বিল গেটস
বিল গেটস

ডিজিটালই ভবিষ্যৎ

মাইক্রোসফটের সহপ্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস পেশাগত কাজ থেকে অবসর নিলেও বিশ্বের নানা প্রান্তের বিজ্ঞান ও উদ্ভাবনসংক্রান্ত গবেষণার বিষয়ে নিয়মিত খোঁজখবর রাখেন। সম্প্রতি তিনি ভবিষ্যতের ডিজিটাল সেবা কেমন হবে, তা নিয়ে একটি লেখা নিজের লিংকড–ইন অ্যাকাউন্টে প্রকাশ করেছেন। এই লেখায় বিশ্বব্যাপী ডিজিটাল পাবলিক ইনফ্রাস্ট্রাকচার বা ডিপিআই বিপ্লব আসছে, তা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন তিনি। পাঠকদের জন্য লেখাটি তুলে ধরা হলো।

প্রায় ৩০ বছর আগে, আমি ‘দ্য রোড অ্যাহেড’ নামে একটি বই লিখেছিলাম। বইটি ছিল ইন্টারনেট ও অন্যান্য নতুন ডিজিটাল প্রযুক্তির আবির্ভাবে যে সম্ভাবনা তৈরি হয়, তা নিয়ে। তখন আমি একটি আলাদা বিশ্বের কল্পনা করেছিলাম। সেখানে অনলাইন পেমেন্ট (লেনদেন) ও ই-গভর্নমেন্টের মাধ্যমে অর্থ, সেবা আর পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ করার মাধ্যম নিয়ে কথা বলেছিলাম। আজ ডিপিআইয়ের উন্নয়নের কারণে সেই সব ধারণার বেশির ভাগই বাস্তবে পরিণত হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে নানা দেশ ভ্রমণ করে আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি কীভাবে ডিজিটাল মাধ্যম জনগণকে সেবা দেওয়া, সংকটে সাড়া দেওয়া ও অর্থনীতির বৃদ্ধিতে বিপ্লব ঘটাচ্ছে। আর গেটস ফাউন্ডেশনে আমরা দরিদ্র দেশে জীবন বাঁচাতে ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই করছি। আমাদের কাজে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে ডিপিআই।

ডিপিআইয়ের কয়েকটি মূল উপাদান রয়েছে। ডিজিটাল পরিচিতি ব্যবস্থার মাধ্যমে আপনি কে, তা প্রমাণ করেন। এই পদ্ধতি ব্যবহারে নিরাপদে তাৎক্ষণিক ও সস্তায় অর্থ আদান-প্রদান করা যায়। ডেটা বিনিময় মাধ্যম বা প্ল্যাটফর্ম বিভিন্ন সেবাকে নির্বিঘ্নে একসঙ্গে কাজ করার সুযোগ দেয়। এই সিস্টেম ও প্ল্যাটফর্ম ডিজিটাল বিশ্বে রাস্তা, সেতু ও বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের মতো। ডিজিটাল মাধ্যমে অন্তর্নিহিত এই কাঠামো মানুষের সঙ্গে ডেটা ও অর্থকে অনলাইনে সংযুক্ত করে৷ শক্তিশালী ডিপিআই জনগণের জন্য প্রয়োজনীয় সেবা গ্রহণের সুযোগ দেয়। আনুষ্ঠানিক মাধ্যমে অর্থনৈতিক কাজে যুক্ত হওয়া ও মানুষের জীবন উন্নত করার মাধ্যমে একটি দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। অন্যদিকে খারাপভাবে ডিপিআই প্রয়োগ করলে বা অস্তিত্বহীন হলে দেশের উন্নয়ন ধীর হয়ে যেতে পারে। তখন অদক্ষতা ও বৈষম্য স্থায়ী হতে পারে।

