স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে বক্তৃতা দিচ্ছেন স্টিভ জবস। ২০০৫
স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে বক্তৃতা দিচ্ছেন স্টিভ জবস। ২০০৫

স্মরণীয় বক্তৃতা

স্টিভ জবসের জীবনের ৩ বিচ্ছেদের গল্প শুনুন

অ্যাপল কম্পিউটারের সহপ্রতিষ্ঠাতা ছিলেন স্টিভ জবস। ২০০৫ সালের ১২ জুন যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন বক্তা হিসেবে তিনি বক্তৃতা করেন। সেই বক্তব্যে স্টিভ জবস নিজের জীবনের তিনটি বিচ্ছেদের গল্প তুলে ধরেন সবার সামনে। আজও সেই বক্তৃতা তরুণদের অনুপ্রেরণা জোগায়। জীবনের তিনটি গল্পে কী ছিল, তা জেনে নেওয়া যাক স্টিভ জবসের সেই সমাবর্তন বক্তৃতা থেকে।

কলেজ পাস করতে পারিনি

বিশ্বের সেরা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের (স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়) সমাবর্তনে তোমাদের সঙ্গে থাকতে পেরে আমি সম্মানিত বোধ করছি। আমি কখনোই কলেজ পাস করতে পারিনি। সত্যি বলতে, আজই প্রথম আমি কলেজ গ্র্যাজুয়েশনকে এত কাছ থেকে দেখছি। তোমাদের আমার জীবনের তিনটি গল্প বলতে চাই। আর কিছু বলব না, মাত্র তিনটি গল্প শোনাব।

আমার বায়োলজিক্যাল বা গর্ভধারিণী মা ছিলেন অল্পবয়সী অবিবাহিত একজন কলেজ স্নাতক শিক্ষার্থী। তিনি আমাকে দত্তক দেওয়ার জন্য সিদ্ধান্ত নেন।

প্রথম গল্প: জীবনে কলেজের কোনো গুরুত্ব খুঁজে পাইনি

প্রথম গল্পটি বিন্দুর (ডটস) সংযোগ নিয়ে। রিড কলেজে ভর্তি হওয়ার পরে আমি ছয় মাস পরেই ড্রপ–আউট হই। এরপর আমি সত্যিকারের চলে যাওয়ার আগে ১৮ মাস বা তারও বেশি সময় ধরে ড্রপ-ইন অবস্থায় থাকি। আমি কেন বাদ দিলাম?
আমার জন্মের আগেই আসলে বাদ পড়ার ঘটনা ঘটে। আমার বায়োলজিক্যাল বা গর্ভধারিণী মা ছিলেন অল্পবয়সী অবিবাহিত একজন কলেজ স্নাতক শিক্ষার্থী। তিনি আমাকে দত্তক দেওয়ার জন্য সিদ্ধান্ত নেন তিনি খুব দৃঢ়ভাবে অনুভব করেন যে আমাকে কলেজের স্নাতক কেউ যেন দত্তক নেন।

একজন আইনজীবী ও তাঁর স্ত্রী জন্মের পরে আমাকে দত্তক নেওয়ার কথা ছিল। সেই দম্পতি শেষ মুহূর্তে একটি মেয়ে চান বলে আমাকে বাদ দেন। আমার এখনকার মা–বাবা তখন দত্তক নেওয়ার অপেক্ষমাণ তালিকায় ছিলেন। মাঝরাতে তাঁরা ফোনে জানতে পারেন, একটি অপ্রত্যাশিত শিশু আছে; তোমরা নিতে চাও কি না? তখন মা–বাবা আমাকে দত্তক নেওয়ার কথা জানান। আমার আপন মা পরে জানতে পেরেছিলেন যে আমার মা কখনো কলেজ স্নাতক হননি। আর আমার বাবা কখনো উচ্চবিদ্যালয় শেষ করেননি। আমার আসল মা চূড়ান্ত সময়ে দত্তক দেওয়ার কাগজপত্রে সই করতে অস্বীকৃতি জানান।

আমি বিশ্বাস করতাম, সব ঠিক হয়ে যাবে। সেই সময়ে এই সিদ্ধান্ত বেশ ভীতিকর ছিল। এখন পেছনে ফিরে তাকালে দেখি, তা ছিল আমার নেওয়া সেরা সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে একটি।

