‘সালটা ২০১৬। দিন দিন আমার শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছিল। কী করব, কোথায় যাব কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। সবে জীবন শুরু, কত স্বপ্ন, কত কিছু করার ইচ্ছা—ধীরে ধীরে সব শেষ হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু একটা জেদ চেপে বসল। যত কষ্ট হোক কিছু একটা আমি করব। প্রথম আলোর ফিচার পড়তাম।
ফ্রিল্যান্সিং নিয়ে যত ধরনের লেখা ছাপা হতো, সেগুলো পড়তাম। মনে মনে চিন্তা করে ফেললাম এর চেয়ে ভালো কাজ আর নেই। আমার মতো শারীরিক অক্ষম মানুষের জন্য উপযোগী।
কাজ করতে গিয়ে অনেকের কটুকথাও শুনতে হয়েছে। শুনতে হয়েছে এটা ক্লিকের কাজ। লাভ নেই সব ভুয়া।’ গত মঙ্গলবার রাতে মুঠোফোনে এমনটাই বলছিলেন ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছার ফ্রিল্যান্সার হাসানুল ইসলাম। বলেছেন তাঁর সফলতার গল্প।
২০১৪ সালে মুক্তাগাছার শহীদ স্মৃতি সরকারি কলেজে বিপণন বিভাগে দ্বিতীয় বর্ষে পড়তেন হাসানুল। ক্রিকেট খেলতেন নিয়মিত। দৈনিক পত্রিকার তথ্যপ্রযুক্তি পাতাগুলোর নিয়মিত পাঠক ছিলেন।
হাসানুলের বাবা মো. আমিনুল ইসলাম পেশায় ছিলেন গাড়িচালক। ২০১১ সালে গলার ক্যানসারে আক্রান্ত হন তিনি। তার পর থেকে একটু একটু করে সরে আসেন তাঁর পেশা থেকে। হাসানুল সবার বড় সন্তান। বড় ছেলে হিসেবে দায়িত্বও বেশি। তখন থেকেই হাসানুলের চিন্তা—জীবনে অনেক বড় হতে হবে।
এদিকে হঠাৎ হাসানুলের শারীরিক অসুস্থতা দেখা দেয়। তিনি কঠিন এক স্নায়ুরোগ মাইওপ্যাথিতে আক্রান্ত হন। মাংসপেশি দুর্বল হয়ে পড়ে, শরীর দিনে দিনে ভেঙে পড়ে। এর মধ্যেও ফ্রিল্যান্সিং শেখার আগ্রহে ভাটা পড়ে না। তবে ভালোভাবে শেখার কোনো জায়গা পান না। একদিকে শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে, অন্যদিকে নিজেকে গোছাতে থাকলেন। হাসানুল বলেন, ‘যখন যে যেটা করতে বলত, তখন তা-ই করতাম। ইউটিউব থেকে শুরু করে বিভিন্ন ফ্রিল্যান্সিংয়ের মার্কেটপ্লেস (ফ্রিল্যান্সারদের জন্য আউটসোর্সিং কাজ পাওয়ার ওয়েবসাইট) ঢুকে দেখতাম।’
এমনই অসুস্থ হয়েছিলেন হাসানুল যে হাঁটাচলা করতে পারতেন না। এটা ২০১৬ সালের কথা। এক চেয়ার থেকে আর এক চেয়ারে গিয়ে বসতেও অন্যের সহায়তা নিতে হতো হাসানুলের। কোনোভাবেই নিজেকে বোঝাতে পারেন না, তাঁর জীবন এখানেই থেমে যাবে। কিন্তু কিছু একটা করার জেদ সব সময় কাজ করত। পরিবারের বড় ছেলে হিসেবে তাঁর দায়িত্ব অনেক। জেদ ধরে কম্পিউটার নিয়েই পড়ে থাকলেন হাসানুল।
তখন ইন্টারনেট-সংযোগের মাসিক খরচ দেওয়াও মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। মা-বাবা বলে বসলেন, কিছু হবে না, বাদ দাও। তখনো জেদ বজায় রাখলেন হাসানুল। এদিকে পড়াশোনাও করতে হচ্ছে। বন্ধুবান্ধব ধরে ধরে শুধু পরীক্ষার সময় তাঁকে নিয়ে যেতেন কলেজে। ২০১৭ সালে অনলাইনে আউটসোর্সিংয়ের কাজ দেওয়া-নেওয়ার মার্কেটপ্লেস ফাইভারে নিজের একটি অ্যাকাউন্ট খোলেন হাসানুল। তারপর দিনের পর দিন চেষ্টা করতে থাকেন নিজে নিজেই। একটা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যদিও গিয়েছিলেন হাসানুল, কিন্তু কাজ করার মতো কিছু শিখতে পারেননি।
২০২০ সালে সরকারের লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের (এলইডিপি) অধীনে ময়মনসিংহ জেলায় বিনা মূল্যের এক প্রশিক্ষণের খবর পান হাসানুল তাঁর এক বন্ধুর কাছ থেকে।
সেই বন্ধু হাসানুলকে লিংক দেন প্রশিক্ষণের জন্য। হাসানুল সেখানে আবেদন করেন। পরীক্ষায় টিকে গিয়ে শুরু করেন প্রশিক্ষণ। প্রায় চার মাসের প্রশিক্ষণে মোট ২০০ ঘণ্টার ৫০টি ক্লাস করেন। ডিজিটাল বিপণনের ওপর প্রশিক্ষণ নেন তিনি। প্রশিক্ষণ নেওয়ার কিছুদিনের মধ্যে হাসানুল ফাইভারে পেয়ে যান ৪০ ডলারের একটি কাজ। তখন তাঁর ভালো লাগাটা ছিল আকাশছোঁয়ার মতো।
হাসানুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আসলে শারীরিক অসুস্থতা কোনো অক্ষমতা নয়, মন সুস্থ থাকলে সব সুস্থ। সবচেয়ে বড় কথা, মনে সাহস থাকতে হবে।’ যদি ধৈর্য আর দক্ষতা বাড়াতে পারে কেউ, তবে আমার মতো শারীরিকভাবে যাঁরা অক্ষম, তাঁরা সহজেই ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজটি করতে পারে।
আমার এখন মাসে কমবেশি ৭০০ ডলার আয় হয়। আমি যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশের কাজ করে থাকি। সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন বা সংক্ষেপে (এসইও) ও অনলাইন রিসেপশন ম্যানেজমেন্ট (ওআরএম) নিয়ে কাজ করছি।’
ফ্রিল্যান্সার হিসেবে সফলতা পাওয়ার পর হাসানুল বিয়ে করেছেন শাহনাজ হাসানকে। তাঁদের এক ছেলে সাফুয়ান ইবনে হাসান। নিজের কাজটা ভালো করে করতে হবে, এটাই মূল লক্ষ্য হাসানুলের। নিজে কাজ করছেন, আর প্রশিক্ষণও দিচ্ছেন তরুণদের। হাসানুল বলেন, ‘সামনের পরিকল্পনাগুলো আমার বড়। নিজেই দক্ষ জনবল তৈরি করে একটি প্রতিষ্ঠান করব।’