একুশ শতকে ডিপিআই বাস্তবের অবকাঠামোর মতোই গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রমাণিত হচ্ছে। ডিজিটাল অবকাঠামোর প্রভাব বিশ্বজুড়ে যেখানে প্রয়োগ করা হয়, সেখানেই এর প্রভাব দেখা যায়। ভারতের কথাই ধরুন, যেখানে আমি এই বছরের শুরুতে গিয়েছিলাম। দেশটির ডিজিটাল পরিচিতি ব্যবস্থার নাম আধার কার্ড। এই সিস্টেম দেশটির প্রত্যেক নাগরিক কে, তা প্রমাণ করার সুযোগ দিচ্ছে। এই ব্যবস্থার ইউনিফায়েড পেমেন্ট ইন্টারফেস সুবিধার মাধ্যমে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে তাত্ক্ষণিক অর্থ আদান–প্রদানের সুবিধা আছে। একই সঙ্গে এই সুবিধা আর্থিক সেবা নেওয়ার সুযোগ প্রসারিত করেছে। এর মাধ্যমে প্রাপ্তবয়স্কদের ডিজিটাল ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা মাত্র ১০ বছরে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ৭৮ শতাংশে। নারীদের হিসাবের মালিকানা তিন গুণ বেড়েছে। ব্যাংক হিসাব মালিকানায় লিঙ্গ ব্যবধান সম্পূর্ণভাবে দূর করেছে। গত এক দশকে দেশটির মোবাইল নেটওয়ার্কের দ্রুত সম্প্রসারণের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন বেড়েছে।

অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশে কৃষি সবচেয়ে বড় শিল্প ও কাজের উৎস। ডিজিটাল উপায়ে কৃষি খাতও উপকৃত হচ্ছে। কেনিয়ায় একটি জাতীয় কৃষক রেজিস্ট্রি আছে, যেখানে ৬০ লাখ জিও-ট্যাগযুক্ত কৃষকের তথ্য আছে। এই রেজিস্ট্রি থেকে ফসল ও আবহাওয়াবিষয়ক সতর্কতার বার্তা সাপ্তাহিকভাবে পাঠানো হচ্ছে। রুয়ান্ডায় চা–শিল্পের শ্রমিকদের জন্য ডিজিটাল ব্যবস্থা আছে, যা চা–পাতা সরবরাহকারীদের মজুরি প্রাপ্তির সময় ১৫ দিন থেকে কমিয়ে তিন দিনে নামিয়ে এনেছে।

স্বাস্থ্য খাতে ডিপিআই সেবা প্রদান ও পেমেন্ট সিস্টেমে পরিবর্তন এনেছে। আইভরি কোস্ট ও মালিতে সাম্প্রতিক সময়ে পোলিও টিকাদান কর্মসূচিতে টিকাদানকারীর উপস্থিতি অনুসরণ করার জন্য ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। একই সঙ্গে ইনস্ট্যান্ট পেমেন্ট সিস্টেমের মাধ্যমে তাত্ক্ষণিক অর্থ প্রদান করা হয়। আগে মাস লেগে যেত কাগজভিত্তিক সিস্টেমের অর্থ প্রদান করতে। এখন ৯৯ শতাংশের বেশি টিকাদানকারীকে এক সপ্তাহের মধ্যে অর্থ প্রদান করা হচ্ছে। দক্ষতা ও নির্ভরযোগ্যতার কারণে প্রায় সব টিকাদানকারী এখন ডিজিটাল পেমেন্ট পছন্দ করেন। যদিও কেবল সময়মতো অর্থ প্রদানের বিষয়ে নয়, স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রতি আস্থা তৈরি করার বিষয়টি প্রকাশ করছে। এখন জীবন রক্ষাকারী টিকা প্রতিটি শিশুর কাছে দ্রুত পৌঁছানো যাচ্ছে।