কয়েক মাস পরে আমার মা–বাবা একটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। আমাকে কলেজে পড়াবেন। এরপর আমার আসল মা তাঁদের কাছে আমাকে দত্তক দিতে রাজি হন। ১৭ বছর পরে আমি কলেজে গিয়েছিলাম। আমি নির্বোধের মতো একটি কলেজ বেছে নিয়েছিলাম। সেই কলেজ স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোই ব্যয়বহুল ছিল। আমার শ্রমজীবী মা–বাবার সব সঞ্চয় আমার কলেজের টিউশন ফিতে ব্যয় করা হয়। ভর্তির ছয় মাস পরে কলেজের কোনো গুরুত্ব খুঁজে পাইনি।

আমার জীবন নিয়ে কী করতে চাই তখন আমার কোনো ধারণা ছিল না। কলেজ কীভাবে আমাকে জীবন খুঁজে বের করতে সাহায্য করবে তা আমি জানতাম না। কলেজে মা–বাবা আমার জন্য তাঁদের সারা জীবনের অর্জিত সব অর্থ ব্যয় করতে শুরু করেন। এসব কারণে আমি ড্রপ–আউট হওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।

আমি বিশ্বাস করতাম, সব ঠিক হয়ে যাবে। সেই সময়ে এই সিদ্ধান্ত বেশ ভীতিকর ছিল। এখন পেছনে ফিরে তাকালে দেখি, তা ছিল আমার নেওয়া সেরা সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে একটি। যে মুহূর্তে আমি ড্রপ–আউট হলাম, তখন আমি অপ্রয়োজনীয় ক্লাসে যাওয়া বন্ধ করে দিই। আমার কাছে যা আগ্রহের ছিল সেই ক্লাসগুলো আমি শুরু করি। সময়টা আসলে তেমন রোমান্টিক ছিল না। ছাত্রাবাসে আমার কোনো কক্ষ (ডর্ম রুম) ছিল না। আমি বন্ধুদের ঘরের মেঝেতে ঘুমাতাম। খাবার কেনার জন্য পাঁচ সেন্ট (১০০ সেন্টে ১ ডলার) দিয়ে কেনা কোকের বোতল ফেরত দিয়েছিলাম। আমি প্রতি রোববার রাতে শহরের মধ্যে সাত মাইল হেঁটে হরে কৃষ্ণ মন্দির থেকে সাপ্তাহিক খাবার খেতে যেতাম।
আমার কৌতূহল ও অন্তর্দৃষ্টি অনুসরণ করে আমি এগিয়ে এসেছি। আমি যতবার হোঁচট খেয়েছি, সবই আসলে অমূল্য আমার কাছে। তোমাদের একটি ঘটনা বলি। সেই সময়ে রিড কলেজে সম্ভবত দেশের সেরা ক্যালিগ্রাফি নকশা নিয়ে পড়ার সুযোগ ছিল।

ক্যাম্পাসজুড়ে বিভিন্ন পোস্টার থেকে শুরু করে প্রতিটি ড্রয়ারের বিভিন্ন লেবেল সুন্দরভাবে হাতে এঁকে ক্যালিগ্রাফ করা হয়েছিল। আমি পড়াশোনা বাদ দিয়েছিলাম বলে সব ক্লাসে যেতাম না। আমি কীভাবে ক্যালিগ্রাফি করতে হয় তা শিখতে ক্লাস করা শুরু করি। আমি শেরিফ ও স্যান শেরিফ টাইপফেস সম্পর্কে শিখেছিলাম। বিভিন্ন অক্ষরের মধ্যে সম্পর্কের বিষয়ে জেনেছিলাম। কী উপায়ে টাইপোগ্রাফিকে দুর্দান্ত করে তোলা যায় তা শিখেছিলাম। ক্যালিগ্রাফি সুন্দর ও ঐতিহাসিক ধাঁধাযুক্ত। শৈল্পিক উপায়ে সূক্ষ্মভাবে আঁকার কৌশল সহজে বিজ্ঞান অনুসরণ করতে পারে না। আমার কাছে বেশ আকর্ষণীয় বলে মনে হয়েছিল বিষয়টি।

কিছু বিষয়ে বিশ্বাস রাখতে হবে। এসব হচ্ছে আপনার অন্তর্দৃষ্টি, ভাগ্য, জীবন, কর্ম যা–ই বলুন না কেন। এ বিষয়টি আমাকে কখনোই হতাশ করেনি। এই ভাবনা আমার জীবনে বড় পার্থক্য তৈরি করেছে।

