বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকে বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংয়ের কাজের সঙ্গে আমার পরিচয়। বিশেষ করে ‘দ্য ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’ পড়ার পর থেকে আমি প্রায়শ বিস্মিত হতাম, কী করে একজন মানুষ শুধু মনন আর মেধা নিয়ে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা জয় করতে পারেন। খুব শখ ছিল একদিন তাঁর সঙ্গে দেখা করব। কিন্তু সেটা আর হয়নি। কারণ, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্টিফেন হকিংয়ের অফিস কক্ষের সামনে যাই ২০১৯ সালের জুলাই মাসে। তত দিনে তিনি ওয়ার্মহোল দিয়ে অন্য দুনিয়ায় চলে গেছেন। ফলে তাঁর রুমে আর ঢোকা হলো না।
কিন্তু এর অনেক আগে তাঁর ওখানে গেছে আমার দুই চরিত্র। তারা দেখে এসেছে, হকিংয়ের রুমে দুজন লোকের পোস্টার আছে। টেবিলে আপনি তাঁর সঙ্গে যদি বসেন, তাহলে আপনি দেখবেন, তাঁর পেছনে আইনস্টাইনের ছবি। হকিং আলবার্ট আইনস্টাইনের জানানো জগতের লোক। আর আপনার পেছনে আর একটা ছবি। হকিংয়ের রুমের দরজায় লাগানো মেরিলিন মনরো!
হ্যাঁ, মেরিলিন মনরোই ছিলেন আমাদের কালের নায়ক স্টিফেন উইলিয়াম হকিংয়ের প্রিয় নায়িকা ও অনুপ্রেরণার উৎস। আপনি যদি তাঁর সঙ্গে বেশিক্ষণ থাকার সুযোগ পেতেন, তাহলে হয়তো তাঁর সহকারী বা নার্স এসে তাঁকে পানি বা কফি পান করিয়ে যেত। তখন আপনি অবাক হয়ে দেখতেন, যে মগে করে হকিং কফি বা পানি খাচ্ছেন, সেটির গায়েও বসে আছেন লাস্যময়ী মেরিলিন মনরো।
এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে হকিংয়ের কাছে জানতে চাওয়া হয়, যদি কোনো মরুভূমিতে আপনাকে নির্বাসনে পাঠানো হয়, তাহলে কোন তিনজনকে আপনি সঙ্গে নেবেন?
হকিংয়ের সহজ উত্তর—মেরিলিন মনরো, গ্যালিলিও গ্যালিলি ও আলবার্ট আইনস্টাইন। গ্যালিলিও আর আইনস্টাইনের সঙ্গে মেরিলিন মনরোই হকিংয়ের সঙ্গী হবেন মরুভূমিতে!
হকিংয়ের জন্ম ১৯৪২ সালের ৮ জানুয়ারি। বিজ্ঞান জগতের মানুষের কাছে এ তারিখটির আলাদা ব্যঞ্জনা আছে। কারণ, এর ঠিক ৩০০ বছর আগে এই দিনে গ্যালিলিও গ্যালিলি ধরাধামের মায়া ত্যাগ করেন, তবে হকিংকে একথা মনে করিয়ে দিলে তিনি বলতেন—ধুর। ওদিন শুধু লন্ডনেই ২০০ ছেলেমেয়ের জন্ম হয়েছে।
হকিংয়ের জন্মের সময় মডেল হিসেবে মোটামুটি জানাশোনা হয়ে গেছে নোরমা জিনের। নোরমা জিন তখন সুইট সিক্সটিন। তার কিছুদিন পরই নোরমা জিন হয়ে যান মেরিলিন মনরো এবং প্রথম আবির্ভাবের পর থেকে হয়ে যান লাখো কোটি তরুণের হৃদয়েশ্বরী। এই সময় শোনা যায়, এমন কোনো বিখ্যাত ব্যক্তি নেই, যার সঙ্গে মনরোর যোগাযোগ বা সম্পর্ক নেই। এমনকি বিজ্ঞানী আইনস্টাইনও এই লিস্টে আছেন।
অভিনেত্রী শেলি উইন্টারের সঙ্গে একই অ্যাপার্টমেন্টে থাকতেন মেরিলিন মনরো, ১৯৪৭ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত। সেখানে একদিন শেলি ও মনরো মিলে একটা তালিকা করেন। সব বিখ্যাত মানুষের নাম। শেলির বক্তব্য হলো মনরোর উচিত হবে এদের সবার সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলা! তালিকায় মনরো একটা নতুন নাম যোগ করেন সবার নিচে—আলবার্ট আইনস্টাইন! বিজ্ঞানীর নাম দেখে হতবাক শেলি বললেন, উনি একজন সায়েন্টিস্ট এবং বুড়ো। জবাবে শুধু একটি মুচকি হাসি দেন মেরিলিন মনরো।
