অ্যামেচার রেডিওর লাইসেন্স নিয়ে কথা হচ্ছিল মঞ্জুর (অ্যামেচার রেডিও কল সাইন: আলফা মাইক এস২১এএম) সঙ্গে। এর কদিন পরেই রাব্বি (রোমিও চার্লি এস২১আরসি) যখন ফোনে জানাল যে ২০২৪ সালেই বাংলাদেশে আইওটি (আইল্যান্ড অন দ্য এয়ার) অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। যখন জানলাম ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহেই এই আয়োজন হবে, তখন বেশি চিন্তাভাবনা না করেই সায় দিয়ে দিলাম আমি আসছি যুক্তরাষ্ট্র থেকে। বিপত্তি বাধল ডিসেম্বরে ডালাস টু ঢাকা বিমানভাড়া স্বাভাবিকের তুলনায় দ্বিগুণ।
অগত্যা অফিস থেকে কিছু অগ্রিম ছুটি নিয়ে গত ৩০ নভেম্বর টার্কিশ এয়ারলাইনসে রওনা দিয়ে দিলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে। সঙ্গে তিন স্যুটকেস ভরা তাঁবু, স্লিপিং ব্যাগ, সোলার প্যানেল ও রিমোট ক্যাম্পিংয়ের যাবতীয় জিনিসপত্র।
অ্যামেচার রেডিও একটি শখ, রেডিও ট্রান্সমিটার (বেতার তরঙ্গ প্রেরক যন্ত্র) দিয়ে দেশে ও বিদেশের অন্যান্য রেডিও অপারেটরদের সঙ্গে যোগাযোগ করাটাই মূল কাজ। কিন্তু একটা রেডিও ট্রান্সসিভার কিনে সুইচ অন করলেই যে অন্যান্য স্টেশন পাওয়া যাবে তার কোনো গ্যারান্টি নেই। আর সেটাই যদি হতো, তাহলে তো এই শখ বা হবির কোনো মজা থাকত না। এই হবিটা একটু বিজ্ঞানবিষয়ক। অনেকেই নিজের বানানো রেডিও স্টেশন ব্যবহার করে থাকেন। স্টেশন বলতে আমি শুধু রেডিও সেট বোঝাচ্ছি না, এটা হবে রেডিও ট্রান্সমিটার, অ্যানটেনা, প্রোপাগেশন, গ্রাউন্ড কন্ডিশন, ডিরেকশন ইত্যাদি খুঁটিনাটি অনেক বিষয় সমন্বয়ে করে যোগাযোগের চেষ্টা করা। আর এইচএফ (হাই ফ্রিকোয়েন্সি) রেডিও তরঙ্গ নির্ভর করে আয়নোস্ফেয়ার স্তর, সোলার অ্যাকটিভিটি ইত্যাদি অনেক কিছুর ওপর।
১৯৭৩ আমি পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময়ে প্রথম রেডিও রিসিভার বানাই। সেই সময়ে ব্যক্তিগত রেডিও স্টেশন থেকে কোনো কিছু প্রেরণ (ট্রান্সমিট) করা নিষিদ্ধ ছিল। সাইফুদ্দাহার শহীদের (এস২১এ) নেতৃত্বে বাংলাদেশ অ্যামেচার রেডিও লীগ (বিএআরএল) নিবন্ধিত হয়, মূলত সেই সংগঠন থেকেই আমরা অ্যামেচার রেডিও উন্মুক্তকরণের প্রচেষ্টা চালাতাম। যেহেতু বিদেশি কল সাইন থাকলে বাংলাদেশে সেই কল সাইনের বিপরীতে একটি লাইসেন্স প্রদানের নিয়ম চালু ছিল। তাই ১৯৯২ সালে ফাউন্ডেশন ফর অ্যামেচার ইন্টারন্যাশনাল রেডিও সার্ভিসেসের (এফএআইআরএস) সহযোগিতায়, মঞ্জু, ফেরদৌস, তৈমুরসহ অনেকে মিলে বাংলাদেশে বসেই এফসিসির (ফেডারেল কমিউনিকেশন কমিশন) গাইডলাইন অনুযায়ী প্রশিক্ষণ ও পরীক্ষার ব্যবস্থা করে এবং যুক্তরাষ্ট্রের কল সাইন প্রদান করে। আমিও সেই ধারায় এস২১আর কল সাইনটি পেয়ে থাকি।