বাস্তবে আমার জীবনে এসবের কোনো কিছু কাজে লাগবে বলে ধারণা ছিল না। ১০ বছর পরে যখন আমরা প্রথম ম্যাকিনটোশ কম্পিউটার ডিজাইন করছিলাম, তখন আমি সব কাজে লাগাই। আমরা ম্যাকের সব ডিজাইন করি। ম্যাক ছিল সুন্দর টাইপোগ্রাফিসহ প্রথম কম্পিউটার। আমি যদি কলেজে সেই কোর্সে না পড়তাম, তাহলে ম্যাকের একাধিক টাইপফেস বা সুদৃশ্য ফন্ট থাকত না। তখন উইন্ডোজ সবে ম্যাককে নকল করা শুরু করে। সব পারসোনাল কম্পিউটারে হয়তো ফন্ট থাকত না। আমি যদি কখনোই ড্রপ–আউট না হতাম, আমি কখনোই ক্যালিগ্রাফি ক্লাসে যেতাম না।

তখন পারসোনাল কম্পিউটারে চমৎকার টাইপোগ্রাফি হয়তো থাকত না। আমি যখন কলেজে ছিলাম, তখন অবশ্যই সামনের দিকে তাকিয়ে এসব ঘটনার বিন্দু (ডট) সংযোগ করা অসম্ভব ছিল। যদিও ১০ বছর পরে সব খুব পরিষ্কার দেখা যায়। আবার তুমি সামনে তাকিয়ে কোনো বিন্দু সংযোগ করতে পারবে না। তুমি শুধু পেছনে তাকিয়ে জীবনের বিন্দুগুলোর সংযোগ করতে পারবে। তোমাকে বিশ্বাস করতে হবে জীবনের বিন্দু সব ভবিষ্যতে সংযুক্ত হবেই।

কিছু বিষয়ে বিশ্বাস রাখতে হবে। এসব হচ্ছে আপনার অন্তর্দৃষ্টি, ভাগ্য, জীবন, কর্ম যা–ই বলুন না কেন। এ বিষয়টি আমাকে কখনোই হতাশ করেনি। এই ভাবনা আমার জীবনে বড় পার্থক্য তৈরি করেছে।

দ্বিতীয় গল্প: বিচ্ছেদের গল্প

আমার দ্বিতীয় গল্প প্রেম ও হারানোর গল্প। আমি ভাগ্যবান ছিলাম। জীবনের প্রথম দিকে যা করতে পছন্দ করতাম, তা–ই করেছি। স্টিভ ওজনিয়াককে নিয়ে আমার মা–বাবার গ্যারেজে অ্যাপল কম্পিউটার শুরু করেছিলাম। তখন আমার বয়স ছিল মাত্র ২০ বছর। আমরা কঠোর পরিশ্রম করেছিলাম। মাত্র ১০ বছরের মধ্যে অ্যাপলে ৪ হাজার কর্মী কাজ করা শুরু করেন। প্রায় ২ বিলিয়ন (২০০ কোটি) মার্কিন ডলারের কোম্পানিতে পরিণত হয়। একটি গ্যারেজ থেকে আমরা বড় হয়েছি। আমার বয়স ৩০ হওয়ার এক বছর আগে আমাদের সেরা সৃষ্টি ম্যাকিনটোশ বাজারে আনি।
যে কোম্পানি আপনি শুরু করলেন, সেটি থেকে আপনি কীভাবে বহিষ্কৃত হলেন? অ্যাপল বড় হওয়ার পথে আমরা একজনকে নিয়োগ দিয়েছিলাম। কোম্পানি চালানোর জন্য তাঁকে খুব প্রতিভাবান বলে মনে করেছিলাম আমরা। এক বছর বা তার বেশি সময় ধরে সব ঠিকঠাক ছিল। এরপরে আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন হতে শুরু করে। সবশেষে আমরা পথ হারাই।