যখন কোভিড–১৯ মহামারি আঘাত হানে, তখন আমরা দেখেছি যে ডিপিআই ভূমিকা পালন করতে পারে। ব্রাজিল দ্রুত একটি স্মার্টফোন অ্যাপ ও ওয়েবসাইট তৈরি করে, যা তাদের জাতীয় আইডি সিস্টেমের সঙ্গে যুক্ত। এই সিস্টেম জরুরি সহায়তা দিতে সাত কোটি মানুষকে যুক্ত করে, যাদের মধ্যে ৪০ শতাংশের আগে ব্যাংক হিসাব ছিল না। টোগোতে ১২ হাজার থেকে ১ লাখ ৮০ হাজার মানুষকে সামাজিক সহায়তা দিতে মাত্র ১০ দিনের মধ্যে শূন্য থেকে একটি অনুরূপ সিস্টেম তৈরি করা হয়।

তবে বৈপরীত্যও দেখতে পাই আমরা। অফলাইন ব্যবস্থা আছে, এমন দেশে সেবা দিতে অনেক কর্মীর প্রয়োজন হয়েছিল। অন্যদিকে যাদের শক্তিশালী ডিজিটাল ইকোসিস্টেম রয়েছে, তারা দ্রুত ও দক্ষতার সঙ্গে সহায়তা প্রদান করতে পারে। অনেক পরিবারের জন্য ডিপিআই দারিদ্র্য থেকে টেবিলে খাবার আনার মতো সুযোগ দেয়। ডিপিআই অবকাঠামো কেবল সংকটের সময়েই মূল্যবান নয়, দৈনন্দিন সরকারি সেবাকে বিস্তৃত করতে পারে ব্যাপকভাবে। এস্তোনিয়া ডিজিটাল গভর্ন্যান্সে অগ্রগামী একটি দেশ। ২০০১ সালে তার এক্স-রোড প্ল্যাটফর্ম চালু করে। আজ দেশটির ৯৯ শতাংশ নাগরিক সেবা ২৪ ঘণ্টা অনলাইনে মিলছে। কর দাখিল করতে সেখানে ৩ থেকে ৫ মিনিট সময় লাগে। আর কোনো ব্যবসা নিবন্ধন করতে সময় লাগে মাত্র ৩ ঘণ্টা। এর কারণ হলো, সঠিক বিনিয়োগের মাধ্যমে, বিভিন্ন দেশ পুরোনো ও অদক্ষ ব্যবস্থা এড়িয়ে চলতে ডিপিআই ব্যবহার করতে পারা। এই কাঠামো তাদের অগ্রগতিকে এক দশকের বেশি সময় এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।

জলবায়ু, প্রযুক্তি ও বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য কাজের জন্য আমি অনেক দেশের নেতাদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেয়েছি। ডিপিআই সম্পর্কে তাঁদের আগ্রহ পরিষ্কার। এর কারণ হলো, সঠিক বিনিয়োগের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশ পুরোনো ও অদক্ষ সিস্টেম বাইপাস করে দ্রুত অত্যাধুনিক ডিজিটাল সমাধান গ্রহণ করতে পারে। প্রচলিত উন্নয়নের ধারাকে উন্নত করতে ডিপিআই ব্যবহার করতে পারে। বিস্তৃত ব্যাংকিং সেবা নেই, এমন দেশে সরাসরি মোবাইল ব্যাংকিং শুরু করা যেতে পারে। এতে ন্যূনতম খরচে অনেক বেশি মানুষের কাছে পৌঁছানো যায়। একইভাবে ডিজিটাল আইডি সিস্টেম লক্ষাধিক নাগরিককে আইনি পরিচয় প্রদান করতে পারে। যাদের আগে অফিশিয়াল কাগজপত্রের অভাব ছিল, তাদের বিস্তৃত পরিসরের সেবা দেওয়া যাচ্ছে। একটি সিম কার্ড কেনা থেকে শুরু করে একটি ব্যাংক হিসাব খোলা পর্যন্ত পেনশনের মতো সামাজিক সুবিধা গ্রহণ করা সহজ হচ্ছে।