এখন বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) প্রতিবছর অ্যামেচার রেডিওর পরীক্ষার ব্যবস্থা করে। যে কেউ এই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার পর কিছু শর্ত সাপেক্ষে লাইসেন্স পেতে পারেন।
আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়নের (আইটিইউ) গাইডলাইন অনুযায়ী প্রত্যেক অ্যামেচার রেডিও অপারেটরকে একটি করে কল সাইন দেওয়া হয়ে থাকে। আমার কল সাইন এস২১আর বা সিয়ারা টোয়েন্টি ওয়ান রোমিও। এখানে এস২১ হচ্ছে বাংলাদেশ। এটা সারা বিশ্বে স্বীকৃত। তাই রেডিওতে আমি যখন সিয়ারা টোয়েন্টি ওয়ান রোমিও বলে বার্তা প্রেরণ করি, পৃথিবীর সব দেশ থেকেই বুঝে যায় আমি কোথায় এবং কে—এমনকি মহাকাশে অবস্থানরত কোনো নভোচারীর সঙ্গেও যদি আমি কথা বলি, তিনিও বুঝতে পারেন আমি কোথা থেকে রেডিও চালাচ্ছি।
আইওটিএ হচ্ছে দ্বীপে বা আইল্যান্ডে বসে অ্যামেচার রেডিও চালানো। ২০০৯ সাল থেকে প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে আইওটিএ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এর জন্য বিটিআরসি একটি বিশেষ কল সাইন এ২১ডিএক্স প্রদান করেছে। যা বছরে কেবল সাত দিন সক্রিয় থাকে। তাই সারা বিশ্বের অন্যান্য অ্যামেচার রেডিও অপারেটররা এই কল সাইনের সঙ্গে কিউএসও (বেতার যোগাযোগে কিউ সংকেত ব্যবহার করে একজন অপারেটর আরেকজনের সঙ্গে নির্দিষ্ট সময়ে ন্যূনতম পরিচিতিমূলক বার্তা আদান–প্রদান করার পদ্ধতি) করার জন্য সারা বছর অপেক্ষা করে উদ্গ্রীব থাকে। ঠিক হয়েছে ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার ঢালচর ইউনিয়নের তারুয়া দ্বীপ থেকে এ বছরের রেডিওর ডিএক্সপেডিশন হবে। মানচিত্রে তারুয়া দ্বীপটির অবস্থান ভোলা জেলা থেকে অনেক নিচে বঙ্গোপসাগরে।
যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের ডালাস থেকে রওনা দিয়ে ২ ডিসেম্বর ঢাকায় পৌঁছায়। পরদিন রোমিও চার্লির বাসায় গিয়ে আরও কয়েকজন হ্যাম রেডিও অপারেটরের দেখা মেলে। সবাই অ্যানটেনা বানানো, ব্যান্ড পরিকল্পনা ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজে ব্যস্ত। গ্যারেজ থেকে শুরু করে পুরো বাড়ি ভরা অ্যানটেনা, হরেক রকমের ফিডার লাইন, জেনারেটর, ব্যাটারি, তাঁবু, লাইফ জ্যাকেট ও আরও যন্ত্রপাতি।
