ফ্রিল্যান্সিং করার আগে কষ্ট করতে হয়েছে প্রত্যেককে। দারিদ্র্যকে জয় করে তাঁরা পেয়েছেন সাফল্য।
ফ্রিল্যান্সারের বাংলা ‘মুক্ত পেশাজীবী’। নয়টা-পাঁচটা চাকরিতে আবদ্ধ নন তাঁরা। বাসা কিংবা যেকোনো স্থানে বসেই কাজ করতে পারেন। প্রয়োজন নিজের দক্ষতা, বিদ্যুৎ আর দ্রুতগতির ইন্টারনেট সংযোগ।
সম্প্রতি রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে এসেছিলেন তিন জেলার তিন তরুণ ফজলে এলাহী, বাপ্পী আহম্মেদ ও রিমন আহমেদ। তিনজনই তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করছেন।
দেশে তথ্যপ্রযুক্তির প্রসার ও সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগে প্রযুক্তি খাতে ফ্রিল্যান্সিংয়ে তরুণদের আগ্রহ বাড়ছে। বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সার ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির তথ্যমতে, এখন প্রায় সাড়ে ১০ লাখ ফ্রিল্যান্সার বাংলাদেশ থেকে কাজ করছেন। এমন তিনজন তরুণ ফ্রিল্যান্সারের কথা নিয়ে এই প্রতিবেদন।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রতিষ্ঠান স্থানীয় কর্মী নিলে খরচ বেশি হয়। অনেক সময় চাহিদামতো এত কর্মী পাওয়া যায় না। তারা তখন বাইরে থেকে নির্দিষ্ট কাজটি করিয়ে নেয় (আউটসোর্সিং)। এতে ওই প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির যেমন অর্থ সাশ্রয় হয়, তেমনি যেকোনো স্থান থেকে কাজটি করে কোনো ব্যক্তি আয় করতে পারেন। বেশির ভাগ কাজের খবর থাকে নির্দিষ্ট কিছু ওয়েবসাইটে। তথ্যপ্রযুক্তির ভাষায় এগুলো ‘অনলাইন মার্কেটপ্লেস’ (অনলাইন কাজের বাজার)।
ফজলে এলাহীর বাড়ি কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলায়। বাপ্পী আহম্মেদ থাকেন কুষ্টিয়ার বলরামপুরে। আর রিমন আহমেদের বাড়ি নেত্রকোনার মোহনগঞ্জের হাওর এলাকায়। তাঁরা তথ্যপ্রযুক্তির বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষ। নিজের এলাকায় বসে বিদেশের গ্রাহক বা কোম্পানির কাজ করে দেন। এখন তিনজনের প্রত্যেকেরই মাসিক আয় টাকার অঙ্কে লাখের কোটা ছাড়িয়ে। আর ফ্রিল্যান্সিং করার আগে কষ্ট করতে হয়েছে প্রত্যেককে। দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তাঁদের।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করার পর একটি তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন ফজলে এলাহী। করোনা মহামারির সময় চাকরি চলে যায়। হঠাৎ আয়ের সব রাস্তা বন্ধ, কিন্তু পরিবারের খরচ চালাতে হবে। কোনো উপায় না পেয়ে ঢাকার মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে নিরাপত্তা প্রহরীর চাকরি নেন। কাজ করতেন রাতে। দিনের জন্যও চাকরি জোগাড় করলেন। ইস্কাটনের একটি বেসরকারি কুরিয়ার প্রতিষ্ঠানে চিঠি বিলি ও ডেটা এন্ট্রির কাজ।
