বিংশ শতাব্দীর প্রাক্কালে চিকিৎসা বিজ্ঞানের সমস্যাগুলো আণবিক ভিত্তিতে সমাধানের জন্য জীববিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ শাখাগুলোর উদ্ভব ঘটেছে । ইতিপূর্বে চিকিৎসকরা অঙ্গ ও কলাসংক্রান্ত জটিলতাগুলো লক্ষণের ভিত্তিতে শনাক্ত করলেও তাদের উৎস নির্ণয় করতে পারতেন না। নির্দিষ্ট এনজাইম ও মেটাবোলাইটের কার্যকারিতা পরীক্ষা অথবা কোষের সংখ্যা ও আকৃতির পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করে অঙ্গসংক্রান্ত বিকলাঙ্গতার কারণ অনুসন্ধান প্রথমে বায়োকেমিস্ট্রির সহায়তাতে শুরু হয়েছিল। ক্রোমাটোগ্রাফি, স্পেক্ট্রোস্কপি ও মলিকুলার ডাইনামিক্সের উন্নততর যন্ত্রপাতি উদ্ভাবনের সাথে সাথে এ সকল পদ্ধতির আরও অগ্রগতি হয়েছে।
১৯৫০ সালে ডিএনএর গঠন আবিষ্কার এবং ২০০০ সালে হিউম্যান জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের মাধ্যমে রোগের শনাক্তকরণ ও চিকিৎসা সংক্রান্ত জ্ঞানের শূন্যস্থানগুলো পূরণ করতে বায়োকেমিস্ট্রি ও মলিকুলার বায়োলজি এবং এর সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য শাখা যেমন জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অপরিহার্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে পাল্লা দিয়ে অণুজীবের সংখ্যা বৃদ্ধি অণুজীববিজ্ঞানকে আরও জটিল করে তুলেছে। একইসাথে একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে প্রচুর পরিমাণ সিকোয়েন্স ডেটা ও অন্যান্য সহজলভ্য হওয়ার ফলে সেগুলো বিশ্লেষণের জন্য বায়োইনফরমেটিক্সের জন্ম হয়েছে। তাই আণবিক জীববিজ্ঞান ও হাজার হাজার গিগাবাইট ডেটা বিশ্লেষণের দক্ষতা শুধু চিকিৎসাখাতের জন্যই নয়, বরং স্বাস্থ্য, কৃষি ও পরিবেশের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ ।
বায়োকেমিস্ট, মলিকুলার বায়োলজিস্ট ও এগুলোর সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য বিশেষজ্ঞদের ভূমিকা তাই স্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট। তারা আণবিক জীববিজ্ঞান ও বিভিন্ন রোগসনাক্তকরণে অভিজ্ঞ এটি পূর্ব থেকেই প্রচলিত এবং কোভিড-১৯ মহামারীর প্রাক্কালে তা নতুনভাবে প্রমাণিত হয়েছে। বায়োকেমিস্ট, মলিকুলার বায়োলজিস্ট ও অন্যান্য বিজ্ঞানীরা শুধু ঢাকায়ই নয়, সারা দেশেই আদর্শ আরটি-পিসিআর ল্যাব স্থাপনে সহায়তা করেছেন। তারা এখনও নিরলসভাবে এই কাজ করে যাচ্ছেন। শুধু টেস্ট করাই নয়, সংশ্লিষ্ট চিকিৎসা ও নমুনা সংগ্রহে যুক্ত ডাক্তারদের কাছে টেস্টের রেজাল্ট বিশ্লেষণ করে রোগ সনাক্তকরণের গুরুদায়িত্বও তারা পালন করেছেন। অন্যভাবে বলা যায়, বায়োকেমিস্ট, মলিকুলার বায়োলজিস্ট ও ডাক্তারদের সম্মিলিত চেষ্টা কোভিড-১৯ মহামারী জনিত সমস্যা মোকাবিলার জন্য প্রয়োজন ছিল। বায়োকেমিস্টগণ অধিকাংশ আণবিক রোগনির্ণয় পদ্ধতি সম্পর্কে শিক্ষাপ্রাপ্ত ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অভিজ্ঞ হওয়ায় তারা যে সকল ফলাফল নির্ণয় করেন তা পুনরায় চিকিৎসকদের