সেই সময় অ্যাপলের পরিচালনা পর্ষদ তাঁর পক্ষে ছিল। ফলাফল হিসেবে আমাকে ৩০ বছর বয়সে বের করে দেয়। প্রকাশ্যে আমাকে বের করে দেওয়া হয়। প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের পুরোটা সময় যেখানে মনোযোগ দিয়েছিলাম, তা আমার কাছ থেকে চলে যায়। আমার জন্য নেতিবাচক ছিল বিষয়টি। পরের কয়েক মাস আমি সত্যিই জানতাম না কী করব। আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে আগের প্রজন্মের উদ্যোক্তারা আমাকে নিয়ে হতাশ ছিলেন। যে লাঠি আমার কাছে দেওয়া হয়েছিল, তা আমি ফেলে দিয়েছি। আমি ডেভিড প্যাকার্ড (এইচপির সহপ্রতিষ্ঠাতা) ও রবার্ট (বব) নয়েসের (ইন্টেলের সহপ্রতিষ্ঠাতা) সঙ্গে দেখা করেছিলাম। খারাপ ফলের জন্য ক্ষমা চাওয়ার চেষ্টা করেছি।
সবার চোখে আমি ব্যর্থ ছিলাম। আমি সিলিকন ভ্যালি থেকে পালিয়ে যাওয়ার কথাও ভেবেছিলাম। কিন্তু আমি পেছনে টান অনুভব করছিলাম। আমি তখন যা করেছিলাম, তা এখনো ভালোবাসি। অ্যাপলের নানা ঘটনা আমাকে কোনোভাবে বদলায়নি। আমি প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলাম, যদিও তখন আমি যা করতাম, তার জন্য ভালোবাসা ছিল। আমি আবার কাজ শুরু করার সিদ্ধান্ত নিই। আমি তখন বর্তমান দেখতে পাইনি। অ্যাপল থেকে বহিষ্কার আমার জন্য দারুণ একটি ঘটনা।

স্টিভ জবস

সফলতার ভার ছেড়ে নতুন করে সবকিছু শুরুর পথে নামলাম। নিশ্চিত কিছু ছিল না সামনে। এই সুযোগে আমি জীবনের সবচেয়ে সৃজনশীল সময়ে প্রবেশ করি। পরের পাঁচ বছরের মধ্যে আমি ‘নেক্সট’ নামের একটি কম্পিউটার কোম্পানি চালু করি। পিক্সার নামে আরেকটি কোম্পানি শুরু করি। সেই সময় একজন দারুণ নারীর প্রেমে পড়েছিলাম, যে কিনা এখন আমার স্ত্রী। পিক্সার বিশ্বের প্রথম কম্পিউটার অ্যানিমেটেড পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘টয় স্টোরি’ তৈরি করে। এখন বিশ্বের সবচেয়ে সফল অ্যানিমেশন স্টুডিও। ঘটনাচক্রে অ্যাপল নেক্সট অধিগ্রহণ করে। আমি অ্যাপলে ফিরে যাই। নেক্সটে আমরা যে প্রযুক্তি তৈরি করেছি, তা দিয়েই অ্যাপলের বর্তমান নবজাগরণ চলছে। আর লরেন (স্টিভ জবসের স্ত্রী লরেন পাওয়েল জবস) ও আমার একটি দুর্দান্ত পরিবার আছে।

আমি মোটামুটি নিশ্চিত যে অ্যাপল থেকে বরখাস্ত না হলে আর কিছুই হতো না। ঘটনাটি ছিল ভয়ানক স্বাদের কোনো ওষুধের মতো। কিন্তু আমি বুঝি, সেই ওষুধ রোগীর জন্য প্রয়োজন ছিল। কখনো কখনো জীবন আপনার মাথায় ইট দিয়ে আঘাত করবে। বিশ্বাস হারাবেন না। আমি আমি যা করেছি, তা আমার পছন্দে করেছি—এই বিষয় আমাকে পথ দেখিয়েছে। আপনারা যা ভালোবাসেন, তা খুঁজে বের করতে হবে। এই ভাবনা আপনার কাজের জন্য সত্য। এ বিষয়টি তেমনি আপনার ভালোবাসার মানুষের জন্যও সত্য। আপনার কাজ আপনার জীবনের একটি বড় অংশ হবে। সত্যিকারের সন্তুষ্টি অর্জনের একমাত্র উপায় হচ্ছে, আপনি যা করছেন তা খুব ভালো হিসেবে বিশ্বাস করুন। ভালো কাজ করার একমাত্র উপায় হলো, আপনি যা করেন তাকে ভালোবাসা। আপনি যদি ভালোবাসা খুঁজে না পান, খুঁজতে থাকুন। স্থির হবেন না। মনের মানুষের মতো, আপনি যখন ভালোবাসার কাজ খুঁজে পাবেন, তখন আপনি এমনি জানতে পারবেন। যেকোনো দুর্দান্ত সম্পর্কের মতো বছরের পর বছর কাজের মান ভালো হয়। ভালো কাজ খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত খুঁজতে থাকুন। থামা যাবে না।

