মাদ্রাসা থেকে সফল ফ্রিল্যান্সার মিনহাজ

মিনহাজ নিজে সফল হয়ে তথ্যপ্রযুক্তির প্রশিক্ষণ িদচ্ছেন কওমি মাদ্রাসার ছাত্রদের
ছবি: সংগৃহীত

শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার গজনীতে গত অক্টোবর মাসে স্থানীয় কয়েকজন ফ্রিল্যান্সারের সঙ্গে কথা হচ্ছিল এই প্রতিবেদকের। মিনহাজ উদ্দীন নামের এক তরুণ এগিয়ে এসে বললেন, ‘মনে আছে আমার কথা? ২০১৭ সালে আপনার সঙ্গে কথা হয়েছিল। ২০১৯ সালে আমার ফ্রিল্যান্সিং কাজ নিয়ে প্রথম আলোতে ছোট একটি খবর প্রকাশিত হয়েছিল। এরপর অনেকটা পথ পাড়ি দিয়েছি।’ 

কথা বলে দেখা গেল, মিনহাজ উদ্দীন অনেকটাই এগিয়ে গেছেন তাঁর পেশায়। মিনহাজ পড়াশোনা করেছেন কওমি মাদ্রাসায়। নিজে তথ্যপ্রযুক্তির ফ্রিল্যান্সার হিসেবে সফলতা পেয়েছেন। দাঁড়িয়েছেন অন্যদের পাশেও। প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘আইটি টাচ ইন কওমি মাদ্রাসা’ নামের প্রশিক্ষণকেন্দ্র। মিনহাজ জানান, এ পর্যন্ত মাদ্রাসার প্রায় ৭০০ ছাত্রকে বিনা মূল্যে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দিয়েছেন তিনি। মিনহাজ বলেন, ‘আমার জীবনের বড় পাওয়া—নিজের উপার্জনের অর্থ দিয়ে পবিত্র হজ পালন করে এসেছি।’ নিজে একটি মোটরবাইক কিনেছেন, যাতে বিভিন্ন মাদ্রাসায় গিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দিতে পারেন। 

শুরুর কথা

মিনহাজ উদ্দীনের বাড়ি জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলায়। ১৯৯৭ সালে জন্ম তাঁর, শৈশব কেটেছে শেরপুরে। পরিবার তাঁকে মাদ্রাসাশিক্ষায় শিক্ষিত করতে চায়। শেরপুরের জামিয়া সিদ্দিকীয়া মাদ্রাসায় (কওমি মাদ্রাসা) কোরআনে হাফেজ হন ২০১০ সালে। একই মাদ্রাসা থেকে ২০১৭ সালে দাওরায়ে হাদিসে (স্নাতকোত্তর স্বীকৃতিপ্রাপ্ত) উত্তীর্ণ হন। 

মাদ্রাসাশিক্ষার পাশাপাশি সাধারণ শিক্ষাতেও শিক্ষিত হয়েছেন মিনহাজ। শেরপুর সরকারি কলেজ থেকে ২০১৯ সালে ইসলামি শিক্ষায় স্নাতক (সম্মান) এবং ২০২১ সালে ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজ থেকে একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন মিনহাজ। 

২০১৭ সালে তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত হন মিনহাজ। একদিন খবর পেলেন, কলেজ প্রাঙ্গণে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তিভিত্তিক পেশা নিয়ে আয়োজন হবে। কিছু না বুঝেই নিবন্ধিত হলেন। সেই আয়োজনে সফল মানুষদের কথা শুনে মিনহাজ আগ্রহী হয়ে ওঠেন। 

মিনহাজ বলেন, ‘সেই আয়োজনে শুনলাম, এলআইসিটি নামে একটা প্রকল্প শুরু হবে। সেটিতে বিনা মূল্যে তথ্যপ্রযুক্তির নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেওয়া যাবে। কম্পিউটার সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা ছিল। লিখিত পরীক্ষা দিয়ে আমি “সফট স্কিল ও গ্রাফিকস” প্রশিক্ষণ কোর্সে ভর্তি হয়ে যাই।’

ভর্তি হওয়ার পর কঠিন এক সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল মিনহাজ উদ্দীনকে। কারণ, অসচ্ছল পরিবারের হাল অনেকটাই ধরতে হয়েছিল তাঁকে। ছাত্র পড়িয়ে আয় করতেন। কিন্তু প্রশিক্ষণ নিতে দিনের চার–পাঁচ ঘণ্টা চলে যেত। আয় না করলে সংসার চলবে কী করে? তারপরও মিনহাজ প্রশিক্ষণ নিতে থাকলেন। ধারদেনা করে চলতে থাকল তাঁদের সংসার।

চাকরির খবর

কোর্স শেষ হওয়ার আগে আগে ২০১৭ সালে একটি বেসরকারি সাহায্য সংস্থায় ২০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি পান মিনহাজ। চাকরিতে যোগ দেন। ওই বছরের শেষ দিকে ফ্রিল্যান্সিং শুরু করেন। কাজ ছিল ওয়েব ডেভেলপমেন্টের। শেরপুরে বসেই বিদেশি গ্রাহকদের কাজ পেতে থাকেন। মিনহাজ বলেন, ‘ফ্রিল্যান্সিং করে এখন আমার মাসে আয় হয় প্রায় দেড় হাজার মার্কিন ডলার। পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়ার একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরিও করি।’

মিনহাজের বাবা আবুল কাশেম একজন ভূমিহীন কৃষক। এখন এই পরিবারে সচ্ছলতা এসেছে মিনহাজের হাত ধরে। একমাত্র ছোট বোনকে পড়াচ্ছেন জামালপুরের আশেক মামুদ কলেজে। ওই বোনের বিয়ের খরচও দিয়েছেন মিনহাজ। পাশাপাশি জমি কিনেছেন, পুকুর কিনে মাছ চাষ করছেন। 

কওমি ছাত্রদের নিয়ে 

মিনহাজ উদ্দীন

‘কওমি মাদ্রাসার ছাত্র ছিলাম, জানি কষ্ট কেমন। মাদ্রাসার ছাত্ররা যেন মসজিদ–মাদ্রাসার ওপর নির্ভর না করে নিজেদের কর্মসংস্থান নিজেরাই করতে পারে, সেই উদ্যোগ নিচ্ছি। তাদের তথ্যপ্রযুক্তি প্রশিক্ষণ দিতে ২০১৯ সালে চালু করেছি “আইটি টাচ ইন কওমি মাদ্রাসা”। কওমি মাদ্রাসার ছাত্ররাও এখন দেশে বসে বিদেশের কাজ করতে পারছে।’

মিনহাজ উদ্দীনের প্রতিষ্ঠান থেকে কওমি মাদ্রাসার ৭০০ ছাত্র প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। বিভিন্ন স্থানে মাদ্রাসার ছাত্রদের নিয়ে সেমিনারও করেন তিনি। প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের ৩০ জন এখন ফ্রিল্যান্সিং করছেন। ৫০ জনের মতো ছাত্র হয়েছেন উদ্যোক্তা। কম্পিউটার বিক্রয়কেন্দ্র, ই-কমার্স সাইট পরিচালনা করছেন কেউ কেউ। ২০২১ সালে মানবসম্পদ উন্নয়ন ও বিভাগে শেরপুরের ‘জেলা প্রশাসক উদ্যোক্তা পুরস্কার’ পেয়েছেন মিনহাজ উদ্দিন।

এগিয়ে চলা

আইসিটি বিভাগ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছরে তিন লাখ টাকা অনুদান পেয়েছিলেন মিনহাজ উদ্দীন। সেই টাকায় পাঁচটি কম্পিউটার কিনেছেন। নিজে কিনেছেন আরও পাঁচটি। মোট ১০টি কম্পিউটার নিয়ে জামিয়া সিদ্দিকীয়া মাদ্রাসায় ল্যাব বানিয়েছেন তিনি। যেখানে ২৫ জন ছাত্র একসঙ্গে বসতে পারেন। মিনহাজ উদ্দীন বলেন, ‘সুযোগ পেলে সারা দেশে কওমি মাদ্রাসার ছাত্রদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাঁদের দক্ষ করে তুলতে চাই।’