কাগজের উড়োজাহাজ ওড়ানো হচ্ছে আইজি নোবেল পুরস্কার অনুষ্ঠানে
কাগজের উড়োজাহাজ ওড়ানো হচ্ছে আইজি নোবেল পুরস্কার অনুষ্ঠানে

২০২৪ সালের আইজি নোবেল পুরস্কার, কী নিয়ে গবেষণা করে বিজয়ী হলেন কারা

অদ্ভুত সব গবেষণা ও আবিষ্কারের জন্য প্রতিবছর সত্যিকারের নোবেল পুরস্কার প্রদানের আগে ‘আইজি নোবেল’ পুরস্কার দেওয়া হয়। গত বৃহস্পতিবার রাতে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (এমআইটি) একটি অনুষ্ঠানে ২০২৪ সালের আইজি নোবেল বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়। এবারে আইজি নোবেল বিজয়ী তালিকায় অদ্ভুত সব আবিষ্কার আর গবেষণা রয়েছে বরাবরের মতো। হাস্যকর বা ব্যঙ্গাত্মক নোবেল বলে খ্যাত হলেও এই আয়োজনে প্রকৃত নোবেল বিজয়ীদের হাত থেকে পুরস্কার নিয়েছেন আইজি নোবেল বিজয়ীরা।

প্রথমে হাসুন, পরে ভাবুন

১৯৯১ সালে ‘প্রথমে হাসুন, পরে ভাবুন’ ভাবনা থেকে বিজ্ঞান ও উদ্ভাবনে হাস্যকর ও অপ্রচলিত গবেষণা, আবিষ্কারের জন্য আইজি নোবেল পুরস্কারের প্রচলন হয়েছে। নোবেল পুরস্কারের ব্যঙ্গ বা প্যারোডি হিসেবে আলোচিত হলেও আইজি (অনেকে ইগ উচ্চারণ করেন) নোবেলে সত্যিকারের আবিষ্কার ও উদ্ভাবনকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

এ বছরের আইজি নোবেলের প্রতিপাদ্য ছিল মার্ফিস নীতি। পদার্থবিজ্ঞানের এই নীতি অনুসারে ভুল হতে পারে, এমন কিছুর ভুল হবেই। এবারের আয়োজনে ছয়জন সত্যিকারের নোবেল পুরস্কার আইজি বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করেন। অনুষ্ঠানে ২০১৯ সালে অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী মার্কিন অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বন্দোপাধ্যায় ও তাঁর স্ত্রী নোবেল বিজয়ী এসথার ডুফলো, ২০২৩ সালে রসায়নে নোবেলজয়ী ফরাসি বিজ্ঞানী মুঙ্গি বাওয়েন্ডিকে দেখা যায়।

মলদ্বারের মাধ্যমে শ্বাস নিতে পারে স্তন্যপায়ী প্রাণীরা

শারীরবিদ্যায় স্তন্যপায়ী প্রাণীরা তাদের মলদ্বারের মাধ্যমে শ্বাস নিতে পারে, এমন তথ্য জানিয়ে বিজয়ী হয়েছেন একদল গবেষক। ইঁদুর ও শূকরের ওপর একাধিক পরীক্ষার পর এই জাপানি বিজ্ঞানীরা প্রাণীর মলদ্বারের মাধ্যমে সরবরাহ করা অক্সিজেন শোষণের বিষয়টি জানতে পারেন। এই পদ্ধতি শ্বাসযন্ত্রের ব্যর্থতার চিকিত্সা করতে পারে কি না, তা দেখার জন্য রীতিমতো ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সিনসিনাটি চিলড্রেনস হসপিটাল মেডিকেল সেন্টারের বিজ্ঞানী তাকানোরি তেকবে পুরস্কার নিয়ে বলেন, এটা মিশ্র অনুভূতি। লোকদের হাসানোর পরে চিন্তা করার জন্য এমন স্বীকৃতি অনুপ্রেরণার।