তৃতীয় গল্প: বিদায়ের গল্প

আমার তৃতীয় গল্প মৃত্যু নিয়ে। ১৭ বছর বয়সে আমি একটি উদ্ধৃতি পড়েছিলাম, আপনি যদি প্রতিটি দিন এমনভাবে বেঁচে থাকেন যেন তা আপনার শেষ দিন, তবে কোনো একদিন আপনি সঠিক হবেন। এই বাক্য আমার ওপর প্রচণ্ড প্রভাব তৈরি করে। গত ৩৩ বছর আমি প্রতিদিন সকালে আয়নার দিকে তাকাই আর নিজেকে জিজ্ঞাসা করি, ‘আজ যদি আমার জীবনের শেষ দিন হতো, আমি যা করতে চাই তা কি আমি আজ করতে চাই?’ যখনই প্রশ্নের উত্তর না দিয়েছি, তখনই আমি কিছু পরিবর্তন করা দরকার মনে করেছি। মনে রাখছি যে আমি শিগগিরই মারা যাব। এ বিষয়টি আমার জীবনের বড় সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করেছে। এই ধারণা আমার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি হাতিয়ার। এর বাইরে সবকিছুই যেমন বাহ্যিক প্রত্যাশা, অহংকার, অস্বস্তি বা ব্যর্থতার ভয়—সবই মৃত্যুর সামনে হারিয়ে যায়। যা সত্যিকার অর্থে গুরুত্বপূর্ণ শুধু তা থেকে যায়।

মনে রাখবে, তুমি মারা যাবে। হারানোর ভয় নিয়ে যে দুশ্চিন্তার ফাঁদ থাকে, এই ধারণা তা এড়ানোর জন্য আমার জানা সেরা একটি উপায়। এরই মধ্যে তুমি উন্মুক্ত হয়ে আছ, সেখানে মনকে অনুসরণ না করার কোনো কারণ নেই।

প্রায় এক বছর আগে আমার শরীরে ক্যানসার ধরা পড়ে। সকাল সাড়ে সাতটায় আমার স্ক্যান করা হয়। স্পষ্টভাবে আমার অগ্ন্যাশয়ে একটি টিউমার দেখা যায়। আমি জানতামই না অগ্ন্যাশয় কী। চিকিত্সকেরা জানান, নিশ্চিতভাবেই একধরনের দুরারোগ্য ক্যানসারে আক্রান্ত আমি। তিন থেকে ছয় মাসের বেশি বাঁচার আশা নেই। চিকিৎসক আমাকে বাড়ি ফিরে যেতে পরামর্শ দেন। আমার সব বিষয় একটি নিয়মের মধ্যে আনার পরামর্শ দেন। মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতির কথা জানান। অল্প কয়েক মাসে নিজের সন্তানকে ১০ বছরের সব জমানো কথা বলার চেষ্টা করতে বলেন। সবকিছু গুছিয়ে পরিবারের জন্য যতটা সহজ করা যায়। এভাবে আপনাকে বিদায় জানাতে হবে। সেই সময় আমি সারা দিন রোগ নির্ণয়ের জন্য থাকতাম। এক সন্ধ্যায় আমি একটি বায়োপসি করি। আমার গলার নিচে চিকিৎসার যন্ত্র হিসেবে একটি এন্ডোস্কোপ আটকে দেওয়া হয়। পেটের মধ্য দিয়ে অন্ত্রের মধ্যে অগ্ন্যাশয়ে একটি সুচ ঢুকিয়ে দেয়। টিউমার থেকে কোষ সংগ্রহ করে। আমি অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম। আমার স্ত্রী তখন জানায়, মাইক্রোস্কোপের নিচে আমার কোষ দেখে চিকিৎসকেরা কেঁদেছিলেন। অগ্ন্যাশয়ের বিরল ক্যানসার দেখা যায়, যা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে নিরাময়যোগ্য। আমার অস্ত্রোপচার হয়, আর আমি এখন ভালো।