৯ ডিসেম্বর প্রায় এক টন যন্ত্রপাতি ছোট একটি ট্রাকে তুলে দেওয়া হয়, ট্রাকটি ভোলার কচ্ছপিয়া ঘাটে গিয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে। ১০ ডিসেম্বর মারুফ, রাকা, সাবির, রিপন, জুবায়ের, মঞ্জু, জাহিদ, রাব্বি, পারভেজসহ ১৫ জনের একটি দলের সঙ্গে ঢাকার সদরঘাট টার্মিনাল থেকে ভোলার বেতুয়া ঘাটের উদ্দেশে রওনা দিলাম। সেই কবে প্রায় ৪০ বছর আগে শেষবার স্টিমারে করে বরিশাল গিয়েছিলাম, পালতোলা নৌকা, জেলেদের সদ্য তোলা রুপালি ইলিশ ইত্যাদি পুরোনো স্মৃতি বারবার মনে পড়ছিল।
বেতুয়া ঘাটে চারটি মাইক্রোবাস প্রস্তুত ছিল, সেসবে চড়ে চরফ্যাশনে নাশতা করার পর কচ্ছপিয়া ঘাটে পৌঁছাতে সকাল ১০টা পেরিয়ে গেল। তড়িঘড়ি করে রিজার্ভড ট্রলারে ট্রাকের সব মালপত্র তোলা হলো। চালু হলো ট্রলার। খালের দুই পারে গ্রামবাংলার চিরন্তন সৌন্দর্য।
কিছুক্ষণের মধ্যেই খাল পার হয়ে সাগরের মোহনায় পড়লাম, চর কুকরিমুকরি পাশ কাটানোর পরে অথই পানি ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ছিল না। আবহাওয়া বেশ সুন্দর, মাঝি জানান, এ সময়ে সাগর শান্ত থাকে। জুবায়ের (এস২১বিকে) ড্রোন দিয়ে কিছু ছবি তুলল। আড়াই ঘণ্টা পর গন্তব্যে পৌঁছালাম। অনেক কসরত করে হাঁটুপানিতে নোঙর করা গেল ট্রলার। অপরূপ সৌন্দর্য, চিকচিক বালিতে ঢেউ আছড়ে পড়ছে, দূরে কিছু গাছ, যত দূর দেখা যায় সৈকতের রেখাজুড়ে সাগর ঢেউয়ের ফেনা, কাঁকড়ার ছোটাছুটি, জনমানুষের চিহ্নমাত্র নেই, দুটো ছোট্ট জেলেনৌকা বালিতে আটকে আছে—হয়তোবা জোয়ারের অপেক্ষায়।
নোনাপানির সীমানা থেকে ৫০০–৬০০ ফুট দূরেই বন শুরু, ঝাঁক বেঁধে কিছু বক উড়ে গেল। পরবর্তী ১২ দিন আমাদের ঠিকানা এই দ্বীপ। সিয়ারা টোয়েন্টি ওয়ান ডি এক্স (এস২১ডিএক্স) বেতার তরঙ্গে ভেসে বেড়াব, সারা বিশ্বের রেডিও অপারেটরদের অ্যানটেনাগুলো এই দ্বীপের দিকে তাক করে থাকবে আমাদের সঙ্গে ছোট্ট একটি যোগাযোগ করার জন্য। অতুলনীয় অনুভূতি।
ঠিক হলো , যে পর্যন্ত জোয়ারের পানির দাগ দেখা যায়, তার পাশ ঘিরেই মূল তাঁবুগুলো খাটানো হবে। কেননা অ্যানটেনার রেডিয়াল পানির যত কাছাকাছি রাখা যায়, বেতার সংকেত তত ভালো প্রতিফলিত হবে। কিন্তু পানিতে যেন ডুবে না যায়, সেটাও লক্ষ রাখতে হবে। রেড ক্রিসেন্টের সৌজন্যে তিনটা বড় তাঁবু পাওয়া গিয়েছিল সেগুলোর মধ্যে স্টেশনগুলো থাকবে, আর আমাদের ব্যক্তিগত তাঁবুগুলো একটু পাশে গুচ্ছের মতো থাকবে, কাছাকাছি থাকাই ভালো, শিয়াল বাহিনীর হুক্কা হুয়া ডাক শুনে ভয় না পেলেও জলদস্যুর ভয় আছে।
