমাণে ম্যাঙ্গানিজ উৎপন্ন করছি, কোনো সংকট নেই। কোবাল্ট–নিকেলেরও অভাব নেই। এসব ব্যাটারিশিল্পে ব্যবহার করা হচ্ছে। ইউরোপীয় কমিশনের দৃষ্টিতে এসব সরবরাহের কোন সংকট নেই। তাহলে সমুদ্রতট কেন খনন করতে হবে? নতুন খনিজ খনি এলাকা বিকাশের চেয়ে বিদ্যমান খনির বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণে আরও বিনিয়োগ করা প্রয়োজন।’
সমালোচনার জবাবে জেরার্ড ব্যারন বলেন, উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরের ক্লারিওন-ক্লিপারটন অঞ্চলে খননের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। হাওয়াই ও মেক্সিকোর মধ্যে অবস্থিত সমুদ্রের একটি বিশাল অংশ নিয়ে এ এলাকা। প্রায় ৪৫ লাখ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত ক্লারিওন-ক্লিপারটন অঞ্চল। ভূমিতে খননের তুলনায় সমুদ্রতলে খননে অনেক কম পরিবেশগত বিপর্যয় ঘটবে। চিরস্থায়ী অন্ধকারাচ্ছন্ন অঞ্চলটি সমুদ্রপৃষ্ঠের ৩ থেকে ৬ হাজার মিটার নিচে অবস্থিত। সেখানে কোনো উদ্ভিদ নেই। যদি আমরা প্রাণিজগতের পরিমাপ করি, জৈব বস্তু আকারে সেখানে প্রতি বর্গমিটারে মাত্র ১০ গ্রাম রয়েছে। অন্যদিকে নিরক্ষীয় বনে প্রতি বর্গমিটারে ৩০ কেজির বেশি জৈব বস্তু থাকে। নিকেল নিষ্কাশনের কারণে নিরক্ষীয় বন এলাকায় ভীষণ চাপ তৈরি হচ্ছে।
সূত্র: বিবিসি