পিছিয়ে থাকা স্থানে বয়স্ক মানুষ বেশি পাওয়া যায়

যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী সাউল নিউম্যান জনসংখ্যা নিয়ে গবেষণার জন্য পুরস্কার জিতেছেন। তাঁর গবেষণায় প্রমাণ করেছেন যেসব অঞ্চলে দারিদ্র্য বেশি ও সামাজিকভাবে পিছিয়ে রয়েছে, সেসব জায়গা থেকে বেশি বয়ষ্ক মানুষের তথ্য আসে। এর পেছনে কারণ হলো, করণিক ত্রুটি ও পেনশন জালিয়াতি। পেনশন জালিয়াতি যেখানে বেশি হয়, সেখানে বেশি বয়ষ্ক মানুষের বসবাসের খবর পাওয়া যায়।

চুলের ঘূর্ণি

ফ্রান্সের প্যারিসের নেকার-এনফ্যান্টস ম্যালাডেস ইউনিভার্সিটি হাসপাতালের অধ্যাপক রোমান খন্সারি ও তাঁর সহকর্মীরা মাথার চুলের ঘূর্ণি নিয়ে এক বৈশ্বিক গবেষণার জন্য অ্যানাটমি শ্রেণিতে আইজি নোবেল পুরস্কার জিতেছেন। বেশির ভাগ মানুষের মাথার চুল ঘড়ির কাঁটার দিকে সর্পিল দেখা যায়। তাঁদের গবেষণায় দেখা গেছে, দক্ষিণ গোলার্ধে ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে সর্পিল হয়। অধ্যাপক রোমান খন্সারি বলেন, ‘আমি যখন পুরস্কারের জন্য ফোনকল পেয়েছি, তখন আমি কাজ করছিলাম। আমি অত্যন্ত আনন্দিত।’ এই গবেষণার অনস্বীকার্য অপ্রাসঙ্গিকতা থাকা সত্ত্বেও প্রকৃতির নিদর্শন নিয়ে এটি মৌলিক আবিষ্কার হতে পারে।

কবুতর কী ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ন্ত্রণ করবে?

এবারের আয়োজনে ক্ষেপণাস্ত্রকে লক্ষ্যবস্তুতে আক্রমণের জন্য কবুতরের অদ্ভুত ব্যবহার আবিষ্কারের জন্য পুরস্কার দেওয়া হয়। গবেষণার ফলাফলকে গুরুত্ব দিয়ে শান্তিতে আইজি নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে প্রয়াত মার্কিন মনোবিজ্ঞানী বিএফ স্কিনারকে। তিনি ক্ষেপণাস্ত্রের ভেতরে জীবন্ত কবুতর রেখে ক্ষেপণাস্ত্রকে লক্ষ্যবস্তুর দিকে নিয়ে যাওয়ার সম্ভাব্যতা খুঁজেছেন। এটিকে তিনি ‘ক্র্যাকপট’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। তিনি একটি কবুতরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির উপকূলরেখার মানচিত্র চিনিয়েছিলেন। মনোবিজ্ঞানী স্কিনারের মতে, একটি জীবন্ত কবুতর তার স্বাভাবিক কাজ করেছিল।

গাছেরও কি দৃষ্টি আছে?

উদ্ভিদবিদ্যায় এবারের আইজি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন যৌথভাবে যুক্তরাষ্ট্রের জ্যাকব হোয়াইট ও জার্মানির ফেলিপ ইয়ামাশিতা। দক্ষিণ আমেরিকার উদ্ভিদ বোকুইলা ট্রাইফোলিওলাটা আশপাশে রাখা প্লাস্টিকের গাছের পাতার অনুকরণ করতে পারে। তাঁরা উদ্ভিদের দৃষ্টি আছে বলে যুক্তিসংগত অনুমানকে প্রমাণ করার জন্য আলোচনায় এসেছেন।

তবে কী নকল ওষুধই বেশি কার্যকর

ওষুধবিজ্ঞানে আইজি নোবেল পেয়েছেন সুইস, জার্মান ও বেলজিয়ান একদল বিজ্ঞানী। নকল ওষুধের কার্যকারিতার বিষয়ে তাঁরা অসাধারণ গবেষণা করেন। রোগীদের মধ্যে নকল বা জাল ওষুধের কারণে বেদনাদায়ক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টির বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করেন তাঁরা। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টিকারী নকল ওষুধ বেশি কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে তাঁদের গবেষণায়।