আমাদের এই হবিতে রেডিও ট্রান্সমিটারের (প্রেরক যন্ত্র) যত না ভূমিকা, অ্যানটেনার ভূমিকা তার চেয়ে বেশি। রেডিও থেকে ১০০ ওয়াট বের হলেও ফিডার লাইন লসের কথা মাথায় রাখতে হবে এবং অ্যানটেনা যদি শতভাগ না মেলে, তবে আলটিমেট আউটপুট রেডিয়েশন ১০০ ওয়াট থাকবে না, সবকিছু সেটিং করে পূর্ণ শক্তি দিলেও যদি ট্রান্সমিশনের লস থাকে তাবে সেই ক্ষতি পূরণ করার উপায় নেই।
আমাদের লাইসেন্সে এইচএফ (হাই ফ্রিকোয়েন্সি), ভিএইচএফ (ভেরি হাই ফ্রিকোয়েন্সি), ইউএইচএফ (আল্ট্রা হাই ফ্রিকোয়েন্সি), মাইক্রোওয়েব ইত্যাদি বিভিন্ন ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহারের অনুমোদন রয়েছে। তবে এখানে আমরা মূলত এইচএফ ট্রান্সমিট করব, ১০/১২/১৫/১৭/২০/৩০/৪০/৮০ এমনকি ১৬০ মিটারও থাকছে।
১৬০ মিটারে পূর্ণ তরঙ্গ বা ফুল ওয়েভ লেন্থে যদি একটি অ্যানটেনা বানানো হয়, তবে তার একটি উপকরণ হবে ১৬০ মিটার কিংবা ৫২৫ ফুট, আর রিফ্লেক্টরগুলো সেই পরিমাণ লম্বা। একটা ১৬০ মিটারের অ্যানটেনা খাড়া করতে ৫২৫ ফুটের অখণ্ড লম্বা একটি উপকরণ অর্থাৎ তার থাকতে হবে। আর মাল্টিপল রিফ্লেক্টর থাকতে হবে, বুঝতেই পারছেন একটি অ্যানটেনা বানাতে কতখানি তার এবং খাড়া রাখার জন্য কী পরিমাণ কাঠখড় পোড়াতে হবে।
প্রতিটি ফ্রিকোয়েন্সির জন্য একাধিক অ্যানটেনা রাখা হচ্ছে। আর একটি ফ্রিকোয়েন্সিতে যখন ট্রান্সমিট হবে, তখন পাশের রেডিও যেন বার্তা গ্রহণে (রিসিভিং) ব্যতিচারে (ইন্টারফেরেন্স) না পড়ে এবং ওভারলোড না হয়ে যায়, তার জন্য প্রতিটি অ্যানটেনার শেষ প্রান্তে ব্যান্ডপাস ফিল্টার থাকছে।
হরাইজন্টাল বিম অ্যান্টেনা থাকছে দুটি। আর বাকিগুলো খাড়া (ভার্টিক্যাল)। মনে রাখতে হবে এইচএফ রেডিও ফ্রিকোয়েন্সিগুলো আয়নোস্ফেয়ারে প্রতিফলিত হয়ে আবার পৃথিবীতে ফিরে আসে, তাই আমরা যখন বেতারসংকেত পাঠাই (ট্রান্সমিট করি), তখন বেতার তরঙ্গ প্রথমে আয়নোস্ফিয়ার যাবে, তারপর প্রতিফলিত হয়ে আবার পৃথিবী তলে এসে পড়বে, সেখান থেকে আবার প্রতিফলিত হয়ে আরও দূরে আয়নোস্ফিয়ারে যাবে, তারপর আবার পৃথিবী তলে এসে পড়বে। এভাবেই আমরা যদি একটি হ্যালো শব্দ ট্রান্সমিট করি, সেটি পৃথিবীর এই প্রান্ত থেকে ওই প্রান্তে ঘুরতে থাকবে, এমনকি সেই শব্দটি আলোর গতিতে একবার পুরো পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে দ্বিতীয় বা তৃতীয়বারও প্রদক্ষিণ করতে পারে। দেখা গেছে, নিজের পাঠানো হ্যালো শব্দটি পুরো পৃথিবী ঘুরে আবার নিজের রেডিও স্টেশনে ফেরত আসে, তখন টাইম ডিলের কারণে কিঞ্চিৎ প্রতিধ্বনি (ইকো) হয়।
আমরা বেতার সংকেত যখন উত্তর আমেরিকার দিকে পাঠাব, সেটা উত্তরমুখী কিংবা দক্ষিণমুখীও হতে পারে, সাধারণ ভাষায় আমরা শর্ট পাথ কিংবা লং পাথ বলে থাকি। আমেরিকা, ইউরোপ কিংবা এন্টার্কটিকার একটি স্টেশন আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ চাইলে ওদের অ্যানটেনাগুলো আমাদের দিকে থাকলে সবচেয়ে বেশি সংকেত পাবে।
খাড়া বা উল্লম্ব অ্যানটেনা থেকে যে বেতার সংকেত বের হয়, সেটা অনেকটা কম কোণে (১৫ ডিগ্রি) বিকিরিত হয়, তাই অনেক দূরের স্টেশনগুলো আমাদের সংকেত ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারবে। জেনে রাখা ভালো, আশপাশের মানুষের আওয়াজ ভার্টিক্যালি বেশি উৎপন্ন হয়, সেই জন্য ঢাকা শহর থেকে ভার্টিক্যাল অ্যানটেনাতে আমরা নয়েজ ছাড়া আর কিছুই গ্রহণ করতে পারি না। তাই তো বৈদ্যুতিক নয়েজ ফ্রি জায়গায় এই তারুয়া দ্বীপে এসেছি, এটা বেতার সংকেতের জন্য নয়েজ ছাড়া উত্তম একটি জায়গা। আর সৌন্দর্যটা বোনাস।
রেডিও ছাড়া আমরা বানাচ্ছি মোট ১১টি এইচএফ অ্যানটেনা। এ ছাড়া থাকছে একটি কৃত্রিম উপগ্রহনির্ভর (স্যাটেলাইট) যোগাযোগব্যবস্থা, যেটা ১৩ সেন্টিমিটারের তরঙ্গ প্রেরণ ও গ্রহণ করতে সক্ষম। এর বাইরেও থাকছে একটি ফোর স্কয়ার ভার্টিক্যাল অ্যারে অ্যানটেনা সিস্টেম। এটা বেশ জটিল কিন্তু উত্তর–দক্ষিণ ও পূর্ব–পশ্চিমে সুইচ টিপেই দিক পরিবর্তন করা যায়। বিদ্যুৎ–চৌম্বকীয় তরঙ্গের (ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ) বৈদ্যুতিক অংশের ফেস শিফটকে কাজে লাগিয়ে এই অ্যান্টেনা কাজ করে।
অ্যামেচার রেডিও কিংবা হ্যাম রেডিও অপারেটররা মূলত কার কী রকম রেডিও স্টেশন কিংবা কে কী রকম অ্যানটেনা বানালেন কিংবা আর্থ ও আবহাওয়ার অবস্থা এবং অন্যান্য বৈজ্ঞানিক কথাবার্তা রেডিওতে বলে থাকেন। কোনো প্রকার ধর্মীয়, রাজনৈতিক বা আর্থিক তথ্য প্রেরণ করা নিষিদ্ধ। এসব শর্ত ভাঙলে লাইসেন্স বাতিল হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
যোগাযোগগুলো সোজাসাপটা কথার মাধ্যমে হতে পারে কিংবা ডিজিটাল মোডে হতে পারে কিংবা মোর্স কোডেও হতে পারে। আমরা কথা ছাড়া স্লো স্ক্যান মোডে ছবি কিংবা সরাসরি (লাইভ) ভিডিও ট্রান্সমিট করতে পারি। বেশ কিছু শৌখিন স্যাটেলাইট আছে, সেগুলোর মাধ্যমে অন্যান্য হ্যাম রেডিও অপারেটরদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি। এমনকি মহাকাশে থাকা আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের নভোচারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়।
সবাই মিলে প্রচণ্ড পরিশ্রম করার পর দুই দিনেই মোটামুটি মূল স্টেশনগুলো দাঁড়িয়ে গেল। আন্তর্জাতিকভাবে আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের এই স্টেশনগুলো ১৩ ডিসেম্বর রাত ১২টা থেকে চালু হওয়ার ঘোষণা দেওয়া আছে, আমরাও সেভাবেই প্রস্তুত। আশির দশকে আমরা ছিলাম হাতে গোনা—১০ জনেরও কম। কিন্তু বাংলাদেশে এখন এর প্রসার ঘটছে এবং বহু অপারেটর লাইসেন্সপ্রাপ্ত। সত্যিই ভালো লাগছে ওদের উৎসাহ, একাগ্রতা এবং বেতার প্রযুক্তির গভীরে প্রবেশ করে এর উৎকর্ষ বৃদ্ধি করা দেখে।
আরেকটা কথা, রেডিও হবিটা যদিও আমাদের একান্তই ব্যক্তিগত কিন্তু কোনো দুর্যোগে যখন অন্য সব যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়ে, তখন কেবল আমরাই আমাদের নিজস্ব রেডিও স্টেশন দিয়ে সারা দেশে ও বিদেশে যোগাযোগ রক্ষা করার জন্য স্বেচ্ছাসেবী হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ি।
চতুর্থ দিনে একটু ঝামেলা হয়ে গেল, পূর্ণ চন্দ্র থাকায় জোয়ারের পানি অনেক ওপরে উঠে এসেছে। সেই পানি কিছু অ্যানটেনার রিফ্লেক্টর ডুবিয়ে দিল। তাই কয়েকটি তাঁবু ও অ্যানটেনা অন্য জায়গায় স্থাপন করতে হলো। চাঁদের সঙ্গে জোয়ার–ভাটার এই হিসাবটা আমাদের আগে করা হয়নি। এবারের এই রেডিও ক্যাম্পিংয়ে অভিজ্ঞতাটা যোগ হয়ে গেল। বিটিআরিসিকে ধন্যবাদ, তারা এই কারিগরি শখের গুরুত্ব দিচ্ছে এবং এই আইওটিএ আয়োজনের বিশেষ কল সাইন ও অনুমতি দিয়ে বাংলাদেশের অ্যামেচার রেডিও হবিস্টদের সর্বাত্মক সাহায্য করায়।
সেই ছেলেবেলার রেডিও শোনার সামান্য একটি শখ থেকে কত কাঠখড় পুড়িয়ে আজ নিজের দেশের সাগরের সীমারেখায় বঙ্গোপসাগরের মধ্যে অসামান্য সৌন্দর্যের বিচ্ছিন্ন দ্বীপ থেকে একটি দলের সঙ্গে রেডিও চালানোর অভিজ্ঞতা ভাষায় বর্ণনাতীত। ভরা জ্যোৎস্নায় চিকচিক সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ছে, অদূরেই কটি জেলেনৌকা ইলিশের সন্ধানে জাল পেতে বসে আছে। রেডিওতে হবিস্টরা ডেকে যাচ্ছে ‘সিকিউ ডিএক্স, সিকিউ ডিএক্স, সিকিউ ডিএক্স...দিস ইজ সিয়েরা টোয়েন্টি ওয়ান ডিক্স...’। দূরে নীহারিকামণ্ডল থেকে কোনো এলিয়েন কী আমাদের বেতার সংকেত গ্রহণ করছিল?
মুনীম রানা: যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী পদার্থবিদ ও অ্যামেচার রেডিও অপারেটর