দ্বারা সত্যায়িত করার কোন প্রয়োজন নেই। কারণ চিকিৎসকগণ আণবিক রোগনির্ণয় পদ্ধতি সম্পর্কিত সূক্ষ বিষয়গুলো অধ্যয়ন করেন না, যদিও তারা পরীক্ষায় প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে রোগীকে কি কি ওষুধ দিতে হবে সেটি জানেন। বায়োকেমিস্ট, মলিকুলার বায়োলজিস্ট ও অন্যান্য অভিজ্ঞদের দ্বারা পরীক্ষিত মলিকুলার ডায়াগনস্টিক ফলাফল পুনরায় চিকিৎসকদের দ্বারা সত্যায়িত করা শুধু অপ্রয়োজনীয়ই নয়, বরং সময়ের অপচয় মাত্র। কারণ চিকিৎসকগণ এই বিষয়ে প্রশিক্ষিত হননি। চিকিৎসকরা মূলত রোগের লক্ষণ নিয়ে কাজ করেন, কিন্তু বায়োকেমিস্ট, মলিকুলার বায়োলজিস্ট ও অন্যান্য অভিজ্ঞরা তাদের ৪-৫ বছরের দীর্ঘ অভিজ্ঞতার আলোকে রোগের উৎস নির্ণয়ে ক্লিনিক্যাল, মলিকুলার ও জিনগত পরীক্ষা করেন।
যেমন সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের প্রতি রোগির প্রতিক্রিয়া ও প্রতিরোধ ক্ষমতা একজন ডাক্তারই কেবল ভালভাবে বুঝতে পারেন, তেমনই একজন বায়োকেমিস্ট আরটি-পিসিআর টেস্টে প্রাপ্ত বিভিন্ন ফলাফল বিশ্লেষণ করে রোগ সনাক্ত করতে পারেন। আরটি-পিসিআর টেস্টের সাহায্যে কোভিড-১৯ রোগের বিভিন্ন ধাপে রোগীর শরীরে সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের ঘনত্ব নির্ণয় করা যায়। এছাড়াও এই ভাইরাসের বিভিন্ন স্ট্রেইন ভিন্ন ভিন্ন ঘনত্বে রোগীর শরীরে বিস্তার লাভ করে। যেমন ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের ঘনত্ব আলফা ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে ১০০০ গুণ বেশি থাকে। একটি ভাইরাল ডিএনএ কপির নির্দিষ্ট ঘনত্বে পৌঁছাতে কত পিসিআর চক্রের প্রয়োজন হয়, তা Ct মানের সাহায্যে জানা যায়। এই বিক্রিয়ায় দুটি প্রাইমারের দরকার হয়। একজন বায়োকেমিস্ট এসবকিছু বিবেচনা করে পরীক্ষার ফলাফল পজিটিভ নাকি নেগেটিভ তা নির্ণয় করেন। এর জন্য রিঅ্যাকশন কার্ভ বিশ্লেষণের প্রয়োজন হয়। রোগীর অনাক্রম্যতা, ভাইরাসের ঘনত্ব এবং রোগের ধাপের বিভিন্নতার কারণে আগের দিন নমুনা সংগ্রহ করে পরের দিন পরীক্ষা করলে নেগেটিভ ফলাফলও কখনো কখনো পজিটিভ আস্অতে পারে। তাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোভিড-১৯ থেকে আরোগ্যপ্রাপ্ত রোগীকে ১০ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে পরপর দুটি পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দিয়েছে।
অধিকাংশ সমস্যার সমাধানের জন্যই একাধিক প্রচেষ্টার দরকার হয় বিশেষত সেটি যদি চিকিৎসা অথবা জীববিজ্ঞান সম্পর্কিত সমস্যা হয়। শুধু একত্রে কাজ করাই নয়, দেশের নানাবিধ সমস্যার সফল ও দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের জন্য পারস্পরিক বোঝাপড়া ও সন্মান যেমন জরুরী, তেমনই প্রয়োজন পারস্পরিক সহযোগিতার।
লেখক: বিভাগীয় প্রধান, প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
অনুবাদ: অনিক কুমার সাহা, প্রাক্তন শিক্ষার্থী, প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়