লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার। নতুন যন্ত্রটি বর্তমানে ব্যবহৃত লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারের তুলনায় অন্তত তিন গুণ বড় হবে
লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার। নতুন যন্ত্রটি বর্তমানে ব্যবহৃত লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারের তুলনায় অন্তত তিন গুণ বড় হবে

মহাবিশ্বের রহস্য জানতে তৈরি হচ্ছে নতুন যন্ত্র

মহাবিশ্বের অনেক গোপন রহস্য রয়েছে, যা চাইলেও উন্মোচন করা যায় না। আর তাই মহাবিশ্বের আলোচিত কিছু রহস্য উন্মোচনের লক্ষ্যে পরবর্তী প্রজন্মের নতুন মডেলের একটি কোলাইডার তৈরির লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছেন ইউরোপের পারমাণবিক গবেষণা সংস্থা সার্নের বিজ্ঞানীরা। সুইজারল্যান্ডের জেনেভার কাছে ভূপৃষ্ঠের নিচে এই নতুন যন্ত্র স্থাপন করা হবে। যন্ত্রটি বর্তমানে ব্যবহৃত লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারের তুলনায় অন্তত তিন গুণ বড় হবে বলে জানিয়েছেন তারা।

কোলাইডার মূলত একধরনের কণা ত্বরণকারী যন্ত্র যেখানে দুটি বিপরীত কণার রশ্মির মাধ্যমে কণাদের একসঙ্গে সংঘর্ষ ঘটানো যায়। কোলাইডার গোলাকার বা লম্বা হতে পারে। কোলাইডারে কণাকে উচ্চ গতিশক্তিতে ত্বরান্বিত করার পর সংঘর্ষের উপজাত বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা পারমাণবিকের গঠন ও প্রকৃতির নিয়ম সম্পর্কে জানতে পারেন। লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার সুইজারল্যান্ড ও ফ্রান্সের ভূপৃষ্ঠের নিচে ২৭ কিলোমিটার বৃত্তাকার টানেলের ভেতরে বসানো হয়েছে। এখানেই বিগ ব্যাংয়ের এক সেকেন্ডের ভগ্নাংশ সময়ে যে পরিস্থিতি ছিল, তা জানতে কণার বিচ্ছুরণ ঘটানো হয়। এমনকি আলোর গতির কাছাকাছি প্রোটন ও অন্যান্য সাবটমিক কণার বিচ্ছুরণ ঘটানো হয়েছে এখানেই।

এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানী পিটার হিগস ও অন্যান্য গবেষকেরা বহু বছর আগে অদ্ভুত এক কণা সম্পর্কে ধারণা দিয়েছিলেন। অবশেষে ২০১২ সালে ঈশ্বর কণা নামে পরিচিত, সেই অধরা হিগস বোসন কণার খোঁজ মেলে। হিগস বোসন কণা আবিষ্কারের পর থেকে কোলাইডার তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য রহস্য উন্মোচন করতে পারেনি। ডার্ক ম্যাটার বা ডার্ক এনার্জিসহ অন্য কোনো রহস্যের খোঁজেও তেমন কাজে আসছে না কোলাইডারটি। আর তাই ২০১৯ সালে ফিউচার সার্কুলার কোলাইডার (এফসিসি) তৈরির পরিকল্পনা করে সার্ন। ৯১ কিলোমিটার পরিধির কোলাইডারটি তৈরির জন্য খরচ হবে প্রায় ২ হাজার কোটি ইউরো। যন্ত্রটির মাধ্যমে সাবঅ্যাটমিক কণাকে একসঙ্গে ১০০ টেরাইলেকট্রনভোল্টের শক্তিতে ভেঙে ফেলা হবে। ২০৪০ দশকের মধ্যে নতুন যন্ত্রটি তৈরি করা সম্ভব হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

নতুন কোলাইডার তৈরির বিষয়ে সমালোচনাও রয়েছে। যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা স্যার ডেভিড কিং বিবিসিকে জানিয়েছেন, বিশ্ব এখন জলবায়ু সংকটের কারণে ভয়ানক ও গুরুতর হুমকির মুখোমুখি হচ্ছে। এই সময় এমন যন্ত্র তৈরির জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় করা বেপরোয়া একটি কাজ হবে। জার্মানির মিউনিখ সেন্টার ফর ম্যাথমেটিকাল ফিলোসফির বিজ্ঞানী সাবিন হোসেনফেল্ডার জানিয়েছেন, নতুন কোলাইডার তৈরির বিষয়টি নিয়ে বেশ সমালোচনা হচ্ছে। কণা পদার্থবিদ্যার যুগ শেষ বলা যায়, এখন কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের যুগ। এমন কোনো প্রমাণ নেই যে নতুন যন্ত্র ডার্ক ম্যাটার বা ডার্ক এনার্জি সম্পর্কে কোনো তথ্য প্রকাশ করবে। এই ধরনের একটি যন্ত্র পদার্থবিজ্ঞানকে কতটা ভালোভাবে পরিমাপ করতে সহায়তা করবে, সে বিষয়েও জানার সুযোগ নেই। তবে এ বিষয়ে ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন সার্নের মহাপরিচালক বিজ্ঞানী ফ্যাবিওলা জিয়ানোটি। তাঁর মতে ফিউচার সার্কুলার কোলাইডার হবে সবচেয়ে শক্তিশালী মাইক্রোস্কোপ। এই মাইক্রোস্কোপের মাধ্যমে প্রকৃতির বিভিন্ন রহস্য খুব ভালোভাবে পর্যালোচনা করা যাবে, যা অমীমাংসিত কিছু প্রশ্নের উত্তর জানতে সহায়তা করবে। ফলে মৌলিক পদার্থবিদ্যা আর মহাবিশ্ব সম্পর্কে জ্ঞান আরও বাড়াবে।

লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারের বিজ্ঞানী তারা শিয়ার্স জানিয়েছেন, বিজ্ঞানের নানা বিষয় সত্যিই উত্তেজনাপূর্ণ। ফিউচার সার্কুলার কোলাইডার তৈরি করা যাবে কি না, তা জানতে বর্তমানে আমরা কাজ করছি। নতুন যন্ত্রটি হবে একটি পরবর্তী প্রজন্মের যন্ত্র। এই যন্ত্রের মাধ্যমে মহাবিশ্বের বিভিন্ন রহস্য জানার পাশাপাশি ঈশ্বর কণার বিষয়ে গবেষণাও করা যাবে। লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারে এসব করা যায় না। মেশিনটি দুই ধাপে তৈরি করা হবে। প্রথম পরীক্ষায় ইলেকট্রন ও পজিট্রনের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটানো হবে। আর দ্বিতীয় ধাপে ২০৭০ সালে প্রোটনকে একে অপরের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটানো হবে। ভূতাত্ত্বিক কারণে নতুন যন্ত্র লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারের চেয়ে ভূগর্ভে দ্বিগুণ দূরত্বে স্থাপন করতে হবে।


সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান