গত এপ্রিলের কথা। প্রথম আলোয় ছাপা হলো, রাজশাহীর দুজন হতদরিদ্র কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। সেই আত্মহত্যার কারণ খুবই দুঃখজনক। নদীমাতৃক বাংলাদেশে দুজন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন সেচের পানির অভাবে!
একজন প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ওবায়দুর রহমান এই খবর পড়লেন। মর্মাহত হলেন। ওবায়েদের মনে হলো, ঘটনার পেছনের কারণ জানা দরকার। খোঁজখবর নিয়ে জানলেন, সঠিক বণ্টন না হওয়ায় সেচের পানির যথাযথ ভাগ পান না অনেক কৃষক। এতে তাঁদের ফসলের খেত নষ্ট হয় প্রতিবছর।
পেশায় ডেটাবিজ্ঞানী ওবায়েদ ভাবলেন, আচ্ছা, একটা আইওটি (ইন্টারনেট অব থিংস) যন্ত্র বানালে কেমন হয়? যা বিভিন্ন সেচযন্ত্র যুক্ত করবে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার সঙ্গে।
এতে যেই খেতে পানি সরবরাহ যথেষ্ট হয়েছে, সেখানে পানি সরবরাহ বন্ধ করে যেসব খেতে প্রয়োজন রয়েছে, সেখানে সরবরাহ নিশ্চিত করা যাবে। থাকবে না মানবসৃষ্ট কোনো কর্তৃত্ব কিংবা বৈষম্য।
যেই ভাবা সেই কাজ। ওবায়েদ তাঁর নতুন উদ্যোগ টেকগারলিক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। ছয় মাস গবেষণা করলেন। এই যন্ত্রের প্রথম পরীক্ষামূলক ব্যবহার হলো ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) মাধ্যমে। সফলতা পেয়ে তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর এই সমাধান ব্যবহৃত করে এখন আরও ৩৪টি পাম্পে (েসচযন্ত্র) কৃষকদের সেচ সমস্যার সমাধান করার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।
মোহাম্মদ ওবায়দুর রহমানের ডাকনাম পরাগ। জন্ম এবং বেড়ে ওঠা চট্টগ্রাম শহরে। বাবা মোহাম্মাদ ওয়াহিদুর রহমান ছিলেন বাংলাদেশ পুলিশ চট্টগ্রাম জোনের কর্মকর্তা। বাবা চট্টগ্রামে কর্মরত অবস্থায় এক অভিযানে সন্ত্রাসীদের হামলায় নিহত হন। বাবার মৃত্যুর পর সংসার সামলাতে হয় তাঁর মাকে। একটা সময়ে ওবায়েদ নিজেই তাঁর খেয়াল রাখতে শুরু করলেন।
সব সময়ই স্বনির্ভর হয়ে চলার একটা তাগিদ তাঁর মধ্যে কাজ করত। উচ্চমাধ্যমিকের পর থেকে ভাবলেন, নিজেই চালাবেন নিজের খরচ। বাড়ি থেকে টাকা নেওয়া বন্ধ করে দিলেন। ভাবতে লাগলেন, কী করা যায়। ধীরে ধীরে ফ্রিল্যান্সিংয়ের জগতের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। ফ্রিল্যান্সিং করে উপার্জিত টাকা দিয়েই নিজে চলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার খরচ জুগিয়েছেন। ঢাকার ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতক হয়ে ২০১০ সালে তিনি গ্রামীণফোনে যোগ দেন।
২০১২ সালে তিনি নিজ উদ্যোগে গ্রামীণফোনের ফেসবুক ব্যবহারকারীদের ডেটাবেজ বিশ্লেষণের মাধ্যমে গ্রাহকদের পছন্দ-অপছন্দ, সামাজিক মাধ্যমে তাঁদের আচরণ ইত্যাদি নির্ণয় করা শুরু করেন। এরই মধে৵ ওবায়েদ ডেটা বিশ্লষণের প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহী হয়ে ওঠেন। একসময় এই চাকরি ছেড়ে দিয়ে যোগ দেন ম্যাভেরিক স্টুডিওসে, ডেটা অ্যানালিস্ট হিসেবে। পরে ২০১৪ সালে রবি লিসেনিং সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন। এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে তিনি পর্যায়ক্রমে সোশ্যাল ট্রুপস এবং তাঁর সিগনেচার প্রোডাক্ট ডটকম তৈরি করেন।
টেকগারলিকের লক্ষ্য মূলত তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় মেশিন লার্নিংয়ের মাধ্যমে সুবিধাবঞ্চিত প্রান্তিক মানুষের সমস্যার সমাধান করা। চলতি বছরের শুরুতে যাত্রা করে এই স্টার্টআপ। এর উদ্দেশ্য খেটে খাওয়া মানুষ যাঁরা বিভিন্ন প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের সুবিধা পান না, তাঁদের সমস্যাগুলোর প্রযুক্তিভিত্তিক সমাধান দেওয়া।
কৃষকদের সেচ সমস্যার সমাধানের জন্য যে আইওটি যন্ত্র টেকগারলিক তৈরি করেছে, তাতে যে শুধু কৃষকের পানির সমস্যার সমাধান হবে তা নয়, এটি থেকে পাওয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে চাহিদা-জোগানের সমন্বয়, জরুরি সিদ্ধান্ত গ্রহণ, পানির যথাযথ বণ্টন করা যাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির সহায়তায় । কৃষক একটি স্মার্ট কার্ড ব্যবহার করে খুব সহজে তাঁর দরকারি পানি সরাসরি পাম্প থেকে নিয়ে নিতে পারবেন। পুরো প্রক্রিয়া একটি কেন্দ্রীয় ব্যবস্থার মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। কতজন কৃষক কতটুকু পানি পাচ্ছেন, কারা পাচ্ছেন আর কাদের দরকার— এ ধরনের তথ্য–উপাত্ত পাওয়া সম্ভব এই যন্ত্র থেকে।
সম্প্রতি টেকগারলিক ফেসবুকের অফিশিয়াল ডেটা পার্টনার হিসেবে মনোনীত হয়েছে। যে কোনো ডেটা ড্রাইভেন অর্গানাইজেশনের জন্য যা একটি অসাধারণ ব্যাপার।
স্বপ্ন কী জানতে চাইতেই হেসে উঠলেন ওবায়েদ। সুন্দর একটি দিনের অপেক্ষায় আছেন। যেদিন তিনি নিজের আবিষ্কার করা প্রযুক্তি দিয়ে হয়ে উঠবেন কৃষকের বন্ধু।