দেশে ইন্টারনেটের গতি কম থাকায় বিভিন্ন দেশে গিয়ে গ্রাহকদের সফটওয়্যার ও তথ্যপ্রযুক্তি সেবা দিচ্ছেন অনেকে
দেশে ইন্টারনেটের গতি কম থাকায় বিভিন্ন দেশে গিয়ে গ্রাহকদের সফটওয়্যার ও তথ্যপ্রযুক্তি সেবা দিচ্ছেন অনেকে

ইন্টারনেট পেতে বিদেশযাত্রা

একটা সময় পত্রপত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখা যেত—‘উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশযাত্রা’। এখন মেধানির্ভর তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ‘উচ্চগতির ইন্টারনেট পেতে বিদেশযাত্রা’ দেখা যাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে কারফিউ জারির আগে ১৭ জুলাই মধ্যরাত থেকে মুঠোফোনে ফোর-জি নেটওয়ার্ক বন্ধ করায় দেশের মোবাইল ইন্টারনেট–সেবা বন্ধ হয়ে যায়। ১৮ জুলাই রাত পৌনে ৯টা থেকে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগও বন্ধ হয়ে যায়। এতে নানা ধরনের অসুবিধা দেখা দেয়। বিপদে পড়ে যায় দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত। যাঁরা বিদেশি গ্রাহকদের সফটওয়্যার ও তথ্যপ্রযুক্তি সেবা দিয়ে থাকেন, সেই সফটওয়্যার উদ্যোক্তা ও ফ্রিল্যান্সাররা বেশি বিপদে পড়ে যান। কেননা, বিদেশে থাকা গ্রাহকের সঙ্গে ইন্টারনেট যোগাযোগ ছাড়া তাঁদের একমুহূর্তও চলে না। ইন্টারনেট না থাকায় ৮-১০ বছর ধরে গড়ে তোলা আস্থার জায়গাটা যেন চোখের পলকেই শেষ হয়ে যায়। বিদেশের গ্রাহক ও কাজ টিকিয়ে রাখতে ইন্টারনেট পাওয়ার জন্য অনেকে দেশের বাইরে নিজে গিয়ে বা দল পাঠিয়ে এই বিপর্যয় সামাল দিচ্ছেন।

ফ্লিট বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খায়রুল আলম ব্যাংকক থেকে মুঠোফোনে আজ মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের পুরো কাজটা ইন্টারনেটনির্ভর। আমরা অ্যামাজান ওয়ালমার্ট ও স্টোর ম্যানেজমেন্ট সার্ভিস নিয়ে কাজ করি। তাই ইন্টারনেট ছাড়া আমরা অচল। অ্যামাজান ওয়ালমার্টে প্রতিদিন দুই হাজারের মতো ফরমাশ (অর্ডার) পাঠিয়ে থাকি। কিন্তু ইন্টারনেট বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই কাজ থেমে যায়।’

খায়রুল আলম আরও বলেন, ‘আমি ব্যাংককে চলে আসি। এখানে আমার আরও তিন সহযোগী ছিলেন। এই চারজন মিলে কিছুটা সামাল দিই। গ্রাহকদের পরিস্থিতি জানিয়ে বলি, কাজগুলো এখন একটু ধীরগতিতে হবে। কারণ, ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় বাংলাদেশে আমার ২৫০ কর্মী থেকেও লাভ নেই। তাঁরা কাজ করতে পারছেন না। এর মধ্যে দুজন গ্রাহক চলেও যান। আরও কিছু ক্লায়েন্ট বারবার জিজ্ঞেস করছেন, কাজগুলো করতে পারব কি না। এখন দেশের বাইরে এসে কিছুটা সামাল দিতে পারলেও দেশে যে ধীরগতির ইন্টারনেট, সেখানে আমার কর্মীরা কাজ করতে পারছেন না।’ ২২ জুলাই থেকে তিনি ব্যাংককে অবস্থান করছেন।

বেসিসের পরিচালন ও এআর কমিউনিকেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম আসিফ রহমান সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই থেকে মুঠোফোনে বলেন,‘আসলে ইন্টারনেট না থাকার কারণেই দেশের বাইরে থেকে যত দূর পারছি কাজ সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছি। একটা দল দুবাই আর একটা দল নেপাল থেকে কাজ করে দিচ্ছে। তারপরও গ্রাহকের খারাপ রিভিউ পেয়েছি। এমনও শুনতে হচ্ছে, “আপনারা কেমন প্রতিষ্ঠান, যে সার্পোট দিতে পারছেন না!”একটা কঠিন সময় পার করছি।’

অনেক ফ্রিল্যান্সার কাজ করতে চলে গেছেন সীমান্তবর্তী স্থলবন্দর এলাকায়। কারণ, সীমান্তবর্তী এলাকায় দুই দেশের মোবাইল নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়। প্রতিবেশী দেশের ইন্টারনেট ব্যবহার করে তাঁরা গ্রাহকদের কাজ করে জমা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। ফিল্যান্সাররা মেহেরপুর, যশোরের বেনাপোল, লালমনিরহাটের মোগলহাট স্থলবন্দরসহ বিভিন্ন স্থান থেকে কাজ করছেন। সেখান থেকে গ্রাহকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ফ্রিল্যান্সার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাধ্য হয়ে স্থলবন্দরে এসেছি। বলতে পারেন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। এত দিনের পরিশ্রম শেষ হয়ে যাচ্ছিল। তাই স্থলবন্দর এলাকা থেকে গ্রাহকের কাজ করছি। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছি।’

দেশের সফটওয়্যার খাতের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সভাপতি রাসেল টি আহমেদ আজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় আমাদের প্রায় সবাইকেই বিপদে পড়তে হয়েছে। কারণ, ইন্টারনেট বন্ধ থাকলে আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো বাঁচানো অসম্ভব। আর সবার তো সাধ্য নেই যে পুরো দল নিয়ে বিদেশে গিয়ে কাজ চালিয়ে যাবে। যাদের সক্ষমতা আছে, তাদের কিছু কর্মী গিয়েছেন। ১০০ শতাংশ সাপোর্ট দিতে না পারলেও প্রতিষ্ঠানের সুনাম টিকিয়ে রাখার জন্য অনেকে দেশের বাইরে গিয়েছেন। গুরুত্বপূর্ণ কাজ ও মেইল আদান–প্রদানের জন্যই তাঁরা বিভিন্ন দেশে ছুটছেন। যেমন নেপাল, দুবাইয়ে কিছু প্রতিষ্ঠান গিয়ে সাপোর্ট দিয়েছেন তাঁরা।’

বেসিস সভাপতি রাসেল টি আহমেদ বলেন, ‘এখন যে ইন্টারনেট খুবই ধীরগতির, আমি বলব না যে গতি কমানো হয়েছে। এটা একটা কারিগরি সমস্যা। আমার অনুরোধ, তথ্যপ্রযুক্তি খাত যেহেতু ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীল, তাই এই খাতের জন্য ইন্টারনেটের ব্যবস্থা করা উচিত।’

বন্ধ থাকার পাঁচ দিন পর ২৩ জুলাই রাতে সীমিত পরিসরে পরীক্ষামূলক ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট–সংযোগ দেওয়া হয়। ২৪ জুলাই সারা দেশেই ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট চালু হয়। ২৮ জুলাই বিকেল থেকে মুঠোফোনে ফোর-জি ইন্টারনেট চালু করা হয়। কিন্তু ২৯ জুলাই দুপুরের পর থেকে মোবাইলের ফোর-জি ইন্টারনেট ধীরগতিতে চলছে। আজ মঙ্গলবারও গতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি দেখা যায়নি।