আমি ডিপিআই সম্পর্কে বেশ কিছু উদ্বেগের কথা শুনেছি। অনেকে চিন্তা করছেন, এমন ডিজিটাল ব্যবস্থা সরকারি নজরদারির একটি হাতিয়ার। আসলে সঠিকভাবে নকশা করা ডিপিআই নজরদারির অপব্যবহারের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেয়। এমনকি গোপনীয়তাও উন্নত করে। একটি ভালো ডিজিটাল আইডি ব্যবস্থার কথা বলা যায়। এটি নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্য কার কাছে প্রকাশ করা যাবে, তা পছন্দ করার সুযোগ দেয়। কার্যকর সিস্টেম কাউকে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য করে না। অনেক সুবিধার কারণে নাগরিকেরা বেছে নিতে পারছেন বিভিন্ন সেবা। এই সিস্টেম কাগজ হারিয়ে যাওয়া বা চুরি হতে পারে, এমন নথির অনুলিপির প্রয়োজনীয়তাও কমায় করে। এমনকি নিরীক্ষার কাজ করতে অননুমোদিত ব্যবহার হচ্ছে কি না, তা শনাক্ত করা ও প্রতিরোধ করতে সুযোগ দেয়। এই সিস্টেমের লক্ষ্য মানুষকে ক্ষমতায়ন করা, তাদেরকে সীমাবদ্ধ করা নয়।

অনেকেই ভয় করছেন ডিপিআই দুর্বল জনগোষ্ঠীকে বঞ্চিত করে। গ্রামীণ সম্প্রদায়, বয়স্ক বা কম ডিজিটাল জ্ঞানের মানুষদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করে বলে ভয় রয়েছে। যদি ডিপিআই সঠিকভাবে তৈরি করে, চিন্তাভাবনা করে বাস্তবায়ন করা হয়, তখন ডিপিআই প্রকৃতপক্ষে অনেককে অন্তর্ভুক্ত করে। ভারতে আগে ব্যাংক হিসাবহীন লাখ লাখ মানুষ ছিল, তারা এখন আর্থিক সেবা নিতে পারছে। যেখানে যাঁরা শারীরিকভাবে অক্ষম বা কোনো নির্দিষ্ট ঠিকানা নেই, তাঁরাও যুক্ত আছেন।

ইতিমধ্যে বিভিন্ন দেশ ডিপিআই তৈরি করতে ডিজিটাল পরিচয়ের জন্য এমওএসআইপি ও অর্থ প্রদানের জন্য মোজালুপের মতো ওপেন-সোর্স টুলস ব্যবহার করতে পারে। এটি স্থানীয়ভাবে প্রতিযোগিতা বাড়ায় ও উদ্ভাবনে অনুপ্রেরণা দেয়। সাধারণ একটি ডিজিটাল কাঠামো দিয়ে ছোট কোম্পানি ও স্টার্টআপ (নতুন উদ্ভাবনী উদ্যোগ) কোনো সিস্টেম তৈরি ছাড়াই সেবা দিতে পারে। এসব ডিজিটাল কাঠামো বিভিন্ন দেশকে নিজস্ব চাহিদা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য ক্ষমতায়িত করছে।

শিশুদের প্রতিরোধযোগ্য রোগ থেকে রক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাব্যবস্থা শক্তিশালী করা, কৃষকদের জীবন ও জীবিকা উন্নত করা ও তাদের আর্থিক ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রণে নারীদের ক্ষমতায়ন করা নিয়ে গেটস ফাউন্ডেশনে আমরা কাজ করছি। এসব কাজের অনেক অগ্রগতিতে ডিজিটাল পাবলিক অবকাঠামোর মূল চাবিকাঠি। এই কারণেই আমরা ডিপিআই নিয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা বিশ্বজুড়ে ডিপিআই উদ্যোগকে সমর্থন করার জন্য পাঁচ বছরে ২০ কোটি মার্কিন ডলারের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি।

বৈশ্বিক ঐকমত্য ও কার্যকর সমাধান থাকায় এখন এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার অনন্য সুযোগ রয়েছে। ভবিষ্যৎ ডিজিটাল। আসুন এমন একটি ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করি, যা সবার উপকারে আসে।