১৯৮২ সালে একটি নাটকে দেখা যায়, আইনস্টাইনের সঙ্গে মনরোর দেখা হয়েছে একটি হোটেল কক্ষে। ১৯৮৫ সালে ওই নাটকটি সিনেমা হয়। ইনসিগনিফিকেন্ট নামে ওই সিনেমায় দেখা যায়, আইনস্টাইন হোটেল কক্ষে বসে অঙ্ক করছেন, আর মেরিলিন মনরো দরজায় নক করেন। মনরো আইনস্টাইনকে জানান, তার কিছু আলাপ আছে এবং সে বিজ্ঞানীকে থিওরি অব রিলেটিভিটি নিয়ে তার ব্যাখ্যা দিতে চান। আইনস্টাইন তখন তাকে কক্ষের ভেতরে নিয়ে যান। আইনস্টাইনকে মনরোর রিলেটিভিটি বোঝানোর অংশটা ইউটিউবে দেখা যেতে পারে (https://www.youtube.com/watch?v=lfxcHsioYfM)
মনে আছে তো, আইনস্টাইনের কাছে একবার আপেক্ষিকতার সহজ ব্যাখ্যা চাওয়া হলে তিনি বলেছিলেন, যেকোনো সেমিনারে ১০ মিনিটকে মনে হয় এক ঘণ্টা, কিন্তু যদি কোনো সুন্দরী অভিনেত্রীর সঙ্গে আপনি গল্প করতে পারেন, তাহলে দেখবেন মাত্র দুই মিনিটে এক ঘণ্টা চলে গেছে! এটাই আপেক্ষিকতা। (আইনস্টাইন বাঙালি হলে বলতেন এটাই সায়েন্স)। আমার মতো লোকেরা বলবে, আইনস্টাইন আসলে সুন্দরী অভিনেত্রী হিসেবে মেরিলিন মনরোর কথা বলেছেন, নামোল্লেখ না করে।
হকিংয়ে ফেরা যাক। অক্সফোর্ড থেকে কেমব্রিজে ফেরার পরপরই সবার জানা হয়ে যায়, হকিং হচ্ছেন মেরিলিনের পাগলা ভক্ত। এ সময় মেরিলিনের একবার ইংল্যান্ডে আসার কথা। সেই অনুষ্ঠানে থাকার জন্য হকিং সব প্রস্তুতি নিয়ে রাখেন, কিন্তু সেই সফর আর হয়নি। তারপর তো ১৯৬২ সালে মেরিলিন মনরোর রহস্যজনক মৃত্যু হলো। মনরোর মৃত্যুর পরই কেবল স্টিভেন হকিং কোনো না কোনো মেয়ের প্রেমে পড়েন। মনরোর মৃত্যুর পরই কেবল তাঁর জেন ওয়াইল্ডকে পছন্দ হয়। ১৯৬৫ সালে তাঁদের বিয়ে হয়।
হকিংয়ের রুমে হকিংয়ের সঙ্গে আলাপ শেষে ফেরার সময় আপনি তাঁর ডেস্কের দিকে ভালোভাবে নজর দিতে পারেন। হকিংয়ের ডেস্কে তিনটি ছবির ফ্রেম। একটিতে তাঁর তিন সন্তানের সঙ্গে প্রথম স্ত্রী জেন ওয়াইল্ড। পরেরটি হকিংয়ের দ্বিতীয় বিয়ের ছবি, স্ত্রী এলিনা হকিংয়ের সঙ্গে।
তৃতীয় ছবিটি দেখে আপনি চমকে যাবেন। ওই ছবিতে আপনি দেখবেন, হুইলচেয়ারে বসে আছেন স্টিফেন হকিং আর তাঁর পেছনে একটি ক্যাডিলাক গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন হকিংয়ের প্রিয় নায়িকা। আপনি অবাক হয়ে হকিংয়ের দিকে তাকালে দেখবেন, তিনি তাঁর বিখ্যাত হাসি হাসছেন।
মনরোর বিখ্যাত যে স্থিরচিত্রগুলো আমরা দেখি, সেগুলোর বেশির ভাগই ফটোগ্রাফার মিল্টন এইচ গ্রিন তুলেছেন। এই আমেরিকান ফ্যাশন ফটোগ্রাফারই মেরেলিন মনরোর অনেক ছবি তুলে নিজেও বিখ্যাত হয়েছেন। তাঁর ছেলে জোশুয়া গ্রিন যখন জানতে পারেন, হকিং মেরিলিন মনরোর ডাই হার্ড ফ্যান, তখন তিনি হকিংকে চমকে দেওয়ার আয়োজন করেন। বাবার তোলা ক্যাডিলাক গাড়ির সামনে মেরিলিন মনরোর বিখ্যাত ছবিটিতে হকিংকে ডিজিটালি যোগ করে দেন। ছবিটি হকিংকে উপহার দেন। এই ছবি আপনি দেখছেন হকিংয়ের ডেস্কে!
থিওরি অব এভরিথিং সিনেমার সেটে এই ছবিটা আবার রিক্রিয়েট করা হয়। সেখানে হকিংয়ের ভূমিকায় অভিনেতা এডি রেডমায়ানের পেছনে মেরিলিন মনরোর পোজ দিয়েছেন সুজি কেনেডি!