চলতে হতো। হাঁপিয়ে উঠতাম। কিন্তু পরিবারের কথা মনে করে নিজেকে সামলে কাজ করে যেতাম।’ একপর্যায়ে ফজলে এলাহী সিদ্ধান্ত নেন নিজে কিছু করার। ভাবলেন তথ্যপ্রযুক্তির কিছু বিষয়ে দক্ষ হয়ে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে তো কাজ করা যায়। প্রয়োজন প্রশিক্ষণ। কিন্তু হাতে কোর্স ফি নেই। একজন এগিয়ে এলেন। ফজলে
এলাহী বলেন, ‘এরপর শুরু করি তিন-চার মাসের একটি কোর্স। এখানে মনে হলো কিছু শিখলাম ও জানলাম।’
এরপর ফ্রিল্যান্স আউটসোর্সিংয়ের কাজ খুঁজতে থাকেন ফজলে এলাহী। ইন্টারনেটে তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক আউটসোর্সিংয়ের কাজ
দেওয়া–নেওয়ার মার্কেটপ্লেসে নিজের প্রোফাইল (নিজের সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে খোলা অ্যাকাউন্ট) তৈরি করে কাজের জন্য আবেদন করতে লাগলেন। ফজলে এলাহী ৯ মাস পরে প্রথম কাজ পেলেন ফাইভআর মার্কেটপ্লেসে।
আয় হলো ৩৫ ডলার। যথারীতি কাজটা ছিল বিদেশি গ্রাহকের।
এখন তিনি প্রতি মাসে দুই হাজার ডলার (২ লাখ টাকার বেশি) আয় করেন। ফ্রিল্যান্সার হিসেবে ফজলে এলাহী গুগল অ্যাডস, ওয়েব অ্যানালিটিকস, ফেসবুক কনভার্সনের কাজ করে থাকেন।
৩০ বছর বয়সী ফজলে এলাহীর বাবা আবুল কালাম আজাদ পেশায় ছিলেন শিক্ষক, মা ফৌজিয়া খাতুন গৃহিণী। দুই ভাইয়ের মধ্যে ফজলে এলাহী ছোট। ২০১৬ সালে রাজধানীর অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ এবং ২০১৯ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হিসাববিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। স্ত্রী আতিকা জামান গৃহিণী। সম্প্রতি তাঁরা এক মেয়ের বাবা–মা হয়েছেন।
বাপ্পী আহম্মেদের বয়স মাত্র ২৩ বছর। কুষ্টিয়ার ইবি (ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়) থানার বলরামপুরে বাড়ি। সেখান থেকে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করেন। ইংরেজি নিয়ে স্নাতক (সম্মান) দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছেন কুস্টিয়ার সরকারি লালন শাহ কলেজে। পরিবারের হাল ধরতে ২০২০ সালে একটি চাকরির জন্য ঢাকায় আসেন। বেতন ছিল ১২ হাজার টাকা। চার মাস চাকরি করার পর করোনা মহামারির সময়ে সেটা চলে যায়। এরপর গ্রামে ফিরে যান বাপ্পী।
বাপ্পীর বাবা রায়হান মণ্ডল টাইলসমিস্ত্রি। বাপ্পী ইউটিউবে ভিডিও দেখতে দেখতে একদিন ফ্রিল্যান্স আউটসোর্সিং সম্পর্কে জানতে পারেন। একটা সময় বুঝতে পারেন ফ্রিল্যান্সিং শুরু করতে হলে কম্পিউটার প্রয়োজন। কিন্ত বাপ্পীর হাতে টাকা নেই। পরিবারের কাছ থেকেও সহায়তা পাওয়া সম্ভব না।
