প্রবালের কথা মনে হলেই চোখের সামনে হরেক রঙের বৈচিত্র্যময় এক অবয়ব ফুটে ওঠে। এ যেন সমুদ্রের নিচে এক বিস্ময়কর জগৎ! তবে প্রবাল শুধু যে দেখতেই সুন্দর, তা নয়। সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রে এর অবদানও অসামান্য। বিজ্ঞানীদের ধারণা, সমুদ্রের ২৫ শতাংশ প্রজাতি প্রবালপ্রাচীরের মধ্যে বা এর আশপাশে বাস করে। ফলে সমুদ্রের নিচে বিশ্বের সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় আবাসস্থলের মধ্যে একটি হচ্ছে প্রবালপ্রাচীর। সামুদ্রিক জীব ছাড়াও প্রবালপ্রাচীর লাখো মানুষের খাদ্য এবং জীবিকার উৎস। শুধু তা–ই নয়, প্রবালপ্রাচীর সমুদ্রের দুর্যোগপূর্ণ ঢেউ এবং বন্যার ক্ষতি থেকে উপকূলকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত রক্ষা করে।
বৈশ্বিক উষ্ণতা এবং সমুদ্রের লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে ক্রমেই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে প্রবালপ্রাচীর। আর তাই দীর্ঘদিন থেকেই প্রবালপ্রাচীর রক্ষা করতে কাজ করছেন জীববিজ্ঞানীরা। প্রবাল পলিপ সংগ্রহ করে কৃত্রিম উপায়ে প্রবালপ্রাচীরের বংশবিস্তারের পাশাপাশি তাপরোধী প্রজাতির প্রবাল উদ্ভাবনেও কাজ করছেন তাঁরা।। শুধু তা–ই নয়, বিভিন্ন রোগ থেকে প্রবালপ্রাচীরকে রক্ষা করতে বিভিন্ন ধরনের প্রবায়োটিক নিয়েও পরীক্ষা চালাচ্ছেন। কিন্তু কিছুতেই প্রবালপ্রচীরের ক্ষতি ঠেকানো যাচ্ছে না।
অস্ট্রেলিয়ার জীববিজ্ঞানী টেরিন ফস্টার অস্ট্রেলিয়ার উপকূলবর্তী মৃতপ্রায় প্রবালপ্রাচীরগুলো নিয়ে গবেষণা করে যাচ্ছেন বহু বছর ধরে। ফস্টারের মতে, স্বাস্থ্যকর এবং উন্নতমানের প্রবাল পলিপ দিয়ে প্রবালপ্রাচীর প্রতিস্থাপন করা হলেও এদের স্বাভাবিক বাস্তুতন্ত্র ফিরে আসবে না। কারণ, ছোট প্রবাল পলিপ প্রবালপ্রাচীরের দেয়ালে অনেকটা ইটের মতো কাজ করে। সুস্থ সামুদ্রিক পরিবেশে পলিপ সমুদ্রের পানি থেকে ক্যালসিয়াম কার্বনেট সংগ্রহ করে প্রবাল কঙ্কাল গঠন করে। আর প্রবাল পলিপে কোষ বিভাজনের মাধ্যমে কঙ্কালের ওপর বিশাল প্রবাল তৈরি হয়।
কিন্তু জলবায়ুর পরিবর্তন, দূষণ প্রভৃতি কারণে বায়ুমণ্ডলে ধীরে ধীরে কার্বন ডাই–অক্সাইডের পরিমাণ বাড়ছে। ফলে সমুদ্রের পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ায় পলিপের পক্ষে কঙ্কাল গঠন সম্ভব হচ্ছে না। এমনকি পূর্বে বানানো কঙ্কালগুলো লবণাক্ত পানিতে গলে যাচ্ছে। শুধু তা–ই না, পানির লবণাক্ততা প্রবালপ্রাচীরের বৃদ্ধিও বাধাপ্রাপ্ত করছে।
সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডের উপকূল ঘেঁষে কোরাল সাগরে অবস্থিত বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রবালপ্রাচীর গ্রেট ব্যারিয়ার রিফেও প্রবালের বৃদ্ধি কমে গেছে। এর পেছনের একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে, তাপপ্রবাহের সময় প্রবালের টিস্যুর ভেতর যে ক্ষুদ্র শেওলা থাকে তা বের হয়ে যায়। এই শেওলা প্রবালপ্রাচীরে পুষ্টি সরবরাহ করে। শেওলার আস্তরণ প্রাচীরে না থাকার ফলে প্রাচীর ক্রমশ নষ্ট হতে থাকে, একপর্যায়ে ফ্যাকাশে রং ধারণ করে। এই পর্যায়ে প্রবালেরা মারা না গেলেও তারা খাদ্যস্বল্পতায় ভোগে এবং সহজে রোগাক্রান্ত হয়। প্রবালপ্রাচীরের এই ক্ষতি হাজার হাজার মাছ, কাঁকড়া এবং অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণীর ওপর বিধ্বংসী প্রভাব ফেলে। কারণ, তারা আশ্রয় এবং খাদ্যের জন্য এই প্রবালপ্রাচীরের ওপর নির্ভরশীল।