মৃত ট্রাউটও দক্ষ সাঁতারে

পদার্থবিজ্ঞানে আইজি নোবেল পেয়েছেন ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস লিয়াও। মৃত ট্রাউট মাছের সাঁতারের ক্ষমতা সম্পর্কে অনেক গবেষণাপত্র প্রকাশনার জন্য তাঁকে এই সম্মাননা দেওয়া হয়েছে।

টস নিয়ে গবেষণা

সম্ভাবনার ক্ষেত্রে আইজি নোবেল পেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যানের অধ্যাপক ও সাবেক জাদুকর পার্সি ডায়াকোনিস। তিনি একটি হাইপোথিসিস পরীক্ষা করায় ৫০ গবেষককে নিয়ে কাজ করেন। সেই গবেষকদের বেশির ভাগই ছিলেন ডাচ। যাঁরা ৩ লাখ ৫০ হাজার ৭৫৭টি মুদ্রা নিয়ে ক্রিকেট খেলার মতো টস করেন। ওপরে ছুড়ে দেওয়া মুদ্রা ডায়াকোনিসের ভবিষ্যদ্বাণীকে সমর্থন করতে দেখা যায়। গবেষণায় দেখা যায়, মুদ্রা যেভাবে ওপরে ছোড়া হয়, একইভাবে সেই মুদ্রা অবতরণ করার সম্ভাবনা বেশি।

ক্ষেপণাস্ত্রের নিয়ন্ত্রণে কবুতরের ভূমিকা নিয়ে বিএফ স্কিনারের গবেষণার নকশা

কৃমিও মাতাল হয়

রসায়নে আইজি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন নেদারল্যান্ডসের বিজ্ঞানীরা। আমস্টারডামের একদল বিজ্ঞানী পলিমার বিজ্ঞানের নামে ক্রোমাটোগ্রাফি ব্যবহার করে মাতাল ও শান্ত কৃমি আলাদা করার কৌশল নিয়ে কাজ করেছেন।

গাভীর দুধ উৎপাদন কম না বেশি

জীববিদ্যায় মরণোত্তর আইজি নোবেল পেয়েছেন প্রয়াত ফোরডিস এলি ও উইলিয়াম পিটারসেন। ১৯৪০ সালে গাভীর দুধ উৎপাদনকে প্রভাবিত করার জন্য তাঁরা অনেক কাজ করেছিলেন। অ্যানিম্যাল সায়েন্স জার্নাল থেকে জানা যায়, দুই গবেষক গরুর পিঠে একটি বিড়াল রেখে দুধের প্রবাহ পরিবর্তিত হয়েছে কি না, তার ওপর নজর রাখতেন। বারবার কাগজের ব্যাগে শব্দ করে আতঙ্ক ছড়ানো হয় গাভীদের মধ্যে। এতে দেখা যায়, গাভী থেকে কম দুধ পাওয়া যাচ্ছে। গবেষকেরা লিখেছেন, প্রথমে গরুদের ভয় দেখানোর মধ্যে ছিল পিঠে একটি বিড়াল রাখা হয়। দুই মিনিট ধরে প্রতি ১০ সেকেন্ডে কাগজের ব্যাগ দিয়ে বিস্ফোরণের শব্দ করা হয়। পরে অবশ্য বিড়ালটিকে অপ্রয়োজনীয় হিসেবে বিদায় করে দেওয়া হয়েছিল।

আইজি নোবেল পুরস্কারের অর্থমূল্য কত?

১৯৯১ সাল থেকে বৈজ্ঞানিক কৌতুক সাময়িকী ‘অ্যানালস অব ইমপ্রোবেবল রিসার্চ’ (এআইআর) ইগ নোবেল পুরস্কারের আয়োজন করে। প্রতিবছরই এমআইটিতে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বিজয়ীদের বক্তৃতা দিতে হয়। পুরস্কার হিসেবে স্মারকের সঙ্গে বিজয়ীরা ১০০ ট্রিলিয়ন (১ ট্রিলিয়ন = ১০০০ বিলিয়ন) জিম্বাবুয়েন ডলারের একটি একক ব্যাংক নোট পান। এই নোটের মূল্যমান আসলে ৪০ মার্কিন সেন্ট।

সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান