বাবার সামর্থ্য ছিল না কম্পিউটার কিনে দেওয়ার। এমনকি নিজের গ্রামেও ইন্টারনেট সংযোগ নেই। তবু থেমে থাকেননি মো. রাসেল। পরিবারের প্রয়োজনেই ১৯ বছর বয়সী রাসেলকে ভাবতে হয়েছে আয়রোজগারের কথা। আর এ জন্য বেছে নিয়েছেন তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ফ্রিল্যান্স আউটসোর্সিং। প্রত্যন্ত গ্রামে বসে নিজেকে তৈরি করেছেন, সীমিত সুবিধার ইন্টারনেট ব্যবহার করে অনলাইনে কাজ করেছেন। মো. রাসেল ফ্রিল্যান্সিং করে এখন মাসে আয় করেন দুই হাজার মার্কিন ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় দুই লাখ টাকার বেশি।
শেরপুর জেলার নকলা উপজেলার নদীর তীরের গ্রাম চরমধুয়া (হাতিমারা)। এই গ্রামে বসেই মুক্ত পেশাজীবী বা ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করেন মো. রাসেল। দুই গ্রাম দূরে ইন্টারনেট থাকলেও তাঁদের গ্রামে নেই। তারপরও সেই বাধা দূর করেছেন নিজের আগ্রহে।
রাসেলের বাবা মো. রফিজ উদ্দিন একজন কৃষক। নিজের ও অন্যের জমিতে কাজ করতেন। কষ্টে চলত তাঁদের সংসার। রাসেলকেও পড়াশোনার পাশাপাশি বাবার সঙ্গে কৃষিকাজ করতে হতো। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় রাসেল। দারিদ্র্যের কারণে ১৭ বছর বয়সেই রোজগার করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ভাবনা আসে তাঁর মাথায়।
গতকাল রোববার প্রথম আলোকে মুঠোফোনে রাসেল বলেন, ‘২০১৫ সালে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময়ে আইসিটির পাঠ্যবইয়ে আর ইন্টারনেট থেকে আউটসোর্সিং বিষয় সম্পর্কে জানতে পারি। এরপর এটি সম্পর্কে আরও জানার চেষ্টা করি। জেনেবুঝে সিদ্ধান্ত নিই তথ্যপ্রযুক্তির কোনো বিষয়ে কাজ শিখে দক্ষ হব, তারপর ফ্রিল্যান্সিং করব। পরিবারের অভাব দূর করার ইচ্ছা ছিল আমার। নিজের কাছেই শপথ করি, কোনোভাবে হার মানা যাবে না।’ এভাবে স্কুলজীবন কেটে গেল। ২০২০ সালে এসএসসি পাস করার পর রাসেল নিজের মতো করে শুরু করলেন।
নিজের জমানো কিছু টাকা ছিল রাসেলের হাতে। এক বড় ভাইয়ের কাছ থেকে ধার নেন আরও কিছু টাকা। ১৭ হাজার টাকা দিয়ে একটি পুরোনো কম্পিউটার কিনে চর্চা শুরু করেন রাসেল।
কম্পিউটার কেনার পর স্থানীয় মানুষেরা রাসেলের বাবাকে বলতে শুরু করলেন, ‘ছেলে (রাসেল) নষ্ট হয়ে যাবে, এটা বিক্রি করে দেন।’ বাবা বাড়িতে এসে রাসেলকে বলেছিলেন, ‘কম্পিউটার কিনেছ ভালো কথা কিন্তু এর ঋণ আমি শোধ করতে পারব না।’ রাসেল তখন বাবাকে বলেছিলেন, ‘কাউকে ঋণ শোধ করতে হবে না, নিজেই এটা শোধ করব।’
রাসেল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার তখন পরিস্থিতি এমন ছিল, কেউ আমাকে বিশ্বাস করতে পারছিল না যে আমি আয় করতে পারব কিংবা অনলাইনেও টাকা আয় করা যায়।’ সেই সময়ে রাসেল একা হয়ে পড়েন। তবে যে বড় ভাই টাকা ধার দিয়েছিলেন, তিনি বলেছিলেন চেষ্টা করে যেতে।
কম্পিউটার তো আছে রাসেলের। এবার কাজ শেখার পালা। ইউটিউবে বিভিন্ন ভিডিও থেকে একা একা সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিংয়ের কাজ শিখতে থাকেন। ২০২১ সালে অনলাইনে ফ্রিল্যান্স আউটসোর্সিংয়ের কাজ দেওয়া-নেওয়ার ওয়েবসাইট (মার্কেটপ্লেস) ফাইভআরে অ্যাকাউন্ট খোলেন। তখন রাসেল নকলার চন্দ্রকোনা কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র। ২০২২ সালে এইচএসসি পাস করেন।
ফাইভআরে অ্যাকাউন্ট খোলার তিন দিনের মধ্যে পাঁচ ডলারের কাজ পান মো. রাসেল। ঠিকঠাক শেষ করে প্রথম কাজে গ্রাহকের কাছ থেকে পান পাঁচ তারকা (ফাইভস্টার) রিভিউ। প্রথম মাসে আরও কাজ করেন, ১৮০ ডলারের মতো আয় হয়। রাসেল বলেন, ‘আমার লক্ষ্য ছিল আয় করতেই হবে। টাকা তুলে ঋণের টাকা পরিশোধ করলাম এবং বাড়িতে মিষ্টি নিয়ে গেলাম। আমার পরিবার খুব খুশি হলো আমার চেষ্টায়।’
সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটং দিয়ে শুরু করলেও পরবর্তী সময়ে স্কিলআপার নামের একটি অনলাইনভিত্তিক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান থেকে ওয়েব অ্যানালাইটিকস অ্যান্ড পেইড মার্কেটিং বিষয় শেখেন রাসেল। রাসেল বলেন, ‘যেকোনো বিষয় বা সফটওয়্যারের ওপর দক্ষতা অর্জন করে অনলাইনে আয় করা সম্ভব। যেমন ডিজিটাল বিপণন, ওয়েবসাইট ডিজাইন, অ্যাপ তৈরি, এথিক্যাল হ্যাকিং, ওয়েবসাইট তৈরি ইত্যাদি। আসল বিষয়ই হলো দক্ষতা। দক্ষ কর্মীর চাহিদা সব সময় থাকে।’ নতুনদের জন্য রাসেলের পরামর্শ, ‘এই কাজ করার জন্য প্রয়োজন অনেক ধৈর্য ও আগ্রহ। নিরাশ হওয়া যাবে না। রবার্ট ব্রুস যেমন সাতবারের চেষ্টায় রাজ্য জয় করেছিলেন, আপনাকেও তেমন করতে হবে। সেটা সাতবার না হয়ে ৭০ বারও হতে পারে।’
রাসেল মনে করেন, ব্যক্তিগতভাবে অনেক কিছু করা সম্ভব ফ্রিল্যান্সিংয়ে। রাসেলের সহযোগিতায় তাঁর এলাকার অনেকেই এখন এসেছেন ফ্রিল্যান্সিংয়ে। তিনি বলেন, একদিন বাংলাদেশের তরুণেরা হবেন তথ্যপ্রযুক্তি বা ফ্রিল্যান্সিংয়ে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের বড় উৎস। তবে এ জন্য তাঁদের সঠিক প্রশিক্ষণ ও পরিচর্যা করতে হবে।
ফ্রিল্যান্সিং যেমন করছেন, তেমনি পড়াশোনাও চালিয়ে যাচ্ছেন মো. রাসেল। এখন তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে শেরপুরের ডা. সেকান্দার আলী কলেজে বাংলায় স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষে পড়ছেন।