টেরিন ফস্টারের গবেষণা প্রবালপ্রাচীরের ধ্বংস রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তাঁর মতে, বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে ছড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি প্রবালের বৃদ্ধিপ্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করে প্রবালপ্রাচীরের ক্ষতি কমানো সম্ভব। আর এ কাজটি করার জন্যই তিনি রোবটকে কাজে লাগানোর কথা ভেবেছেন।
কৃত্রিম পদ্ধতিতে প্রবাল জন্মানো এবং তাদের প্রবালপ্রাচীরে প্রতিস্থাপন করা একটি কষ্টসাধ্য কাজ। এই প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত ধীর এবং ব্যয়বহুল। স্বাধারণত প্রবাল খুব ধীরগতিতে বাড়ে। প্রজাতিভেদে একটি পলিপ পূর্ণবয়স্ক প্রবাল কঙ্কালে বেড়ে উঠতে তিন থেকে ১০ বছর পর্যন্ত সময় প্রয়োজন হয়। ফস্টার এই বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে কাজ করছেন। এ জন্য তিনি ড্রাই কাস্টিং মেশিন ব্যবহার করে চুনাপাথর দিয়ে প্রবালের কঙ্কাল তৈরি করেন, যা মূলত ছোট প্রবালগুলোকে বেড়ে ওঠার একটা ভিত্তি তৈরি করে দেয়। ফলে দ্রুত প্রবাল বড় হয়। প্রবালপ্রাচীরের গঠন থেকে উৎসাহিত হয়ে ফস্টার প্রবাল কঙ্কালকে গম্বুজের আকারে তৈরি করেছেন, যার মধ্যে ছয়টি ছিপির মতো জায়গা রয়েছে। এই ছিপিগুলোর ভেতরে প্রবাল পলিপের টুকরা আঠা দিয়ে লাগানো যায়। এ ধরনের ভিতের কারণে প্রবাল দ্রুত ওপরের দিকে বাড়তে থাকে। ফস্টার পরীক্ষা করে দেখেন, পরবর্তী সময়ে এই ভিতসহ প্রবাল সাগরে প্রতিস্থাপন করা হলে সেগুলো এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে পূর্ণ আকারে পৌঁছাতে পারে। প্রবাল উৎপাদনের অন্যান্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে তুলনা করলে প্রবালের এ বেড়ে ওঠার গতি বেশ আশাজনক। তবে গম্বুজাকৃতি প্রবালের ভিত তৈরি বেশ সময়সাপেক্ষ। এমনকি মোড়কজাত করা বা কোনো কিছুর সঙ্গে যুক্ত করাও সহজ নয়।
সমস্যা সমাধানে ফস্টার ও তাঁর প্রতিষ্ঠান ‘কোরাল মেকার’ অস্ট্রেলিয়ার পশ্চিমে অ্যাব্রোলহোস দ্বীপে প্রবাল কঙ্কালের নিয়ে কাজ করেছেন। প্রথম ধাপে তাঁরা দেখেছেন, ডুবুরিরা সহজেই চুনাপাথরের কঙ্কাল বহন করতে পারে। এসব কঙ্কাল উপযুক্ত পরিবেশে সহজে মানিয়ে নিতে পারে। ২০২২ এর ডিসেম্বরে ফস্টার এবং তাঁর সহকর্মীরা নকশার কিছু পরিবর্তন নিয়ে আসেন। এরপর প্রবাল কঙ্কালগুলো তাদের খামারে চাষ করেন। এ সময় তাঁরা চাকতি আকৃতির প্রবাল কঙ্কাল বানিয়ে সফলও হয়েছেন। কারণ পলিপেরা প্রবাল কঙ্কালে খুব তাড়াতাড়ি প্রবাল বেড়ে উঠে এবং খুব দ্রুত তারা কঙ্কালটি ঢেকে ফেলে। চাকতির মতো গঠন এবং এর সঙ্গে হাতল সংযুক্ত থাকার ফলে প্রবাল কঙ্কালগুলো ডুবুরিরা সহজেই বহন করার পাশাপাশি সেগুলো রিমোট কন্ট্রোল যানের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করাও যায়।
ফস্টারের এই প্রবাল কঙ্কাল উৎপাদনের প্রক্রিয়া স্বয়ংক্রিয় করা গেলে প্রতিবছর প্রায় ৩ লাখ প্রবাল কঙ্কাল তৈরি করা যাবে। প্রবাল কঙ্কাল উৎপাদন স্বয়ংক্রিয় করতে ফস্টার অটোডেক্স এআই ল্যাবের সঙ্গে কাজ করছেন। এখানে তাঁরা ইমেজ সেন্সরসহ দুই ধরনের রোবট বানাচ্ছেন। প্রথমটি প্রবাল ছোট ছোট করে কেটে ছিপির সঙ্গে আঠা দিয়ে লাগাতে পারে। অন্যটি ছিপিসহ প্রবালগুলোকে চুনাপাথরের প্রবাল কঙ্কালে লাগাতে পারে।
সূত্র: উইয়ার্ড ডট কম