বিখ্যাত গায়িকা লতা মঙ্গেশকর গেয়েছেন, ‘ও মোর ময়না গো, কার কারণে তুমি একেলা? কার বিহনে বিহনে দিবানিশি যে উতলা?’ ময়না পাখির উতলা হওয়ার রহস্য গায়িকা লতা মঙ্গেশকর জেনেছিলেন কি না, তা জানা যায়নি। তবে বিশ্বের দ্রুততম পাখি হামিংবার্ড কেন উতলা, কীভাবে ওড়ে, কীভাবে মৌমাছির মতো নাচানাচি করে তার কৌশল এবার উন্মোচন করেছে একদল গবেষক।
তাদের মতে, অন্যান্য পাখিরা ওড়ার সময় ডানা ভাঁজ করলেও হামিংবার্ড তা করতে পারে না। একপাশ হয়ে ও বুলেটের গতিতে ছুটে চলার মতো দুটি কৌশল খাঁটিয়েই এই পাখিরা ওড়ে থাকে। তবে ঘন ঝোপঝাঁড়ের মধ্য দিয়ে হামিংবার্ড কীভাবে চলাফেরা করে, তা নিয়ে এখনো রহস্য রয়ে গেছে।
হামিংবার্ডের ওড়ার কৌশল জানার চেষ্টায় বড় ধরনের সাফল্য এসেছে বলে দাবি করেছেন গবেষকেরা। গবেষণায় উচ্চগতির ক্যামেরার মাধ্যমে হামিংবার্ড কীভাবে ওড়ে, তা ধারণ করা হয়। ভিডিওতে দেখা যায় হামিংবার্ড খুবই সরু জায়গা দিয়ে ওড়ে যেতে পারে। কিছুটা একপাশ হয়ে সরু জায়গার মাঝখানের খালি জায়গা দিয়ে ওড়ে যায় এই পাখি। দ্রুত ছুটে চলার সময় নিজেদের ডানা পেছনে ভাঁজ করে ফেলে। এ সময় এত দ্রুত হামিংবার্ড ছুটে যায় যে মানুষের চোখে তা ভালোভাবে ধরা পড়ে না।
হামিংবার্ড ফুলের মধু রেণু খেয়ে জীবনধারণ করে। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলের গবেষক মার্ক ব্যাজার বলেন, ‘আমার জানালা থেকে হামিংবার্ড দেখা যায়। জানালা দিয়ে প্রতিদিন এই পাখি কীভাবে ওড়ে, তা দেখার সময় গবেষণার কথা মাথায় আসে। শক্তিশালী পাখিরা হামিংবার্ডকে তাড়া করে মাঝেমধ্যেই, তখন হামিংবার্ডগুলো ঘন ঝোপঝাড়ের মধ্যে প্রবেশ করে অন্য দিক দিয়ে বের হয়ে যায়। তাদের এই চলে যাওয়ার কৌশল অবাক করার মতো। দেখে মনে হবে আক্ষরিকভাবে হামিংবার্ড ঝোপের দেয়াল ভেদ করে অন্য দিকে চলে যাচ্ছে।’
গবেষণায় চারটি অ্যানাস হামিংবার্ডের ওপর পরীক্ষা চালানো হয়। উত্তর আমেরিকায় হামিংবার্ডের যত প্রজাতি পাওয়া যায়, তার মধ্যে অ্যানাস হামিংবার্ড অন্যতম। এই পাখিদের বৈজ্ঞানিক নাম ক্যালিপ্টে অ্যানা। এদের ডানার আকার প্রায় ১২ সেন্টিমিটার এবং ওজন সর্বোচ্চ ৫ গ্রাম।
পরীক্ষা চলাকালে একটি ফুলের আকৃতির বোতলে মধু রাখা হয়। এই মধু আহরণের সময় প্রতিবার ফুলের সরু ফাঁক দিয়ে ওড়ে গেছে হামিংবার্ড। এ সময় শক্তিশালী ক্যামেরায় ধারণ করা ভিডিও কম্পিউটার প্রোগ্রামের মাধ্যমে পর্যালোচনা করে প্রতিটি পাখির ঠোঁট ও ডানার অবস্থান শনাক্ত করা হয়। গবেষণা চলাকালে ফুলের সরু জায়গার ব্যবধান ধীরে ধীরে কমিয়ে ছয় সেন্টিমিটার করা হলেও হামিংবার্ডকে ওড়ে যেতে দেখা যায়।
গবেষণায় হামিংবার্ডের ওড়ার দুটি কৌশলের খোঁজ পাওয়া গেছে। প্রথম কৌশলে দেখা যায়, হামিংবার্ড ধীরে ধীরে সরু জায়গার কাছে যায়। এরপর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে একপাশে বেঁকে ওড়ে যায়। আরেকটি কৌশল দেখে চমকে যান গবেষকেরা। সেই কৌশলে দেখা যায় হামিংবার্ড সরু জায়গার কাছে দ্রুত চলে যায়।
সামনে গিয়ে তাদের ডানা সম্পূর্ণভাবে পেছনে ভাঁজ করে ফেলে। শরীরের আকার তখন বর্শার মতো দেখা যায়। সেই সময় সরু জায়গা দিয়ে দ্রুত ছুটে যায় তারা। সরু জায়গা থেকে বেরিয়েই ডানা আবার খুলে ফেলে।
জার্নাল অব এক্সপেরিমেন্টাল বায়োলজিতে হামিংবার্ডের ওড়ার কৌশল নিয়ে বিস্তারিত গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, প্রথম কৌশলটি কিছুটা ধীরগতির। হামিংবার্ড যদি পরিবেশের সঙ্গে পরিচিত থাকে তাহলে এই কৌশল ব্যবহার করে। কিন্তু পরিস্থিতি যদি ভিন্ন বা বিপন্ন হয়, আশপাশে শিকারির উপস্থিতি থাকে তাহলে দ্বিতীয় কৌশল ব্যবহার করে দ্রুতগতিতে স্থান ত্যাগ করে হামিংবার্ড। ওড়ার সময় বেশি ডানা ঝাপটানো হলে আঘাতের ঝুঁকি থাকে। যে কারণে সরু জায়গা দিয়ে যাওয়ার সময় হামিংবার্ড ডানা গুটিয়ে নেয়। রিভারসাইড ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ক্রিস্টোফার জে ক্লার্ক বলেন, ‘হামিংবার্ডের ডানা বেশির ভাগ পাখির চেয়ে আলাদা। এই গবেষণাটি এই পাখিদের ওড়ার কৌশল কীভাবে বিকশিত হয়েছে, সে সম্পর্কে ধারণা দিচ্ছে।’
সূত্র: নিউ সায়েন্টিস্ট