বাপ্পী সিদ্ধান্ত নিলেন নিজেই কম্পিউটার কেনার টাকা জোগাড় করবেন। গ্রামে পানের অনেক বরজ রয়েছে। বরজে পানপাতা সংগ্রহ ও গোছানোর কাজ পাওয়া যায়। সারা দিন পান গুছিয়ে দিলে পাওয়া যায় ৩০০ টাকা। শুরু করলেন পান তোলার কাজ। তিন মাসে জমালেন আট হাজার টাকা। অনলাইনে কেনাবেচার একটি ওয়েবসাইট থেকে ব্যবহৃত (সেকেন্ডহ্যান্ড) ল্যাপটপ কম্পিউটারের খোঁজ পেলেন এই বাজেটে এবং সেটা কিনলেন। এবার শেখার পালা। একটি তথ্যপ্রযুক্তির প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ভর্তি হলেন। ছয় মাসের একটি কোর্সে বাপ্পী গুগল অ্যাডস, অনলাইন অ্যানালিটিকস ও ফেসবুক অ্যাডস শিখলেন।
এখানেই শেষ নেয়। বাপ্পী বলেন, ‘কোর্স করার পর সেই বিষয়গুলোর ব্যবহারিক ভিডিও টিউটোরিয়াল দেখতাম নিয়মিত। প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ ঘণ্টা। এভাবে ৯ মাসে নিজেকে গড়ে তুলেছি।’ এরপর বাপ্পী ফ্রিল্যান্স আউটসোর্সিংয়ের কাজ শুরু করলেন। অনলাইন মার্কেটপ্লেস আপওয়ার্ক ডটকম ও ফাইভআর ডটকমে নিজের অ্যাকাউন্ট খুললেন। কাজের জন্য আবেদন করতে থাকলেন। ২৩ দিনের চেষ্টায় ফাইভআরে পাঁচ ডলারের কাজ পান বাপ্পী। কাজটা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের একজন গ্রাহকের। সময়মতো কাজটা বুঝে পাওয়ায় ওই গ্রাহক ১০ ডলার টিপস দেন বাপ্পীকে এবং চারটা নতুন কাজ দেন ২০০ ডলারের। ‘এভাবে শুরু করে ফাইভআরে আজ পর্যন্ত ৫১৮টি কাজ করেছি। আরেকটি মার্কেটপ্লেস আপওয়ার্কেও বেশ কিছু কাজ করেছি।’ বলেন বাপ্পী। মার্কেটপ্লেসের বাইরেও কিছু গ্রাহকের কাজ সরাসরি করেন তিনি। এখন বাপ্পীর মাসিক আয় পাঁচ হাজার ডলার (প্রায় ৫ লাখ ৪০ হাজার টাকা)।
ছেলের জন্য সংসারের বেশ সচ্ছলতা এসেছে। তাই রায়হান মণ্ডল টাইলসমিস্ত্রির কাজ ছেড়ে দিয়েছেন। বাড়িতে গড়ে ওঠা গরুর খামার দেখাশোনা করেন। বাপ্পীর মা পারুলা খাতুন। তিন ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট বাপ্পী। মোছা. সুমিতা খাতুনকে গত বছরের শেষ দিকে বিয়ে করেছেন বাপ্পী।
নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে রিমন আহমেদের বাড়ি একদম হাওরবেষ্টিত। যেখানে নেই নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ–সংযোগ, ইন্টারনেট–সংযোগ। যোগাযোগব্যবস্থাও বেশ দুর্বল। ২০১৯ সালে নেত্রকোনা সরকারি কলেজে রিমন স্নাতক (সম্মান) সম্পন্ন করার পথে। চাকরির চেষ্টা করছেন। কিছু সাক্ষাৎকারও দিয়েছেন। ২০২০ সালে শুরু হলো করোনা মহামারি। সব শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ। রিমন পরিবারের বড় সন্তান। বাবারও উপার্জন বন্ধ তখন।
বিকল্প চিন্তা করলেন রিমন। যেখান থেকে তথ্যপ্রযুক্তির ফ্রিল্যান্সার হিসেবে রিমনের যাত্রার সূচনা হয়। চাচাতো ভাইয়ের কাছ থেকে চার হাজার টাকা ধার নিয়ে একটি তথ্যপ্রযুক্তি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হন। চার মাসের কোর্স। তবে তেমন কিছু শিখতে পারেননি। অনলাইন মার্কেটপ্লেসে কাজ পাওয়ার চেষ্টা করেও লাভ হলো না।