আমি তখন মৃত্যুর সবচেয়ে কাছে গিয়েছিলাম। আমি আশা করি, আসছে কয়েক দশকের মধ্যে এটাই যেন সবচেয়ে কাছে যাওয়া হয়। এভাবে বেঁচে থাকার মাধ্যমে আমি এখন তোমাদের বলতে পারি, মৃত্যু একটি দরকারি বিষয়। মৃত্যু বুদ্ধিবৃত্তিক ধারণার চেয়েও একটু বেশি। আমি বলতে চাই, কেউ মরতে চায় না। এমনকি যারা স্বর্গে যেতে চায়, আসলে তারাও সেখানে যাওয়ার জন্য মরতে চায় না। যদিও মৃত্যু আমাদের সবার শেষ গন্তব্য। কেউ কখনো মৃত্যু থেকে পালাতে পারেনি।  মৃত্যু যেমন হওয়া উচিত, ঠিক তেমনই। মৃত্যু সম্ভবত জীবনের অন্যতম সেরা ভাবনা। মৃত্যু জীবনে পরিবর্তন আনার বড় প্রভাবক। নতুনের জন্য পথ তৈরি করতে পুরোনোকে সরিয়ে দেয়। এই মুহূর্তে আপনি নতুন; কিন্তু কিছু দিনের মধ্যে আপনি ধীরে ধীরে পুরোনো হয়ে যাবেন। তারপরে হারিয়ে যাবেন।

এমন নাটকীয় হওয়ার জন্য আমি দুঃখিত। তবে মৃত্যু বড় একটি সত্য। আপনার সময় সীমিত, তাই অন্য কোনো জীবনযাপনের জন্য সময় নষ্ট করবেন না। গোঁড়ামিতে স্থির থাকবেন না। গোঁড়ামি তো অন্য মানুষের চিন্তার ফলাফল হিসেবে টিকে থাকে। অন্যের মতামতের মাধ্যমে নিজের ভেতরের চিন্তাকে হারিয়ে যেতে দেবেন না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, নিজের মন আর ইন্দ্রিয় অনুসরণ করার সাহস রাখা। আপনার মন ও ইন্দ্রিয় জানে আপনি সত্যিই কী হতে চান। বাকি সব মতামত গুরুত্বপূর্ণ না।

আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন দ্য হোল আর্থ ক্যাটালগ নামের আশ্চর্যজনক একটি ম্যাগাজিন প্রকাশনা ছিল। সেটি আমার প্রজন্মের কাছে বাইবেলের মতো ছিল। মেনলো পার্কে স্টুয়ার্ট ব্র্যান্ড নামের এক ব্যক্তি তা তৈরি করেন। তিনি কাব্যিক ভাবনায় বইটিকে জীবন্ত করে তুলেছিলেন। সময়টা তখন ১৯৬০–এর দশকের শেষের দিকে। তখন পার্সোনাল কম্পিউটার ও ডেস্কটপ পাবলিকেশন ছিল না। টাইপরাইটার, কাঁচি আর পোলারয়েড ক্যামেরার কথা থাকত সেখানে। পেপারব্যাক আকারে আমাদের সময়ের গুগলের মতো ছিল ম্যাগাজিনটি। গুগল আসে তার ৩৫ বছর পরে। ম্যাগাজিনটি ছিল সুন্দর। নানা ধরনের সরঞ্জামের কথা আর দুর্দান্ত সব ধারণা ছিল ম্যাগাজিনে। স্টুয়ার্ট ও তাঁর দল দ্য হোল আর্থ ক্যাটালগ–এর বেশ কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশ করেন।

ম্যাগাজিনটির প্রকাশনা পরে তাঁরা বন্ধ করে দেন। তাঁরা দারুণ একটি শেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছিলেন। সময়টা তখন ১৯৭০–এর দশকের মাঝামাঝি। আর আমি তখন তোমাদের বয়সী ছিলাম। ম্যাগাজিনের শেষ সংখ্যার পেছনের কভারে একটি ছবি প্রকাশ করা হয়। চিরায়ত শহরের ভোরবেলার একটি রাস্তার ছবি ছিল সেটি। আপনি দুঃসাহসিক হলে সেই পথ দিয়ে হেঁটে যাবেন—এমন আবহ ছিল। সেই ছবির নিচে লেখা ছিল ‘ক্ষুধার্ত থেকো আর বোকা থাকো।’ শেষ বার্তা হিসেবে এই বার্তা দেয় ম্যাগাজিনটি। আমি সব সময় নিজে যেন ক্ষুধার্ত থাকি আর বোকা হয়ে থাকার প্রত্যাশা করেছি।
এখন ডিগ্রি শেষে তোমরা নতুন করে শুরু করতে যাচ্ছ। আমি তোমাদের জন্য এমনটা কামনা করছি। ক্ষুধার্ত থাকো আর বোকা থাকো। সবাইকে অনেক ধন্যবাদ।
সূত্র: স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়