রিমন যেন হতাশায় হাবুডুবু খাচ্ছিলেন। হঠাৎ একদিন ফেসবুকে কৌতূহলী এক বিজ্ঞাপন সামনে আসে। সেখানে লেখা ছিল ‘জীবনের শেষ চিকিৎসা’। আগ্রহবশত বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে যান রিমন। এটা ছিল তথ্যপ্রযুক্তির প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট। রিমন বলেন, ‘২০২১ সালের অক্টোবর মাসে এই প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হই। গুগল অ্যাডস ও ওয়েব অ্যানালিটিকস কোর্স সম্পন্ন করি ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে। পাশাপাশি নিজেও চর্চা করে যাচ্ছিলাম।’
কোর্স করার পর রিমন ফাইভআর ডটকমে নিজের অ্যাকাউন্ট খোলেন। মজার ব্যাপার হলো মাত্র ১৪ দিন পরে ৭৫ ডলারের একটি কাজ পেয়ে যান। আরও উৎসাহিত হন। তখন রিমন কাজ করতেন একটি পুরোনো ল্যাপটপ কম্পিউটার দিয়ে।
রিমন বলেন, হাওর এলাকায় দ্রুতগতির ইন্টারনেট–সংযোগ সহজলভ্য ছিল না। পুরোনো ল্যাপটপের চার্জ এক ঘণ্টা পর পর শেষ হয়ে যেত। এরপর বাড়িতে এসে ল্যাপটপ চার্জ করতে হতো। আবার গ্রাহকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে নৌকা নিয়ে হাওরে যেতে হতো, যাতে ইন্টারনেটের সংযোগ ভালোভাবে পাওয়া যায়। এভাবে তিন–চার মাসে তিনি ১৫টি প্রকল্প সম্পন্ন করে ৪০০ ডলার আয় করেন।
উচ্চগতির ইন্টারনেট, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎসহ কাজের জন্য একটি উপযুক্ত পরিবেশের প্রয়োজন ছিল রিমনের। তাই মোহনগঞ্জ থেকে রিমন চলে গেলেন নেত্রকোনা শহরে। তিনি বলেন, ‘এরপর থেকে আমাকে আর পেছনে থাকাতে হয়নি। এখন মাসিক আয় দুই হাজার ডলার (প্রায় ২ লাখ ১৬ হাজার টাকা)।
মোহনগঞ্জের বরান্তর গ্রামে ১৯৯৫ সালে জন্ম রিমন আহমেদের। বাবা আজিজুর রহমান কৃষিকাজে জড়িত, মা মোছা. মুক্তা আক্তার গৃহিণী। নেত্রকোনা সরকারি কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন রিমন। চার ভাইবোনের মধ্যে দ্বিতীয় রিমন নিজের আয় থেকে বাড়ির সংস্কার করেছেন, পরিবারের ঋণ শোধ করেছেন। গত ফেব্রুয়ারিতে উম্মে হাবিবাকে বিয়ে করেন।
রিমন বলেন, ‘এককথায় অর্থনৈতিক মন্দার খাদে আটকে যাওয়া নিজেদের পরিবারকে তুলে আনতে পেরেছি এটাই বড় কথা। এখন আমি ফ্রিল্যান্সিং শিখতে আগ্রহী ছেলেমেয়েদের জন্য কাজ করছি।’
তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ‘ফ্রিল্যান্সিং’ তরুণদের কাছে লোভনীয় শব্দ। নিজের দেশে বসে বিদেশে কাজ করে আয় করার এক পথ। ফজলে এলাহী, বাপ্পী আহম্মেদ ও রিমন আহমেদ—তিনজনই বললেন এই খাতে সাফল্যের চেয়ে ব্যর্থতার গল্পই বেশি। না বুঝে না জেনে অনলাইনে শুধু প্রোফাইল খুলে ফেললেই কাজ করার সুযোগ আসে না। প্রযুক্তির যে বিষয়গুলোর চাহিদা এখন বেশি, সেগুলোর কোনো একটাতে দক্ষ হয়ে উঠতে হবে। এরপর ধৈর্য ধরে লেগে থাকতে হবে। তিন তরুণের পরামর্শ—বিদেশি গ্রাহকের কাজ দেওয়া–নেওয়ার ক্ষেত্রে সময় মানা ও সততার সঙ্গে কাজ সম্পন্ন করে দিতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।